৯৭-৯৮ সালের কথা। বই মেলায় যাই। পছন্দের বই কিনি আর মন খারাপ করে ঘরে ফিরি। কারণ খুব বেশি বই কিনতে পারি না। আমার অতো টাকা নেই।
আশপাশে কত প্রিয়জন ঘুরে বেড়ান, তাঁদের বই বেরিয়েছে। দেখে খুশি হই। কিন্তু তাঁদের খুশি করতে পারি না। কারণ একটাই-সবার একটা করে বই কেনার মতো টাকা আমার নেই। প্রিয়জনেরা বড় মুখ করে আমার দিকে তাকান।
মুখ ফুটে বলেন না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি। চেনা-পরিচিতরাই যদি বই না কিনল, তবে লেখক নতুন করে লিখতে উৎসাহী হবেন কেন? আমাদের অতো উৎসাহ কোথায়? লেখালেখিটা তো আর আমাদের এখানে ভাত-রুটি জোটায় না।
তখন কেবল ছড়াই লিখতাম। তুখোড় কয়েকজন ছড়াকার ছিলেন সে সময়। কার নাম বলব? যাদের ছড়া ভালো লাগত তাদের মধ্যে বাকিউল আলম, বদরুল বোরহান, টিপু কিবরিয়া, প্রশান্ত রায়, রোমেন রায়হান, সারওয়ার-উল ইসলাম।
এঁরা সবাই তরুণ। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র কয়েকবছরের বড়। আর ভালো লাগার ছড়াকার তো শেষ নেই। আমার আগে যাঁরাই ছড়া লিখেছেন, সবাই আমার গুরুজন। তাঁদের সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।
আমার ছড়া শেখা তো তাঁদের কাছেই। আর আমাকে হাতে-কলমে ধরে ধরে মাত্রা, ছন্দ শিখিয়েছেন প্রশান্ত রায়।
প্রশান্তর বাসায় যেতাম প্রায়ই। নতুন কোনো ছড়া লিখলেই ছুটতাম মিরপুর থেকে রামপুরা। প্রশান্ত তখন রামপুরা থাকেন।
আমার কাসমেট। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় পরিচয় ও সখ্যতা। তখন মিরপুর থেকে রামপুরা যাওয়া কিন্তু চাট্টিখানি কথা ছিল না। তিনটা বাস বদল করতে হতো।
যাই হোক, বই মেলায় যাই আর বই কিনতে না পারার কষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরি।
আরো একটা খারাপ লাগাও থাকে তখন-আমার বই বেরুবে কবে?
আমার তো অতো টাকা নেই যে, টাকা দিয়ে বই বের করতে পারব। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ আহামরি এমন কোনো নামি-দামি ছড়াকার আমি ছিলাম না। পত্রিকায় বা কোনো সংকলনে ছড়া ছাপা হলেই খুশি। যদিও কিশোর ভুবন নামে একটা পাকি পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজও করেছিলেন কয়েক বছর।
ভালো লাগল না, ছেড়ে দিয়েছিলাম। মালিক প্রকাশক ছিলেন এইচ এন আশিকুর রহমান। আর সম্পাদক ছিলেন হিলাল ফয়েজী। হিলাল ভাই তখন বিখ্যাত। তাঁর রঙ্গ লেখা ছাপা হয় প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকায়।
অসাধারণ সব লেখা। তাঁর ভক্তও তখন অনেক।
প্রতিদিন বইমেলায় যাই, আর কষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরি। ঘরে ফেরার সময় বুকটা হাহাকার করে। ইশ, আজ কী দারুণ একটা বই দেখেছিলাম।
কিন্তু পকেট!
প্রতিদিন মেলা থেকে ফেরার সময় ভাবি, আগামি দিন আর আসবো না। চেষ্টাও করেছিলাম একদিন। বই মেলায় না গিয়ে আড্ডায় বসেছিলাম। আহা! কী মধুময় আড্ডা। যখন ইচ্ছে আসো।
যখন ইচ্ছে যাও। কেউ কিছু বলবে না। কারো কোনো বাধা নেই। সকাল আটটা থেকেই শুরু। শেষ নেই।
রাত দুটা তিনটা-যতখণ খুশি। সেই মধুময় আড্ডাও ভালো লাগল না। আড্ডা শেষে ঘরে ফেরার সময় অনুভব করি, কষ্টা যেন আরো বাড়ল। বরং বই মেলায় গিয়েই কষ্ট নেবো। সেটাই ভালো।
ওই কষ্টটাই আমার সুখ।
এখন প্রতিবছর আমার তিনটা চারটা করে বই বেরোয়। কিন্তু সেই সুখটা আর নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।