ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী শব্দ তিনটির সাথে প্রথম পরিচয় ধোঁয়াটে শৈশবে, গ্রাম থেকে আগত এক চাচাতো বড় বোন আমার বাবার কাছে অস্ফুট স্বরে বলেছিল এই ক্রিমটি কিনে দিতে, এটা নিয়মিত গায়ে মাখলে নাকি চামড়া ফর্সা হয়।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি নাই, সেই আপুর গায়ের রঙ কালো বা যাকে বলা হয় শ্যামলা, কিন্তু তাঁকে ক্রিম মেখে ফর্সা করতে হবে কেন? কালো হওয়া কী খারাপ? নাকি ফর্সা হলে বেশী ভাল? বেচারিকে দেখতাম প্রায়ই একগাদা কাঁচা হলুদ খেতে, তাতেও নাকি ফর্সা হওয়া যায়। আমার সেই চাচাতো বোনটি বছর কয় আগে একটি সন্তান রেখে মৃত্যু সাগরের অপর পানে চলে গিয়েছেন, গায়ের কালো বর্ণ ফর্সা করার প্রচেষ্টা কী তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল? হয়তো, হয়তো না। কিন্তু ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী” নামটা শুনলেই সেই আপার কথা সবার আগে মনের পর্দায় ঘুরে উঠে।
বিচিত্র সব বিজ্ঞাপন দেখি টেলিভিশনে, কোন তরুণীর বিয়ের জন্য বাড়ীতে দেখতে আসবে, হয়ত তাঁর চাকরির সাক্ষাৎকার, সে দুশ্চিন্তার সাগরের ভাসতে থাকে শরীরের কৃষ্ণ বর্ণ নিয়ে, পর্দায় হাজির হয় জাদুর ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী”, সেটা মাখার সাথে সাথেই মেয়েটির ত্বক হয়ে যায় বেশ উজ্জল ফর্সা! ব্যস, মেয়েটিকে পছন্দ হয় ছেলেপক্ষের, তাঁর চাকরি জোটে, জীবনে সাফল্য আসে ইত্যাদি ইত্যাদি।
খুবই স্মার্ট, বুদ্ধিমতী, উচ্চশিক্ষিত একজন তরুণীর জীবন সংগ্রামকে অবলীলায় হার মানিয়ে দিচ্ছে এই ম্যাজিক ক্রিম। আমরা বাচ্চা বেলা থেকেই জানছি, ঐ সমস্ত গুণ পরের স্তরের যোগ্যতা, আসল কথা হচ্ছে মেয়ের চামড়া সাদাটে হতেই হবে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের প্রতিভাবান গুণবতী মায়াবতী চরিত্ররা বাথরুমের আয়নায় চেহারা দেখে কাঁদে কারণ যতখানি কালো হলে বাংলাদেশের কোন মা তাঁর মেয়েকে শ্যামলা বলে সে তাঁর চেয়েও বেশী কালো, এইটাই তাঁর জীবনের প্রধান দুঃখ! এই জন্যই কী প্রায় একশ ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠানেই বধূদের শরীরে বিশেষ করে মুখমণ্ডল আর হাতে পুরু মেকাপের প্রলেপ লাগিয়ে অবিশ্বাস্য ধরনের সাদাটে করা হয়? সেই সাথে এখন যোগ হয়েছে বিয়ের দিনে ছবি তোলার চল, যেখানে ঘষে মেজে সুপার এডিটিং করে মেয়েটিকে করা হয় ফর্সা থেকে ফর্সাতর। আচ্ছা, আমাদের একটি বারও কি মনে হয় না যে এই সমস্ত আচরণের মাধ্যমে আমরা কী পরিমাণ নিচে নামাচ্ছি সেই মানুষটাকে। বিয়ের মণ্ডপে কিম্ভূত মেকাপে থাকা একজন সফল তরুণী কি বারংবার তাকিয়ে আমাদের সমাজের এই সংকীর্ণতাকে ধিক্কার দেন না তাঁকে সঙ সাজাবার চেষ্টা করার জন্য?
কদিন আগে এক বিজ্ঞাপনে দেখি সরাসরি বলা হচ্ছে, সুন্দর মানেই ফর্সা গায়ের রঙ, আর তাঁর জন্যই চাই ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী” ! সুন্দর-অসুন্দরের সংজ্ঞা বিশ্বের সব অঞ্চলেই আপেক্ষিক, সত্যিকারের নিগ্রোরা তাদের তেল চকচকে দ্যুতিময় কৃষ্ণবর্ণের চামড়ার জন্য যথেষ্টই অহং বোধ করে , বরং শ্বেতাঙ্গদের ফ্যাকাশে চামড়ার দিকে তারা কিছুটা করুণার দৃষ্টিতেই তাকায়।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানুষ, যারা সবচেয়ে বেশী সাদা হয় তাদের আবার প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে রোদে পুড়ে চামড়া ট্যান করে তামাটে বর্ণের করার। সেখান দেখেছি ট্যান করার জন্য নানা ধরনের ক্রিম আছে সূর্য স্নানের সময় ব্যবহার করার জন্য, Solarium নামের কৃত্রিম যন্ত্রও আছে। তাঁর মনে কী ধরে নিব যে চামড়া ফর্সাকারী ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী” আর ট্যান করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন একই স্তরের?
আসলে নয়, কোন ভাবেই নয়। ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী” বা এই ধরনের প্রসাধনীর প্রতিটি বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা হয় তোমার যত গুণই থাক, এমনকি তুমি যতই সুদর্শন, মায়াবী, রূপসী যাই-ই হও, ফর্সা না হলে তোমার জীবন বৃথা, অতএব বাজার থেকে নিয়ে এস ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী”। আর হ্যাঁ, সেই সাথে মনে রেখে মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেললে, পর্বতারোহণ শুরু করলে, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ালে তুমি কালো হয়ে যাবে, তোমাকে পছন্দ করবে না কেউই !
এটা কী নারীত্বের অবমাননা নয়? মানবতার অবমাননা নয়?
আবার আয়নার অপর পিঠের মত চাহিদার বিপরীত দিকও আছে।
কদিন আগেই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি বাংলাদেশের এক প্রথিতযশা হাসপাতালের তরুণী ডাক্তার বললেন, ”আমার সমস্যা কী জান? সেটা হচ্ছে আমি একজন মেয়ে এবং আমার চামড়া সাদা। অন্য সবার কথা বাদ দিলাম যে রোগীদের বাঁচিয়ে তুলতে প্রাণপাত করছি তারাও অনেকেই বিভিন্ন রসালো ইঙ্গিত দিয়ে misbehave করে সময়ে সময়ে ”। ফর্সা মেয়েদেরই সাধারণত সবচেয়ে বেশী উৎপাতের শিকার হতে হয় রাস্তা-স্কুল- কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু সেই বিশ্লেষণ, সামাজিক কারণ আমরা অন্যদিন অনুসন্ধান করব।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই বর্তমান যুগেও নারীকে বিশেষ প্যাকেটজাত পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের যে বহুবিধ কায়দা আছে তাঁর মধ্যে অন্যতম এই গায়ের রঙ সাদা করার মন্ত্র জপতে থাকা ”ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী” বা এই ধরনের প্রসাধনী নিয়ে, তা আমরা আর কতকাল অব্যাহত রাখতে দিব? কতকাল এইভাবে আমাদের নিজেদের ছোট করে অপমান করেই যাব ?এবং অন্যদের গ্লানির মধ্যে রাখব?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।