খাদ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইন হচ্ছে ও কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। ভেজাল চিহ্নিত করার পরীক্ষাগার হয়েছে। তার জন্যও একটা কর্তৃপক্ষ হয়েছে। কেনা হচ্ছে ভেজাল চিহ্নিত করার যন্ত্র। কিন্তু এত উদ্যোগ থাকলেও রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশে শিল্প খাতে চাহিদার তুলনায় চার গুণ বেশি ফরমালিন আমদানি হয়েছে। শিল্প খাতে ফরমালিনের চাহিদা ৪০ থেকে ৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ২০৫ টন ফরমালিন আমদানি হয়েছে। বাড়তি ফরমালিন খাদ্যে ব্যবহূত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, মাছ, ফলমূল ও সবজিতে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ে নানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত মার্চে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাজারে বিক্রি হওয়া ৯৫ শতাংশ আমে ফরমালিন ব্যবহূত হচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ, চর্ম ও হূদেরাগের পাশাপাশি যকৃতের সমস্যা বেড়ে গেছে। সম্প্রতি আলসার রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার সামগ্রিক গবেষণা নেই। ছয়টি সরকারি সংস্থা তাদের পরীক্ষাগারে ছয় পদ্ধতিতে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পরীক্ষা করে থাকে।
বিএসটিআই, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), পরিবেশ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিজস্ব খাদ্য ও পানীয় পরীক্ষার পদ্ধতি আছে।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা কোন সংস্থায় পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন, খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়েছে কি না, তা সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। কোনো একক স্বীকৃত পদ্ধতি না থাকলেও সরকারের তিনটি সংস্থা আলাদাভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কোনো সংস্থার পরীক্ষাগারে খাদ্যে ব্যবহূত হওয়া ফরমালিনের পরিমাণ নিশ্চিত হওয়া যায় না। খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার পরীক্ষার দায়িত্ব একক কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া উচিত।
ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর, বিএসটিআই ও র্যাব ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজারে ভেজালবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। তারা খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার চিহ্নিত করে খুচরা ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা ও সংশ্লিষ্টদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় উৎপাদক ও পাইকারি পর্যায়ে। এই দুই ক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার রোধে সরকারি উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে খাদ্য ও ওষুধবিষয়ক একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা রয়েছে।
তারা খাদ্যে ভেজাল বা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত একক পদ্ধতি ব্যবহার করে খাদ্যে রাসায়নিক পরীক্ষা করে থাকে। ওই সংস্থার অনুমোদন পাওয়া খাদ্যকে নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়।
চলতি সপ্তাহে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। এই আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খসড়ায় বলা হয়েছে, আইনটি বাস্তবায়নের জন্য আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ করা হবে। কিন্তু ভেজালবিরোধী বা খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অন্য সরকারি সংস্থা ও পরীক্ষাগারগুলোর সঙ্গে নতুন এই সংস্থার কাজের সমন্বয় কীভাবে হবে, তা খসড়ায় বলা হয়নি।
সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য যে কার্যবিধি বা এলোকেশন অব বিজনেস করা আছে, তাতে খাদ্য মন্ত্রণালয় শুধু দানাদার খাদ্যমান ও সরবরাহের বিষয়টি দেখবে। আর খাদ্যকেন্দ্রিক রোগবালাইয়ের বিষয়টি দেখবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আবার পানির গুণগত মানের বিষয়টি দেখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
ফলে নতুন আইন বাস্তবায়নের মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় সরকার ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে খাদ্যে রাসায়নিকের পরিমাণ চিহ্নিত করার একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করেছে। কিন্তু এক বছর হয়ে গেলেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় পরীক্ষাগারটি চালু হয়নি। পরীক্ষাগারের প্রধান শাহ মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বমানের এই পরীক্ষাগারটি চালু করার জন্য এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।
কিন্তু এই পরীক্ষাগারটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহাখালীতে স্থানীয় সরকারের অধীন জনস্বাস্থ্যের জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে।
নতুন আইন কার্যকর হলে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তখন এই গবেষণাগারটি কার অধীনে থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মাহমুদুর রহমান মনে করেন, নিরাপদ খাদ্যের জন্য এসব উদ্যোগকে একটা ছাতার নিচে নিয়ে আসা উচিত। সেখানে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার থাকবে এবং তারাই বলবে কোনো খাদ্য নিরাপদ কি অনিরাপদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।