© এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের। তাই লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ব্যবহার না করার অনুরোধ রইল...
প্রথম পর্ব এখানে
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আমি হুড তুলে দিলাম। রিকশা ওয়ালার কাছে প্লাস্টিক নেই। সুর্মিপু চুপ করে কিছু একটা ভাবছে সম্ভবত।
সুর্মিপু...!
হুমমম...!
কাল তুমি কি এই নীল জামা আর নীল জুতো পরবে?
হ্যাঁ! ক্যান তোর কোন আপত্তি আছে?
নাহ্। আপত্তি থাকবে ক্যান?
তাহলে?
না এমনি।
এমনি তো না, আসল কথা বল। মতলব কি তোর?
আমতা আমতা করে বললাম, তুমি শাড়ি পরোনা? শাড়ীতে তোমাকে সুন্দর লাগে।
তাই নাকি? তুই আমাকে শাড়ী পরা দেখলি ক্যামনে?
দীনাপুর বিয়েতে।
ঐ মিথ্যে বলিস ক্যান? দীনাপুর বিয়ের সময় তোর এক্সাম ছিল। তুই আসিস নাই। কখন দেখলি শাড়ী পরা?
আমি কি বলছি নাকি যে আমি শাড়ী পরা দেখেছি?
তাহলে?
শাড়ী পরা ছবি দেখছি।
তাই নাকি চাঁন্দু? তা কেমন দেখলি?
অনেক সুন্দর! ভয়ানক সুন্দর!!
সুন্দর আবার ভয়ানক হয় নাকি? জানতাম নাতো!!
তাইতো, সুর্মি আপু তো ঠিকই বলেছে। সুন্দর কিভাবে ভয়ানক হয়? তাহলে মানুষ ভয়ানক সুন্দর কেন বলে কে জানে!!
এ্যাই জিসান!
হুমমম... শুধু সুন্দর লাগছে? হট লাগে নাই?
মানে কি??
হট মানে হট্।
বুঝিস নাই?
উহু!!
তুই আসলে গাধাই রয়ে গেলি রে!!
হুমমম.. হতে পারে।
হতে পারে না, তুই হচ্ছিস মহা গাধা। শুধু মহা গাধা না, আন্তর্জাতিক মানের মহা বিরাট গাধা। আই.এস.ও ৯০০১ সার্টিফাইড!!
সুর্মিপু যে কখন কী বলে এক ভগবান ছাড়া কেউ জানেনা। মুখে যা আসে তাই বলে।
কথা বাড়িয়ে লাভ হবেনা। কখন কী করে বসবে কে জানে!!
কিছুদূর যেতে না যেতেই বিড়াল-কুকুর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পায়ের দিকটা পুরোপুরি ভিজে গেছে। সুর্মী আপু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছেন। আমার হঠাৎ করেই কেন জানি ইচ্ছে হলো হাত দিয়ে তার হাতটি ছুয়ে দিই।
কথাটা ভাবতেই মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করলেই তার বাড়িয়ে দেয়া হাতটি আমি ছুঁয়ে দিতে পারি, কিন্তু ছোঁয়া যাবেনা। কেন যাবেনা? এই সহজ ছোট্ট ইচ্ছেটা আমি কেন পূরণ করতে পারবো না?
দেখছিস কী সুন্দর বৃষ্টি।
সুন্দর না ছাই। আমার জ্বর উঠে যাবে নিশ্চিত।
উলে উলে বাবা লে, তোমার জ্বর উঠবে?? ঐ ব্যাটা তুই এত ননীর পুতুল হইছিস ক্যান? একটু পানি লাগলে, একটু ধুলি-বালি লাগলে তোর জ্বর উঠে ক্যান, হ্যাঁ?
আমার সাইনোসাইটিস প্রবলেম আছে। আছে তীব্র মাত্রার ডাস্ট-এ্যালার্জি। বৃষ্টি, ধুলোবালি একদম সহ্য করতে পারিনা। আমি কিছু না বলে সুর্মি আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। ওনার বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে জ্বর উঠা বিরাট অপরাধ।
শুধু বিরাট না, মহা বিরাট অপরাধ! আইএসও ৯০০১ সার্টিফাইড মানের অপরাধ!
জিসান, বৃষ্টিতে ভিজবি?
সুর্মি আপুর প্রস্তাব শুনে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজলে আর উপায় নেই, নির্ঘাত ১০৪ ডিগ্রী জ্বর, তারপর বমি-টমি করে বিশ্রী অবস্থা।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে উপায় আছে আমার? তুমি জানোনা আমার একটুতেই ঠান্ডা লাগে?
উমমমমমমমম... ঢং দেখো ওনার!! বেশি কথা বললে কিন্তু ঐ যে, রিকশার পেছনের বাম্পারে দাঁড়া করায়ে দিবোনে... তখন বুঝবি নবাবি। নবাবজাদা হইছো? আজ তোর নবাবি আমি ছুটাচ্ছি দাঁড়া...
কথা শেষ না করেই সুর্মি আপু রিকশার হুড ফেলে দিলেন। আমি অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলাম।
কিছু করার নাই। কথা বাড়ালে রিকশা থেকে নামিয়েও দিতে পারেন উনি।
কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে জ্বরের জন্য আর অপেক্ষা করতে হয়নি, সুবোধ বালকের মত রুটিন অনুযায়ী জ্বর চলে এসেছে। মাথা গুলিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বমি হবে নিশ্চিত।
মেজ ফুফুর বকা খেয়ে সুর্মি আপু নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। সুর্মি আপুকে বাগে না পেয়ে ফুফি আমাকেই কতক্ষণ ঝাড়লেন। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়েও গেলাম আমি।
ঘুম ভাঙলো পরদিন দুপুরে। চোখ মেলে দেখি আম্মু বিছানায় বসে আছেন।
আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। পাশেই সুর্মি আপু।
স্যরি জিসান। আমি বুঝি নাই তোর সত্যি সত্যি জ্বর চলে আসবে, রাগ করিস না ভাই।
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে আছি সুর্মি আপুর দিকে।
আজ ঈদ। অথচ উনি নতুন জামা-কাপড় পরেন নাই।
পাশের ঘর থেকে আব্বুর কথা শোনা যাচ্ছে। নিশ্চই জ্বরের কথা শুনে আব্বু-আম্মু দু’জনই চলে এসেছেন গাজীপুর থেকে। আম্মুকে দেখে আমার জ্বর অর্ধেক ভাল হয়ে গেছে।
এখন কেমন লাগছে বাবা?
ভাল। তোমরা কখন এসেছো?
একটু আগে।
এখন উঠ্, ঈদের নামায তো পড়িস নাই। উঠে ফ্রেশ হয়ে কিছু খাবি চল।
ফ্রেশ হয়ে রেডি হলাম।
পান্জাবীটা একটু বড় হয়ে গেছে। আর সব ঠিক আছে। গায়ে এখনো জ্বর আছে। সুর্মি আপুর ঘরের দরজা বন্ধ। নক করতেই প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি আপু...
এক মিনিট।
এক মিনিটের কথা বলে সুর্মী আপু দরজা খুললেন কয়েক মিনিট পরে। চোখ-মুখ ফোলা। তার মানে এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কান্ন করেছে। গায়ে এখনো পুরোনো কাপড়। মেয়েদের এই এক স্বভাব।
ছোট মেয়ে বুড়ি মেয়ে, সব ফ্যাঁচ কাঁদুনে। ফুফি নিশ্চই বকা দিয়েছে আমাকে ভেজানোর জন্য। এজন্যই এত ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ।
আমি কিছু না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নীল জামা আর নীল জুতো কই?
আমার কথা সুর্মিপু শব্দ করে হেসে উঠলেন, আছে। ক্যান?
পরবা না? চলো বেড়াতে যাই।
সত্যি? বাইরে যাবি?
হুমমম... যাবো। কই নিয়া যাবা? আজকে আবার ভেজাবা নাতো? আমার গায়ে কিন্তু এখনো জ্বর।
ছিঃ! আর ভেজাবো না। আমি সত্যিই অনেক স্যরি রে। আমি বুঝি নাই যে তোর জ্বর উঠে যাবে।
হইছে, আর স্যরি বলতে হবেনা। রেডি হও। সবাই তোমার জন্য ওয়েট করতেছে।
তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, আমি ৩০ মিনিটের মধ্যে রেডি হচ্ছি। সাভার যাবো, বড় আপুর বাসায়।
আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিলে, সাথে একটা চোখ টিপ!! আল্লাহ্ই জানে মনে আবার কোন কুমতলব!
আধা ঘন্টার কথা বলে সুর্মিপু রেডি হয়ে বের হলেন সোয়া এক ঘন্টা পর। মেয়েরা জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় ব্যয় করে সাজুগুজুর পেছনে, কোন সন্দেহ নাই। হঠাৎ করেই খেয়াল হলো, নীল জামা আর নীল জুতো না, সুর্মি আপু কালো রঙ্গের শাড়ী পরে আছেন, সংগে ম্যাচ করা কালো জুতো। অসম্ভব সুন্দর লাগছে সুর্মিপুকে। ভয়ানক সুন্দর কী একেই বলে মানুষ? কে জানে!!
সব সুন্দরের মাঝেই লুকানো থাকে নির্লিপ্ত বিষন্নতা।
জ্যোছনা সুন্দর, অথচ গৃহত্যাগী জ্যোছনা মানুষকে ডুবিয়ে দেয় বিষন্নতার সাগরে। অসীম নীলাকাশের নিচে দাঁড়ালে নিজেকে উদ্দেশ্যহীন, পথহারা পথিক মনে হয়। সাগরের নীল জলের সামনে যতবারই দাঁড়িয়েছি, তুচ্ছ আর ভীষণ রকম একাকীত্ব আচ্ছন্ন করেছে আমায়। সুর্মিপুর কথা ভেবে হঠাৎ করেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অদ্ভূত সুন্দর এই মানুষটাকে খুব কাছে থেকেও যেন যোজন যোজন দূরের কেউ, যে দূরত্ব হয়তো কোনদিনই অতিক্রম করতে পারবোনা আমি!!
দুপুরে খেয়ে আমরা সাভারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
পুরো রাস্তা ফাঁকা। হাওয়ার বেগে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। গাড়ীতে সুর্মিপুর পাশে বসে আমার একটু একটু লজ্জা লাগছে। আমি মহা বিরাট গাধা হলেও এটুকু বুঝতে পেরেছি, নীল জামা না পরে কালো শাড়ী পরেছেন আমার কালকের কথায়।
বিষয়টা মনে হবার পর থেকেই আর ওনার দিকে তাকাতে পারছিনা। বিরাট লজ্জার কথা। তার উপর একটু পর পর সুর্মিপু কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছেন, লজ্জায় আমি কুকড়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ।
কিরে চুপ করে আছিস ক্যান? অন্য সময় তো তোর বকবকানির জ্বালায় টেকাই যায় না!
সুর্মিপুর কথা শুনে আমি কিছুটা শংকিত। এই ঈদের দিন মেজাজ ফর্টি নাইন হয়ে আছে কেন কে জানে!! মতিগতি খুব বেশি সুবিধার ঠেকছে না।
কাল রাতের মত পাগলামি শুরু করলে আজকে নিশ্চিত কান্না করে দেব। আমি অসহায় দৃষ্টিতে সুর্মি আপুর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছি।
কি ভেবে যেন একটু পরেই বললেন, কিরে ভয় পাচ্ছিস?
আচ্ছা তুমি আমাকে এত জ্বালাও ক্যান সুর্মিপু?
উমমমম... আমার ইচ্ছা। খুব ভাল লাগে তোকে জ্বালাতে। ক্যান তোর কি খুব রাগ উঠে নাকি? খুব খারাপ লাগে?
না তা না!
তা না তো কি?
কিছু না।
সুর্মি আপু কথা না বাড়িয়ে জানালায় চোখ রেখে বাইরে তাকিয়ে আছেন। বাতাসে চুল উড়ছে। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে চুল থেকে। ভীষন সুন্দর। অদ্ভূত সুন্দর।
কোলের উপর রাখা সুর্মিপুর মেহেদী রাঙ্গানো হাত। উফফফ!!! অসহ্য সুন্দর। মনে আছে, আমি যখন খুব ছোট, সুর্মিপু তখন স্কুলে পড়ে। ড্রইং করার সময় আমি জল রং, রং পেন্সিল সব এলোমেলো করে দিতাম। সুর্মিপু তখন বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতো, এই হাতটা ধরে চুপ করে বসে থাকবি।
একবার যদি হাত ছাড়িস তাহলে রুম থেকে বের করে দেব। আমি দুই হাত দিয়ে সুর্মিপুর বাম হাত ধরে বসে থাকতাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবারো রং পেন্সিল, জল রঙ্গের কৌটা ধরতাম। সুর্মিপু চোখ রাঙ্গানি দিয়েই খিল খিল করে হেসে উঠতো। আহা, দুষ্টুমির শাস্তি হিসেবে ছোট বেলায় নিতান্ত অনিচ্ছায় কত্তোবার এই হাত ধরে বসে থেকেছি, আজ আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে সুর্মিপুর হাতটি একটুখানি ছুঁয়ে দিতে, কিন্তু পারছিনা!
বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই সুর্মিপু বললেন, কিরে কি দেখিস?
ওনার বলার ধরণ দেখে আমি চমকে উঠলাম।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি বুঝলেন কিভাবে? কিছু না বলে আমি চুপ করে রইলাম।
তুই কি জানিস, মেয়েদের তৃতীয় নয়ন বলে একটা জিনিস আছে। সেটা দিয়ে তারা অনেক দূরের, অপার্থিব অনেক কিছু দেখতে পায়?
না জানি না, কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললাম আমি।
তুই মনে মনে কি বলছিস সেটাও আমি বলে দিতে পারি, বলবো?
বলো!!
জানালায় চোখ রেখেই তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন।
মানে কি? আমার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
মানে কিছুই না, চুপ করে আমার হাত ধরে বসে থাক, হাত ছাড়লেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেব।
আমি অপার বিস্ময় আর সীমাহীন ভাললাগা নিয়ে দু’হাতে সুর্মিপুর বাম হাত ধরে বসে থাকলাম। আমার মাথা গুলিয়ে আসছে, জ্বরটা মনে হয় বাড়ছে, বমি হতে পারে। একটা কথাই শুধু বারবার মনে হতে লাগলো, সুর্মিপু, তুমি বললে এই হাত আমি অনন্তকাল ধরে বসে থাকতে পারি। একটি মুহূর্তের জন্যও ছাড়বো না, একটি বারের জন্যও ছাড়বো না।
বাকিটা পথ আমরা কেউই আর কোন কথা বললাম না।
বড় আপুর বাড়ীটা খুব সুন্দর। একতলা লাল রঙ্গের সিরামিক ইটের বাড়ি, ছাদে টেরাকোটা ব্লক বসানো। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী দুলাভাই খুবই সৌখিন মানুষ, পুরো বাড়ি জুড়ে সৌখিনতার ছাপ। বিশাল উঠোনের একপাশে দোলনা।
বাড়ির শেষ মাথায় শান বাঁধানো ছোট্ট পুকুর, পুকুরের চার পাশও পাকা করা। এই আপুটা সুর্মিপুর থেকে একদম আলাদা। সুর্মি আপু খুবই পাজী টাইপ, সারাক্ষণ চারপাশের সবাইকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে ব্যস্ত। আর বড় আপু একদম সাদা-সিধে আর ভীষণ রকম মায়াবতী। বড় আপুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দেড় বছর বয়সী জমজ মেয়ে দু’টো আর স্বামী-সংসার নিয়ে তার সুখের সীমা নাই।
সুখী মানুষের কাছাকাছি থাকলে এক ধরণের ভাল লাগা কাজ করে, আমারও খুব বেশি ভাল লাগছে এখন।
অনেকদিন পর আমাকে দেখে বড় আপু ভীষণ খুশি হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। একটু পরপরই নানা ধরণের খাবার নিয়ে হাজির হচ্ছেন। কারণে অকারণে হাসছেন। সুর্মিপু জমজ ভাগ্নিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
আশে পাশে তাকে আর দেখা যাচ্ছেনা। বড় আপুর কথা বলা রোগ ছিল, এই রোগ এখনো সারেনি বোঝা যাচ্ছে। বরং মনে হচ্ছে বিয়ের পর খানিকটা বেড়ে গেছে। শুটকি মাছ থেকে হিন্দি সিরিয়াল কাহানি ঘর ঘর কি পর্যন্ত কোন কিছুই বাদ যাচ্ছেনা আলোচনা থেকে। সে এক মধুর যন্ত্রণা।
নতুন কিছু একটা রান্না করার জন্য আপু কিচেনে চলে গেছেন, এই যাত্রায় বাঁচা গেল।
খানিক বাদেই সুর্মিপু কোত্থেকে যেন উদয় হলেন, হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন পুকুর পাড়ে। চোখমুখ শুকনো। মতিগতি বুঝতে পারছিনা কিছু।
কিরে একা একা খারাপ লাগছিল?
নাহ্।
কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
পাশের বাসায়। রুনু নামে একটা মেয়ে আছে, পাশের বাড়ি থাকে। আমার সংগে ভালই খাতির, ওর সংগে দেখা করে এলাম।
হুমমম...।
অনেক্ষণ চুপ থেকে সুর্মিপু আবার বলা শুরু করলেন, জিসান শোন, তোকে কিছু কথা বলার জন্য আমি প্ল্যান করেই নিয়ে এসেছি আমার সংগে।
আমি নিজেও অনেক দ্বিধান্বিত ছিলাম কথাগুলো তোকে কিভাবে বলবো এটা ভেবে, বাট উপায় নেই। বলা দরকার। আমি এখন যে কথাগুলো বলবো, তুই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবি। ওকে?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাঁড়লাম। নিশ্চিত হতে পারছিনা এত সিরিয়াসলি সুর্মিপু কী বলতে পারেন।
তাকে এতটা সিরিয়াস আমি দেখিনি কখনো। উনি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনাকে দ্বিধান্বিত মনে হচ্ছে, কিছুটা এলোমেলো।
জিসান!! আমি জানি, আমি খুব ভাল করেই জানি তুই আমাকে অনেক পছন্দ করিস। হ্যাঁ, এটা দোষের কিছু না।
কৈশোরের এই বয়সটাই ভাল লাগার। এই সময়টাতে আবেগের তীব্রতা খুব বেশি থাকে। কিন্তু সেটা যদি নিজের জন্য, নিজের ক্যারিয়ারে জন্য কিংবা ফ্যামিলির জন্য ক্ষতির কারণ হয় তাহলে ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত...
এতটুকু বলেই সুর্মিপু হঠাৎ থমকে গেলেন। তার কন্ঠস্বর অন্যরকম লাগছে আমার কাছে, এই কন্ঠ আমি শুনিনি মনে হয় কোনদিন। খানিক বাদেই তিনি আবার বলা শুরু করলেন,
দ্যাখ, আমি তোর ভাল লাগাকে অসম্মান করছিনা।
তোর আবেগের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যেভাবে তুই একটু একটু করে আমার মাঝে ডুবে যাচ্ছিস, এটা তোর জন্য খুব কষ্টের হবে। খুব বেশি কষ্টের হবে, নিজেকে হয়তো আর কখনোই গোছাতে পারবিনা। অলরেডী তুই অনেকটা অগোছালো হয়ে গেছিস। নাইন থেকে টেনে উঠার সময় ম্যাথে ফেল মেরেছিস। তোর আম্মু-আব্বু সারাক্ষণ তোর পড়াশোনা নিয়ে টেনশান করে, ওনারা অলরেডি বলা শুরু করেছেন সামথিং গোয়িং রং।
এভাবে যদি চলতে থাকে, এসএসসি’তে নিশ্চিত ডাব্বা মেরে বসবি। অথচ তুই নাইন পর্যন্ত তুই ফার্স্ট বয় ছিলি। আমার চোখের সামনে তুই দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছিস আর এটা চেয়ে চেয়ে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি যা বোঝার তা বুঝে গেছি। কেন জানিনা, রাগ লাগছে খুব।
আমি ওখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই, পেছন থেকে ডাকলেন সুর্মিপু।
কোথায় যাস্ তুই? কথা শেষ না করে এক পা’ও নড়বিনা।
প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কাকে ভাল লাগবে-না লাগবে, কি করবো-না করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। সুর্মিপুর কথা শুনতে আমার একটুও ইচ্ছে করছেনা এখন।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমি কখনো ভাবতেও পারিনি উনি সব বুঝতে পারবেনা। ড্যাম্ ইট!!
জিসান, আমার উপর রাগ হচ্ছে তোর জানি, কিন্তু... আমার কি করার আছে বল? আমি তোর সংগে অনেক বাজে বিহেভ করেছি, কারণে-অকারণে ঝগড়া করেছি, বকা দিয়েছি-কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তোর পাগলামি দিন দিন বেড়েছে। তোর ড্রয়ারে রাখা নয়টা ডায়েরীর ২ টা আমি পড়েছি। তুই যা লিখেছিস, তুই যা ভাবছিস, তা আদৌ কি সম্ভব? কেন এমন পাগলামি করছিস? তুই কি এটুকু বুঝিস যে আমি তোর জন্য তোর চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছি? কেন অবুঝের মত পাগলামি করছিস? আমি কি করতে পারি তোর জন্য বল? আমি যে ভীষণ রকম অসহায়? কেন মিছেমিছি অপরাধী করছিস আমাকে তুই??
সুর্মিপু কাঁদছেন।
কান্নার তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে, বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছেন। আমার যে কেমন লাগছে আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা, খানিক বিব্রত, খানিকটা লজ্জিত কিংবা প্রচন্ড এই ধাক্কাটা সামলে নিতে গিয়ে অনুভূতিহীন হয়ে গেছি। কারো গোপণ কষ্টে সাক্ষী হতে নেই, কাউকে গোপণ কষ্টের সাক্ষী করতে নেই-আমি সুর্মিপুর কাছ থেকে সরে এলাম। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
রুমে ফিরে আমি আবার টিভি সামনে বসে পড়লাম।
সুর্মি আপু বড় আপুকে রান্নায় সাহায্য করছেন। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এতক্ষণ কিছুই হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই বড় আপুর সংগে কথা বলছেন, হাসছেন।
রাতের খাবার খেয়ে নয়টার দিকে আমারা ফিরতি পথ ধরলাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে, গাড়িতে বসে সুর্মি আপুকে কিছুটা চিন্তিত মনে হল।
চোখমুখ থমথমে। আমার মনের অবস্থা যে কি তা আমি নিজেই টের পাচ্ছিনা। হয়তো এখনো বুঝতেই পারছিনা কি হয়েছে, কি হচ্ছে।
তুই হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া শুরু করেছিস কবে থেকে?
ক্লাস সেভেন।
অন্যদিকে ফিরে এক কথায় জবাব দিলাম আমি।
শক্ত কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা মোটেও।
আর হাসানের গান?
তাও তখন থেকেই মে বি। স্পেসিফিক মনে নেই।
আজ থেকে আর শুনবিনা। হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়বিনা।
মনে থাকবে?
থাকবে।
কেন বললাম জানতে চাস না?
নাহ্। জানতে ইচ্ছে করছেনা।
কেন ইচ্ছে করছেনা?
তাও জানিনা। তুমি বলেছ শুনতে না, পড়তে না-দ্যাট্স ইট।
আমার যে বলতে ইচ্ছে করছে!
তাহলো বললেই পারো।
পুণর্জন্মে বিশ্বাস করিস তুই?
নাহ্।
আমি করি।
হুমমম... ভাল।
আমার যদি আবার জন্ম হয় কোনদিন, তাহলে আমিও হুমায়ূন আহমেদের বই পড়বো, হাসানের গান শুনবো।
কেন?
ঐ যে তুই শুনবি, তোর সংগে আমিও শুনবো।
মানে কি?
মানে কিছুই না।
আর শোন, খবর্দার, ঐ সময় কিন্তু এত দেরী করে জন্ম নিবি না তুই, আমার থেকে কম করে হলও এক সেকেন্ড আগে জন্ম নিস্।
কি বলো এসব আবোল-তাবোল, মাথা ঠিক আছে?
নাহ্। মাথা একদম ঠিক নেই।
যা বলেছি মনে থাকবে?
সুর্মিপুকে কিছুটা এলোমেলো মনে হলো। কী অদ্ভূত ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! কিছু না বলে সুর্মিপু হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমিও ছুঁয়ে দিলাম তার হাত। আঙ্গুলের মাঝে আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে সুর্মিপু হাত ধরে রেখেছেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, আপাতত আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছেনা আমার।
সাভার সিএনজি স্টেশান থেকে গ্যাস নেয়ার জন্য গাড়ি পার্ক করলো।
অনেক্ষণ সময় লাগছে দেখে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। পাম্পের ঝকঝকে আলোয় সুর্মি আপুকে অপূর্ব লাগছে। অর্নামেন্টসগুলো ঝিকমিক করছে। অদূরেই ৪-৫ টা ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। সুর্মিপুকে দেখেই সম্ভবত ওরা বেশ জোরে কোরাশে গান গাওয়া শুরু করলো।
একটু পরেই ওদের একজন হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো।
কুত্তার বাচ্চা সব!! চল গাড়িতেই বসি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন সুর্মি আপু। আমিও উঠে গেলাম পিঁছু পিঁছু।
গ্যাস নিয়ে আমরা দ্রুত স্টেশান ছাড়লাম।
কিছুদূর আসার পরপরই পেছন থেকে একটা সাদা রঙ্গের মিৎসুবিশি ল্যান্সার আমাদের গাড়িতে হালকা ধাক্কা দিলো, যদিও ধাক্কা দেয়ার কোনই কারণ নাই, পুরো রাস্তা ফাঁকা। পেঁছনে তাকাতেই ওরা গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কুৎসিত ভঙ্গি করলো।
আংকেল, দ্রুত গাড়ি চালান, ড্রাইভারকে কথাটা বলেই একটু পর পর পেছনের দিকে তাকাচ্ছেন সুর্মি আপু। ওনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী অসভ্য মানুষ সব! এখন আমার ভয় করতে শুরু করেছে।
আমি খুব শক্ত করে সুর্মিপুর হাত ধরে থাকলাম।
ওদের গাড়িটা একবার আমাদের সামনে যাচ্ছে আরেকবার পেছনে। সাইড নিতে দিচ্ছেনা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা খুব এনজয় করছে ওরা। বখাটেগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্যই আমরা একটা বাজারে থামলাম বেশ কিছুক্ষণ।
তারপর আবার যাত্রা শুরু। বেশ কিছুক্ষণ ওদের আর দেখা গেল না। ভাবলাম হয়তো চলে গেছে। টংগী ডাইভার্শন রোডে উঠতে পারলে আর প্রবলেম হবেনা। আশুলিয়া বাজার পার হতেই আবার কোত্থেকে যেন উদয় হলো সাদা গাড়ীটা।
এবার আমাদের সামনে সামনে থাকছে, সাইড নিতে দিচ্ছেনা। সাপের মত একবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
চরম রাগ লাগছে আমার, কিন্তু কিছু করার নেই। এমন করতে করতেই আমরা টঙ্গী ডাইভার্শন রোডের কাছাকাছি চলে আসতে দেখে স্বস্তি পেলাম কিছুটা। বাম দিকে গাজীপুর, ডানদিকে ঢাকা।
মেইন রোডে উঠে গেলে আর টেনশান নাই। ওদের গাড়িটা ওভারটেক করা মাত্রই ড্রাইভার আমাদের গাড়ির গতি দিলেন বাড়িয়ে। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি পিক-আপকে সাইড দিতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। বিপদজনকভাবে গাড়ীটা ডান দিকে টার্ন করলো, বিকট শব্দ। মুহূর্তেই গাঢ় অন্ধকার গ্রাস করলো সব।
বুঝতে পারছি আমার হাতের মাঝে সুর্মিপুর একটা হাত তখনো ধরা, আর আরেকটা হাত এলোমেলোভাবে আমার মুখের উপর ঘুরছে। আমার নাম ধরে কিছু একটা বলছেন সুর্মিপু। গোঙ্গানির শব্দে কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আকাশ বাতাস জুড়ে একটি শব্দই আমার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, জিসান... জিসান... জিসান... এরপর আর কিছুই মনে নেই আমার!!
উৎসর্গ: আত্নীয়-পরিজনহীন শহরে দু'জন খুব কাছের মানুষ, গিয়াসউদ্দীন টিপু এবং রুহুল আমিন সুমনকে।
বি. দ্র: সব চরিত্র কাল্পনিক, কারো সংগে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।