© এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের। তাই লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ব্যবহার না করার অনুরোধ রইল...
নীল জামার সংগে ম্যাচ করে নীল ফিতাওয়ালা জুতো খুঁজতে খুঁজতে মেজ ফুফি যখন চরম বিরক্ত, সুর্মি আপুর উৎকন্ঠা তখন দেখার মত, দোকান বন্ধ হবার আগে এক জোড়া নীল জুতো পাওয়া যাবে তো? আমার সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে, রাত দশটার দিকে জনির সংগে নীতুদের বাসায় যাবার কথা। নীতুর বড়বোন মিতু আপু কথা দিয়েছেন সবাইকে মেহেদী পরিয়ে দিবেন। বলা বাহুল্য মেহেদী পরানোর ছুঁতোয় নীতুর সান্নিধ্য পাওয়া যাবে কিছুক্ষণ, সাথে বোনাস হিসেবে থাকছে মিতু আপুর হাত ধরার আকর্ষণীয় সুযোগ!! এলাকার দুজন ড্রিম গার্ল নীতু আর মিতু আপু আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। নীতু আমাদের সংগেই ক্লাস টেনে পড়ে, আর মিতু আপু জাহাঙ্গীর নগরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে আছেন।
ছোট বড় সব পোলাপাইন এই দুজনকে এক নজর দেখার জন্য কাঠফাটা রোদ্দুর আর আকাশ ভাঙ্গা ঝুম বৃষ্টিতে বাড়ির পাশের ছোট্ট মাঠে ক্রিকেট খেলে। ।
ঢাকায় আসার আগে জনি বার বার করে বলে দিয়েছে, ঢাকায় যাও ভাল কথা, রাইত নয়টার আগে চইলা আইসো। নীতু এখন আসমানের চাঁন, এই চান্স মিস্ করা যাইবোনা। আজকে ওরে আমার ভালবাসার কথা বলতেই হবে, কোন মিস্ নাই!!
সবচেয়ে বড় কথা হলো, চাঁদরাতে নীতুর সংগে জনির দেখা করিয়ে দেব, এই চুক্তিতে অলরেডী তিনবার মোল্লা রেস্টুরেন্টে কাচ্চি খাওয়া হয়ে গেছে!! এখন রাত বাজছে বরোটার কিছু বেশি।
সুতরাং আজকে আর গাজীপুরে ফেরা হচ্ছেনা! হে খোদা, তুমিই জানো কালকে কপালে কি আছে!
নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক ঘুরে আবার আমরা এলিফ্যান্ট রোডে চলে এসেছি। একটা জিনিসই এখন কেনার বাকী, সুর্মী আপুর নীল জুতো!! প্রচন্ড গরমে সারাদিন মার্কটে মার্কেটে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলেও এখন আর খারাপ লাগছেনা, বলা বাহুল্য এই মেয়েটার কোন কিছুই আমার খারাপ লাগেনা। সুর্মিপু যদি একটা আট ইঞ্চি ইট নিয়ে আমার মাথাটা ফাটিয়ে দেয়, তাও মনে হয় আমার কাছে খারাপ লাগবেনা!! আল্পনা প্লাজার সামনে গাড়ী পার্ক করে আমি আর ড্রাইভার বসে আছি, মেজ ফুফু আর সুর্মিপু গেছেন জুতোর সন্ধানে।
মার্কেটের সামনের রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। চাঁদনী রাতে শপিং এর চেয়ে উইন্ডো শপিংটাই বেশী হয়।
ইয়াং ছেলেরা দলবেঁধে সারারাত এই মার্কেট থেকে ওই মার্কেটে ঘুরোঘুরি করে। সুন্দরী মেয়ে দেখার মধ্যে এক ধরণের সুখবোধ আছে। এই সুখের অনুভূতি আমাকেও ছুঁয়ে যায়, কিন্তু সমস্যা হলো যখনই কোন সুন্দরীর দিকে তাকাই, সুর্মিপুর কথা মনে হয়। নিজের অজান্তেই তুলনা করা শুরু করি, এই মেয়েটা কি সুর্মিপুর চেয়ে বেশী সুন্দরী?? তুলনার বিচার নিরপেক্ষ কিংবা পক্ষপাতমূলক যাই হোক না কেন, সুর্মিপুকেই জিতিয়ে দিই আমি। এটাকেই কি প্রেম বলে?? অতশত বুঝিনা আমি, শুধু বুঝি সুর্মিপুই সেরা, সুর্মিপুই শ্রেষ্ঠ।
আচ্ছা শব্দটা কি শ্রেষ্ঠ হবে, নাকি শ্রেষ্ঠা?? জানিনা, ব্যকরণ বুঝিনা আমি। মাথা ভর্তি হাসানে গান আর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থাকলে ব্যকরণে ভুল হওয়াটা দোষের কিছু না!!
ভ্যাপসা গরম ক্রমেই বাড়ছে। আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোণা, গর্জন। ভয়ানক বৃষ্টি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সুন্দরী দেখতে ইচ্ছে করছেনা, দরজা খুলে গাড়ীর ভেতরে বসে রইলাম চুপচাপ।
মধুর আলস্য ভর করেছে শরীরে, গাড়ির হর্ণের তীব্রতা কমে আসছে ক্রমশ। বুঝতে পারছি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম চলে আসবে।
ঘুম ভাঙ্গলো সুর্মিপুর চিৎকারে। আমি মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে গেলাম, আর তুই এখানে ঘুমোচ্ছিস?? আমি চোখ মেলে সুর্মিপুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
জুতো পেয়ে গেছি, গাড়ি থেকে নাম।
গাড়ি থেকে নাম মানে? নামবো কেন? তুমি চলে যাই, আমি বাসায় যাবো না? কয়টা বাজে এখন খবর আছে?
বাসায় যাবো মানে? রাত দেড়টার সময় তুই গাজীপুরে যাবি কিভাবে?
কিভাবে যাবো ফুফু জানে। আমি কি এখানে ঈদ করবো নাকি? ঈদের বিষয়টা এতক্ষণে মাথায় আসেনি। সকালেই ঈদ, এত রাতে বাসায় যাবো কিভাবে? আমার এখন কান্না পাচ্ছে । আমি অসহায়ের মত মেজ ফুফির দিকে তাকালাম।
ফুফি আমার মনের অবস্থা বুঝে গেছেন, তিনি হাসছেন।
শোন, এত রাতে বাসায় যাবার দরকার নাই, কাল সকালে নামাজ পড়ে সবাই মিলে গাজীপুর যাবো, ওকে??
আমি মাথা নেঁড়ে সম্মতি দিলাম। কিছু বললে কাজ হবেনা। সকালে বাসায় যাবো শুনে কেমন লাগছে নিজেই বুঝতে পারছিনা। মিশ্র অনুভূতি।
ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট দিয়েছেন।
আমি বসে আছি ড্রাইভারের পাশের সীটে, ফুফি পেছনে, সুর্মিপু এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ওনার কি মনে হলো জানিনা, সুর্মিপু বেঁকে বসলো। গাড়িতে যাবেননা, রিকশা করে বাসায় যাবেন।
সুর্মিপুর এমন অদ্ভূত আবদার শুনে আমি নিজেই ভড়কে গেলাম, ফুফির দিকে তাকিয়ে আছি কি বলেন দেখার জন্য। সাড়ে চারশ ওয়াটের একটা ঝাড়ি যে দিবেন তাতে কোন সন্দেহ।
তাঁর কপাল সংকুচিত, চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আছে। সুর্মিপুর কোন ভাবান্তর হলোনা। অন্যদিকে তাকিয়ে ড্যাম কেয়ার ভংগিতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন এখনো।
জিসান, গাড়ি থেকে নাম। ওকে নিয়ে একটা রিকশা করে চলে আয়।
সাবধানে আসবি, এটুকু বলেই ফুফু হাত বাড়িয়ে একশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলেন। চোখমুখ ভীষণ শক্ত। আমি ঢোক গিলতে গিলতে টাকা হাতে নিয়ে চুপচাপ নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা মেট্রো ঘ-০২-২২৮৬।
আমি সুর্মিপুর পেছনে পেছন হাঁটছি।
রিকশায় উঠবানা আপু?
নোপ ম্যান। আমরা এখন বিরিয়ানি খাবো, কাউয়া বিরিয়ানি।
মানে কি?
মানে কিছুই না। এখান থেকে যাবো সিটি কলেজের সামনে, দ্যান রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাফিজ মামার দোকান থেকে ১০ টাকা প্লেট কাউয়া বিরিয়ানি খাবো। তারপর হেঁটে হেঁটে বাসায় যাবো, পারবিনা?
আকাশে জুড়ে মেঘ জমেছে, দেখছো?
আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে মানে কি? রবি ঠাকুর সাজছো? সাধু ভাষায় কথা বলো? তোর ঠাকুরগিরি আমি ছুটাবো আজকে।
বেশি কথা বললে আমি রিকশায় বসবো, আর তোকে চড়াবো রিকশার পেছনের বাম্পারে। এ্যালিফ্যান্ট রোড টু মোহাম্মদপুর, ডাইরেক্ট ডাইরেক্ট...!!!
সর্বনাশ!! বলে কি এই মেয়ে? ওনাকে আর বেশি ঘাটানো ঠিক হবেনা। যা খুশি করে বসতে পারে। সদ্য ভার্সিটি ভর্তি হওয়া ছেলে-মেয়েরা একটু তারছেঁড়া হয়, কথাটা মনে হয় মিথ্যে না। সুর্মি আপুর ক্ষেত্রে মনে হয় তার বেশ কয়েকটা ছিঁড়ে গেছে।
সম্ভবত মেডিকেলের স্টুডেন্টদের তার বেশি ছেঁড়া থাকে।
কথা না বাড়ি সুর্মিপুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, সিটি কলেজের সামনে হাফিজ মামা নাই। চটপটির দোকান বন্ধ করে নিশ্চই মামীর জন্য লাল শাড়ি কিনতে চলে গেছে বঙ্গবাজার, কালকে ঈদ।
সুর্মি আপুকে কিছুটা হতাশ দেখা গেল।
এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম। রাস্তা ফাঁকা, রাইফেল স্কয়ার হয়ে সাতমসজিদ রোড দিয়ে মোহাম্মদপুর যেতে ২০ মিনিটের বেশি লাগার কথা না।
চুপচাপ বসে আছি। সুর্মি আপুর শরীর থেকে অসম্ভব সুন্দর ঘ্রান আসছে, নেশার মত। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, দর্শন ইন্দ্রিয় বন্ধ করে দিলে অনুভবের তীব্রতা বেড়ে যায়।
এ এক অদ্ভূত সুন্দর অনুভূতি। অসহ্য সুন্দর কি একেই বলে? কে জানে!! কানে হেডফোন লাগিয়ে সম্ভবত তুমুল জনপ্রিয় কোন হিন্দি গান শুনছেন সুর্মি আপু। হিন্দি গান শোনা তো দূরের কথা, দু’চক্ষে দেখতে পারিনা আমি । তবু কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করছে এখন।
সুর্মি আপু... সুর্মি আপুউউউ....!
হুমমমম... বল।
হেডফোন খুলে আমার দিকে তাকালেন উনি।
গান শুনবো।
মানে কি? হিন্দি গান শুনবি তুই?
হুমমম... শুনবো।
হি হি হি!! হিন্দি গান শুনবি আর পরে আমাকে খেপাবি? তা হবেনা। তারচে’ বরং তুই আমাকে একটা গান শোনা।
ঐ যে তুই যার ডাইং হার্ট ফ্যান, তার একটা গান শোনা।
হাসানের গান শুনবা তুমি?
হুমমম... শুনবো, শোনা।
হাসবা না তো?
হাসবো ক্যান? শোনা।
কিছুটা দ্বিধা নিয়েই আমি গলা ছেড়ে গান ধরলাম, হাসানের “নক্ষত্র হারায়” গানটা।
“অনন্ত আকাশ থেকে নক্ষত্র হারায়
নিয়তির এমনও এমনও হয়
ভুল শুধু ভুল রয়ে যায়
অনন্ত আকাশ থেকে নক্ষত্র হারায়
তোমাকে কাছে যখনই চাই
দূরে দূরে রয়ে যাই
অনন্ত আকাশ থেকে নক্ষত্র হারায়
পথ হারা হৃদয় আমার
কখনো পায়না খুঁজে
তোমার ঐ মনের দুয়ার
তোমার ঐ ভালবাসা যায় না ছোঁয়া
আজও দেয়না ধরা
কেবলি আড়ালে যে রয়
অনন্ত আকাশ থেকে নক্ষত্র হারায়
জানিনা যে তুমি কোথায়
লুকিয়ে রাখো এই মন
অচেনা কোন ঠিকানায়
তোমার ঐ ভালোবাসা
যায়না ছোঁয়া, আজও দেয়না ধরা
কেবলই আড়ালে যে রয়
অনন্ত আকাশ থেকে নক্ষত্র হারায়!!”
তুই তো ভালই গাস্ রে।
গুড। কিন্তু এই ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনিস ক্যান? ছ্যাঁকা খাইছিস নাকি?
ছিঃ সুর্মী আপু, এসব কি কথা বলো তুমি!!
আমার ছিঃ বলার ধরণ দেখে সুর্মী আপু শব্দ করে হেসে উঠলেন। আমি অপার মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এই মানুষটার সব কিছু এত সুন্দর কেন? মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?
নিকষ আঁধার (দ্বিতীয়/শেষ পর্ব)
উৎসর্গ: আত্নীয়-পরিজনহীন শহরে দু'জন খুব কাছের মানুষ, গিয়াসউদ্দীন টিপু এবং রুহুল আমিন সুমনকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।