আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃস্বপ্নে ছন্দপতন

ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ...... মরিবার হল তার সাধ । নিজাম চাচ্চু নিতান্তই সাদামাটা মানুষ। এ পর্যন্ত কখনও ক্লাস মিস করেননি তিনি। প্রতিদিনই তিনি ক্লাসের বাম পাশের সারির একদম বামপাশে বসেন। কারন ডান পাশের সারিতে বসে মেয়েরা।

নিজাম চাচ্চু মেয়েদের এড়িয়ে চলেন। কোন এক শীতের রাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, "বুঝলি আরাফাত ! মেয়ে জাতি বড়ই রহস্যময়। কখনও তারা মায়াময়ী, কখনও ছলনাময়ী। তারা ভাঙ্গতেও পারে, গড়তেও পারে। " তবে তিনি কথা খুব কম বলেন।

তার বয়স যে খুব বেশী তাও না। ভাব-গম্ভীর চেহারা, থুতনিতে দাড়ি আর মোটা ফ্রেমের চশমার কম্বিনেশনের কারনে তাকে চাচ্চু বলে ডাকা হয়। তবে তাকে কি বলে ডাকা হলো এ ব্যাপারে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু যে আমরাই তাকে চাচ্চু বলে ডেকে মজা পাই তা নয়। বুলেট ভাই ও তার ছোটোভাইয়েরা তাকে রীতিমত জ্বালাতন করে।

তাতেও নিজাম চাচ্চুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বুলেট ভাই সম্পর্কে বলে রাখা ভালো- সে ক্ষমতাবান মানুষ। ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করে অথচ তার অত্যাচারের শিকার হয়নি এমন মানুষ দুর্লভ। তার অত্যাচার থেকে মেয়েরাও বাদ যায়না। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না, কারন সবাই জানে ফলাফলে তার নিজের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

নিজাম চাচ্চুর সমস্যাটা শুরু হলো হঠাৎ করেই। অবাক ব্যাপার- তিনি জীবনে কখনও ঘুমের ভিতর স্বপ্ন দেখেননি। তবে সেটা তার সমস্যা না। সমস্যার শুরু যেদিন তিনি স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন সেদিন থেকেই। স্বপ্ন নয়- দুঃস্বপ্ন।

তেমন মারাত্বক কিছু নয়, তিনি দেখলেন তাকে হাত পা বেধে একটা অন্ধকার ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এতেই তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। একবার নয় তিনি বারবার একই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন এবং ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠতে লাগলেন। এক পর্যায়ে ঘুমের প্রতি তাঁর ভীতির সৃষ্টি হল। রাত দশটার সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন আগে।

তাঁর সে স্বভাব একদমই মিলিয়ে গেলো। তিনি মোটেও ঘুমাতে পারতেন না, আর শেষরাতে যেটুকু ঘুমাতেন সেই একই স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠতেন। তাঁর চিৎকারে পাশের রুম থেকে লোকজন চলে আসতো। খুব সমস্যার সৃষ্টি হলো। আমরাও ঘুমাতে পারতাম না।

হলজুড়ে কানঘুষা চলতে লাগলো- নিজাম চাচ্চু পাগল হয়ে গেছেন। আমি নিজাম চাচ্চুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সব শুনে চাচ্চুকে কিছু পরামর্শ দিলেন তার পরে কিছু ঘুমের অষুধ লিখলেন প্রেসক্রিপশনে। তারপর চাচ্চুকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। চাচ্চু বাইরে যেতেই ডাক্তার আমাকে বললেন চাচ্চুর সমস্যাটা হঠাৎ করেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে, কিন্ত যতদিন সমস্যাটা না যায় আমাদের ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে।

অনিদ্রার কারনে হঠাৎ হঠাৎ করেই তার মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। ডাক্তার আমাকে বললেন এমনটি যদি হয় আমরা যেন এ ব্যাপারে তার সথে খারাপ ব্যবহার না করি। রুমে ফিরে নিজাম চাচ্চুর অগোচরে রুমমেটদের ব্যাপার গুলো বুঝিয়ে বললাম। সেদিন অষুধ খেয়ে নিজাম চাচ্চু শান্তিতে ঘুমালেন। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সমস্যাটা পরেরদিন থেকেই আবার ফিরে এলো। অষুধে কিছুই হলোনা। স্বপ্ন আরো ভয়ঙ্কর হলো। স্বপ্নে যোগ হলো হারেস চাচা। হারেস চাচা ছিলেন নিজাম চাচ্চুর সৎ চাচা।

নিজাম চাচ্চুদের গ্রামের জমিজমা দেখাশোনা করতেন। নিজাম চাচ্চুকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্ত কেনো জানি নিজাম চাচ্চু তাঁকে খুব ভয় পেতেন। শুধু তিনি না গ্রামের সব লোকই তাঁকে ভয় পেত। তাঁর একটা রামদা ছিলো, সবসময় সাথে থাকতো।

গ্রামে কথিত ছিলো, "হারেস মিয়া এক কোপে মাইনসের মাথা কাটবার পারে। সাবধান !!" মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে অনেক রাজাকার আর পাক আর্মি হারেস চাচার রামদার শিকার হয়েছিল। গ্রামের সব লোকের ভয় সেখান থেকেই। কয়েক বছর আগে হারেস চাচা বজ্রপাতে মারা যান। স্বপ্নে হারেস চাচার আগমনে নিজাম চাচ্চু ভয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়লেন।

স্বপ্নে হারেস চাচা তাঁর রামদাতে হাত বুলাতে বুলাতে নিজাম চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেন, " কি রে নিজু, চুচু পাইছে মনি? " নিজাম চাচ্চু মাথা নাড়ান। হারেস চাচা বলেন, "কইরা দে। " নিজাম চাচ্চু 'চুচু' করে দেন। বাস্তবে তখন তিনি বিছানা ভিজিয়ে ফেলে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠেন। নিজাম চাচ্চু আসলেই পাগলের মত হয়ে গেলেন।

তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা হলেই তিনি খেকিয়ে উঠতেন। তাঁর ব্যবহার ও কথাবার্তা কর্কশ হয়ে উঠলো। এতো সমস্যার মধ্যেও তিনি নিয়মিত ক্লাসে যান। একদিন সকালে তিনি তাঁর ঘুম না হওয়া ফোলা লাল চোখ আর উদ্রান্ত চেহারা নিয়ে ক্লাসে যাচ্ছিলেন। রাস্তার পাশে বুলেট ভাই আর তার ছোটো ভাইয়েরা বসে ফুসকা খাচ্ছিলো।

নিজাম চাচ্চুকে দেখে কেউ একজন বলে উঠলো, "ওই দ্যাখ দ্যাখ! মুরগি যায়। " আর একজন বললো " মুরগি নাকি পাগল হইয়া গ্যাছে!" তাল মিলিয়ে আর একজন বললো "অই পাগলা মুরগী, যা যা পাবনা যা। এখানে থাকস কান?" নিজাম চাচ্চু কিছু বললেন না। চুপচাপ শুনলেন। ওদের মনোযোগ হঠাৎ অন্যদিকে মোড় নিলো।

কারন রাস্তায় দুটো মেয়ে দেখা গেছে। মৃত পশুর দেহবশেষ দেখে হায়েনা যেমন আনন্দিত হয়, তারাও তেমনি আনন্দিত হলো। বুলেট ভাই বললেন, "অই কারা যায় রে এমন __ দোলাইয়া। " মেয়ে দুটো শুনেও শুনলো না। "ওই কানের ভিতর __ ভরে রাখছস নাকি ?" এরপর আরো অনেক অশ্লীল কথার তুবড়ি ছুটতে লাগলো।

মেয়েগুলো চলে যেতে লাগলো। রেগেমেগে বুলেট ভাই আরও মারাত্মক একটা অশ্লীল গালি দিয়ে উঠলো। একটা মেয়ে পিছন ফিরে বুলেট ভাইয়ের দিকে তাকালো। নিজাম চাচ্চু সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা দেখলেন- নিখাদ ঘৃণা। মেয়েটার দৃষ্টি বুলেট ভাই থেকে নিজাম চাচ্চুর দিকে পৌছালো।

নিজাম চাচ্চু কেঁপে উঠলেন। তখন মেয়েটার দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা নয়, উপহাস ছিলো, আরও কিছু একটা ছিলো। নিজাম চাচ্চু ধরতে পারলেন না। তবে মেয়েটার দুই সেকেন্ডের চাহনিতে এমন কিছু ছিলো- নিজাম চাচ্চু আবিষ্কার করলেন তাঁর ভিতরে হারেস চাচা রামদা নিয়ে উঠে দাড়িয়েছে। তারপরই তাঁর মনে হলো সে নিজেই হারেস চাচা।

তাঁর হাতে একটা লম্বা রামদা, যার এক কোপে তিনি কারো মাথা কেটে ফেলতে পারেন। প্রচুর রাগ, প্রচুর উত্তাপ তাঁর ঘাড়ের শিরা উপশিরায় খেলা করতে লাগলো। সে বলে উঠলো, "চোপ বদমায়েশ!" বুলেট ভাই ও তার বাহিনী হতচকিত হয়ে গেলো। মেয়ে দুটো পিছে ফিরলো। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই নিজাম চাচ্চু সামনে এগিয়ে গিয়ে বুলেট ভাইয়ের মুখে সজোরে থাপ্পড় মারলো।

থাপ্পড়ে বুলেট ভাই মাটিতে পড়ে গেলো। থাপ্পড়ের শব্দে গাছের উপরে বসে থাকা দুটো কাক উড়ে গেলো। দূরে ল্যাম্পপোস্টের উপর গিয়ে বসে ডেকে উঠলো, "কা কা কা"। এতক্ষনে বুলেট ভাইয়ের ছোটো ভাইয়েরা সম্বিত ফিরে পেলো। 'বড় ভাই' এর গায়ে হাত তোলার প্রতিশোধ নিতে তারা নিজাম চাচ্চুর উপড় ঝাপিয়ে পরলো।

নিজাম চাচ্চুকে প্রচুর মারা হলো। হাতের কাছে লাঠিসোটা যা পেলো ওরা তাই দিয়ে পেটালো। নিজাম চাচ্চু জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তারপরও তাকে উপুর্যুপুরি পেটানো হলো। আমি ক্লাসে না গিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম।

মোবাইলে সংবাদ পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি বুলেট বাহিনী চলে গেছে। নিজাম চাচ্চুর সারা গায়ে রক্ত। আমি নিজাম চাচ্চুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার বললেন, "অবস্থা খারাপ। আল্লাহ আল্লাহ করেন।

সবই তাঁর ইচ্ছা। " আমার ভয় হতে লাগলো, নিজাম চাচ্চু হয়তো মারা যাবেন। সংবাদপত্রে ব্যাপারটা এলো। 'ইভটিজিং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মেধাবী ছাত্র গুরুতর আহত' শিরোনামের সংবাদ পাবলিক লুফে নিলো। ব্লগে লেখলেখি হলো অনেক।

সবাই এই ঘৃণ্য অপরাধের বিচার চায়। ওদিকে বুলেট ভাই যে নিজাম চাচ্চুর এক থাপ্পড় খেয়ে পড়ে গেল, তারপর থেকে আর সে কথা বলতে পারেনা। ডাক্তার কোনো অসুবিধা ধরতে না পেরে শেষে বলে দিলো এটা মানসিক সমস্যা। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও বুলেট ভাই কথা বলতে পারলো না। পেপারে এলো 'যুবকের থাপ্পড়ে ইভটিজার বোবা!' পত্রিকা অফিসগুলো নিজাম চাচ্চুকে হিরো বানিয়ে দিলো।

বুলেট ভাইয়েরা ঠিকই আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে বেড়িয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে বুলেট ভাই আর কথা বলতে পারেনি। তিনদিন পরের একরাতে নিজাম চাচ্চুর জ্ঞান ফিরে এলো। তিনি পানি খেতে চাইলেন।

তিনটা ভাঙ্গা পাজর, ভাঙ্গা হাত, ভাঙ্গা পা আর শরীরে অসংখ্য সেলাই নিয়েও নিজাম চাচ্চু টিকে গেলেন। তবে ডাক্তার বলে দিলেন তিনমাস বিছানায় থাকতে হবে। নিজাম চাচ্চু শুধুই ঘুমান। কথা বলেন না। প্রায় এক সপ্তাহ পর তিনি আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন।

হাসপাতালে ইদানিং অনেক ভীড়- সবাই নিজাম চাচ্চুকে দেখতে আসেন। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাই বেশী। মেয়েদের সাথে করে নিয়ে তাদের অভিভাবকেরাও এসেছেন। ডাক্তার তেমন কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেন না। মজার ব্যাপার এদের কেউই নিজাম চাচ্চুর পূর্বপরিচিত নয়।

আমি ভীড় টপকে ভিতরে ঢুকলাম। দেখি নিজাম চাচ্চুর সারাগায়ে ব্যান্ডেজ। তবে নিজাম চাচ্চুর গলার উপরে ব্যান্ডেজ নেই। সেখানে একজন সুখী মানুষের মুখ দেখলাম। তাঁকে দেখে বুঝলাম কোনো কারনে সে খুব খুশি।

কিছুক্ষন কথা বলার পর নিজাম চাচ্চুকে বললাম, "চাচ্চু এই ঝামেলায় না জড়ালেও পারতে। তোমার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছো! আর একটু হলে মারা পড়তে। " নিজাম চাচ্চু বললেন, "কে বলেছে আমার অবস্থা খারাপ! আমি অনেক ভালো আছিরে। জানিস, আমি আর এখন কোনো দুঃস্বপ্ন দেখিনা। আমার এখন ঘুম হয়।

" আমি মনে মনে ভাবলাম, আসলেই নিজাম চাচ্চু আর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখবেন না। গল্পের কাহিনীর সকল চরিত্র, স্থান ও ঘটনা আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। বানান ও ব্যাকরণে ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। -- লেখক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।