‘আকাশ চ্যানেল থেকে সবাইকে জানাই আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালবাসা। ’ মেয়েটি বলে, ‘ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী টকশো’তে আজ যাকে আপনারা দেখবেন, যার কথায় আমরা ধন্য হবো, আজকে যিনি আমাদের অতিথি, তিনি হচ্ছেন... তিনি হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব; একই সাথে যিনি কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সমালোচক, এবং... এবং দার্শনিক; তিনি আর কেউ নন, আমাদেরই অতি প্রিয়, অতি পরিচিত মুখ, সনামধন্য, বিখ্যাত ও প্রখ্যাত ব্যক্তি ড. অধ্যাপক ছদের উদ্দিন মোহম্মদ ভূঁইয়া। ’
আমার বেশ ভাল লাগে যে মেয়েটি ইংলিশের মত বাংলা উচ্চারণ করে; নিজ-ভাষার উন্নতি দেখতে কার না ভাল লাগে? আমি সেকেলে হয়ে পড়ে থাকতে চাই না; তাছাড়া, আমরা জানি ভাষা প্রবাহমান; কারো ভাল লাগা, না-লাগায় কিছু যায়-আসে না। মেয়েটিকেও আমার ভাল লাগে, পরীর মত এই মেয়েটিকে দেখতে আমার ভাল লাগে। যা কিছু ভাল ও সুন্দর আমার ভাল লাগে।
মেয়েটি ছদের উদ্দিন মোহম্মদ ভূঁইয়ার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি মাথা ঝাঁকালেন, এবং মুখটি কেমন যেন করলেন; ছেলেবেলায় আমরা যেমন ভেংচি কাটতাম, অনেকটা সে-রকম; কিন্তু আমি ধরে নিলাম যে তিনি ভেংচি কাটেন নি, তিনি ভেংচি কাটতে পারেন না, তিনি হেসেছেন।
‘স্যার, সামনেই একুশের বইমেলা; এবারের বইমেলায় আপনার কয়টি বই বের হবে?’ মেয়েটি তার সুন্দর হাসিটি অটুট রেখে উদ্দিন মোহম্মদকে প্রশ্নটি করে।
‘বেশি না, গোটা বিশেক। ’ উদ্দিন মোহম্মদ আস্তে আস্তে বলেন, ‘১২টা কবিতা’র, ২টা রান্না’র, ৩টা ভূতে’র, ১টা রূপচর্চা’র, ১টা আদব-কায়দার সহজ পাঠ, ১টা হালাল ও হারাম বিষয়ক শিক্ষা।
’
‘স্যার, ভূতের বই সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার ভূতের বই নিয়ে পাঠক মহলে কৌতূহলের শেষ নেই। ’
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছদের উদ্দিন মোহম্মদ ভূঁইয়ার দু’চোখ, তিনি বলেন, ‘ভূতের বই তো হচ্ছে... দেখো, ভূতের বই হচ্ছে... ভূতের বই হলো আসলে ভূতের বই। ভেবে দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে ভূতের বই কখনো রান্নার বই নয়, ভূতের বই কখনো কবিতার নয়, ভূতের বই কখনো রূপচর্চার বই নয়...’
‘আচ্ছা! স্যার!’ মেয়েটি লাফিয়ে ওঠে, শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলে, ‘স্যার! রূপচর্চার বইটি সম্পর্কে আপনার কী মত?’
‘রূপচর্চার বইটি হবে একটি শ্রেষ্ঠ বই; দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ বইয়ের একটি হবে আমার এই রূপচর্চার বইটি। বিউটি পার্লারে গিয়ে কারো আর রূপচর্চার দরকার হবে না, ঘরে বসেই এবং নিজে নিজেই মনের মত করে রূপচর্চা করতে পারবে, আর এর ফলে আমাদের সোনার ছেলেরা মনের মত বউ পাবে। এই বইটি বাংলা সাহিত্যের আকাশে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে; অনেক ঘাটাঘাটি ও সাধনার পর বইটি লেখা হয়েছে, গবেষণাধর্মী একটি বই।
’
‘নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? এ-ব্যাপারে আপনার কোনো তত্ত্ব আছে?’
‘নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে একটা ইয়ে, একে আমারা যতই কচলাই না কেনো... ঐ যে ইয়ে... এর ভেতর থেকে যা বের হয়, এটা হলো... জিনিসটা হলো একধরনের ইয়ে... বুঝলে না... তার নাম আর কী... ইয়ে রস...’
উদ্দিন মোহম্মদের কথা, আমি জানি না, কেনো আমার ভাল লাগে না; তাঁকে কেনো জানি স্টুপিড বলে মনে হয়, স্টুপিড ও গাধাদের আমি দু-চোখে দেখতে পারি না; কিন্তু তাঁকে স্টুপিড বলে সন্দেহ আমি করি না; আমি গুডবয়, সন্দেহ-টন্দেহ করার মত ব্যাডবয় আমি নই।
মেয়েটি যখন কথা বলে আমার ভাল লাগে; মেয়েটির কথায় আমার হৃৎপিণ্ড দুলে উঠে, আমিও চাই যে দুলে উঠুক, হৃৎপিণ্ড দুলে উঠলে আমার ভাল লাগে; মেয়েটির আঁচলের বাঁধন ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া সুউচ্চ স্তন যুগল দেখতে যেমন ভাল লাগে। কবিতার কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না; ভাল না লাগলে জোড় করে আমি ভাল লাগাতে পারি না, এটি স্বাস্থ্যকর নয়, আর যা কিছু স্বাস্থ্যকর নয় মানুষ হিসেবে তা এড়িয়ে যাওয়ার অধিকার আমার আছে।
মেয়েটিকে দেখতে আমার ভাল লাগে, কবে বৃহস্পতিবার আসবে? কবে তাকে আবার দেখতে পাবো? মেয়েটিকে দেখার জন্যে আমি পাগল হয়ে থাকি, মেয়েটির জন্যে পাগল হতে আমার ভাল লাগে। প্রতিটি দিন, দিনের প্রতিটি ক্ষণ আমি প্রতীক্ষায় থাকি কবে বৃহস্পতিবার আসবে, আর মেয়েটি একজন অতিথি নিয়ে টিভির পর্দায় হাজির হবে; মেয়েটির জন্যে প্রতীক্ষিত প্রতিটি ক্ষণ আমার ভাল লাগে।
মেয়েটি যখন উদ্দিন মোহম্মদ ভূঁইয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় এটি আমার ভাল লাগে না; মনে হয় আমার বুকে কে যেন একটা ধারাল ছুরি বসিয়ে দিয়েছে, আমার বুকে ধারাল ছুরি বিঁধলে আমার ভাল লাগতে পারে না। ইচ্ছে হয় উদ্দিন মোহম্মদকে একটা লাথি মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দিই; কিন্তু নিজেকে আবার সামলে নিই, এমন ভাবনার জন্যে নিজে নিজেই লজ্জা পাই। আমি জানি, তিনি সন্মানিত এবং পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি; আমার এই ভাবনা বড়ই অন্যায়, এই অন্যায়ের জন্যে আমাকে ফাঁসি দেয়া হলেও সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থন করার কিছু থাকবে না।
‘স্যার, রমিজ আহমেদ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?’
‘আমি তাঁর অন্ধকার গুহায় বসবাস উপন্যাসটি পড়েছি, কী যে লিখেছে! পড়তে কষ্ট হয়েছে, পড়ার সময় কষ্টকর মনে হওয়া অনুভূতি সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না; তারচে’ সিনেমা দেখা ভাল, আমি কষ্টকর অনুভূতি পেতে চাই না, আমি আনন্দ পেতে চাই। উপন্যাসটির চরিত্ররা জীবনকে এনজয় করতে পারে না; এই দিন, এই রাত তাদের ভাল লাগে না, তারা এই দিন ও রাত পরিবর্তন করতে চায়, বিপ্লব ঘটাতে চায়; কিন্তু এটি হতে পারে না, আমরা জানি আজ যেটা নতুন, কাল সেটাই পুরানো।
উপন্যাস হলো আনন্দ ও ফুর্তির বিষয়, শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লব আসতে পারে না; এর মাধ্যমে তিনি আসলে পাঠকের মনে সুড়সুড়ি দিতে চেয়েছেন। ’
‘শিল্পা শেঠির নাভি সম্পর্কে লেখা আপনার প্রবন্ধটি পড়ে রমিজ আহমেদ বলেছিলেন যে, আপনি পাঠকের মনে সুড়সুড়ি দিতে প্রবন্ধটি লিখেছেন; এ-বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
‘রমিজ আহমেদ তো হচ্ছে একটা ভেড়া, তিনি সৌন্দর্যের কী বোঝেন!’
‘শিল্পা শেঠির ঠোঁট সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন? অনেকেই তার ঠোঁটকে কমলা লেবুর কোয়ার সঙ্গে তুলনা করেন, এই বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?’
উদ্দিন মোহম্মদ একবার ঢোক গিললেন মনে হলো, এবং মুখের গাম্ভীর্য-ভাব আরো বেড়ে গেলো। ‘আসলে, শোনো,’ নড়েচড়ে বসে, কপাল ভাঁজ করে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘শিল্পা শেঠির ঠোঁট সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় তার গ্লামারের কথা, আর এটি হলো আসলে মেধা ও মননের ব্যাপার; আমাদের মা-বোনেরা যদি মেধা ও মননের মাধ্যমে তাদের রূপ-লাবণ্যের চর্চা করেন তাহলে শিল্পা শেঠির মত তাদের ঠোঁটও সুমিষ্ট হবে; এবং ধীরে ধীরে তাদের হাসিও হয়ে উঠবে সুমধুর। আমাদের বুঝতে হবে প্রাণখোলা হাসি কাকে বলে, বুঝতে হবে কোনটি কৃত্রিম হাসি আর কোনটি সত্যিকারের হাসি—এই দুই হাসির মাঝে যে বিস্তর ফারাক তা বুঝতে পারলেই আমরা বুঝতে পারব সুন্দর, মিষ্টি ও কোমল হাসির স্বরূপ; আর তাতে করে হাসির ভাল ও মন্দ দিকগুলো আমাদের মাঝে জ্যোৎস্নার মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। এভাবেই আমাদেরকে আস্তে আস্তে ইমপ্র“ভ করতে হবে।
অবশ্য এখানে যে সাবান প্রস্তুত হয়, দুঃখের বিষয় তাতে এমন ভেজাল যে, তা গায়ে মেখে ফর্সা হওয়ার পরিবর্তে আমাদের মা-বোনেরা দিন দিন আরও কালো ও অদ্ভুত রকমের মোটা হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে, নয়তো এমন চলতে থাকলে আমাদের মায়েরা নিগ্রো সন্তান প্রসব করবে, এটি হলে তা হবে খুবই ভয়াবহ; কারণ নিগ্রোরা মানুষ নয়, নিগ্রোরা হচ্ছে আস্ত একটা নিগ্রো। ’
‘এই যে বললেন, আমাদের দেশে যে-সাবান প্রস্তুত হচ্ছে তা ভেজাল যুক্ত; এই সাবান গায়ে মেখে আমাদের মা-বোনেরা দিন দিন কালো ও মোটা হয়ে যাচ্ছে; এর থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?’
‘একশো পার্সেন্ট হালাল সাবান ব্যবহার করতে হবে; এ-সম্পর্কে আমার হালাল ও হারাম বিষয়ক শিক্ষা বইটিতে বিস্তারিত লেখা আছে; তাছাড়া মুখে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী মাখা যেতে পারে, এটি নারীদের জন্যে খুবই উপকারী জিনিস; যেসব মেয়েদের বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না, সে-সব বয়স্ক মেয়েরা মুখে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী মাখলে ভালো ফল পাওয়া যাবে—দ্রুত বিয়ে হবে। ’
[আগামী পর্বে শেষ হবে] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।