আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণহত্যার দাগে আঁকা মানচিত্রের বিচার প্রার্থনা

আমরা ভুলে যাই আমাদের কাঁধে ৩০লাখ লাশের ভার। য়ারা শহীদ হযেছেন মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের যে শিশু জন্মেছে এবং যে জন্মাবে, তার প্রাণবায়ুও কিন্তু ওই শহীদদের থেকেই ধার করা। আনুমানিক ৪লাখ নারীর চূড়ান্ত নিপীড়নের প্রতিকারের দায় আমাদের ওপর। এত মৃত্যু, এত নির্যাতনের ভার নিয়ে খুব কম দেশকেই যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।

এবং এত মাহকাব্যিক একটি সংগ্রামের নিদারুণ অপচয়ের নজিরও পৃথিবীতে কম। গত কয়েকশ বছরে বাংলা দিয়েছে যত, পেয়েছে অনেক কম। কেবল বাংলা বললে হয় না, পূর্ব বাংলা বললে তবে সহি শুদ্ধ হয়। ৭ মার্চের ভাষনসহ বঙ্গবন্ধু কোথাও পূর্ব পাকিস্থান শব্দ ব্যবহার করেননি। যদিও পশ্চিম পাকিস্থান শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

এটি একটি ঐতিহাসিক স্বাধীনতাকামী সক্ষমতা। দুনিয়ার মধ্যে এমন জাতি নাই, যাদের ওপর অল্পতম সময়ে এরকম সর্বোচ্চতম গণহত্যা হয়েছে। ১৯৭১ এর নয়টি মাস দিনে গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার করে মানুষ হত্যা চলেছে। এই সংখ্যাটি নিয়েও অনেকে নানান রকম আপত্তি করে থাকেন। এককটি স্থানে যে গণহত্যা হযেছে তা কি করে সম্ভব তা ওইসব ইতর শ্রেণীর মাথায় কখনো প্রবেশ করে না।

কিন্ত এর প্রতিদান বাংলার জনগণ পাননি। বাংলার স্বাধীনতা তাদের দুর্দশা ও ক্ষমতাহীনতা থেকে মুক্তি দেয়নি। যে দেশের জন্য তারা যুদ্ধ করেছে জীবন দিয়েছে, সেই দেশ তাদের কবরের জমিনটুকু কিংবা তাদের লাশ পড়ে থাকার নিশানাটুকু পর্যন্ত দিতে পারে নাই। আমি আমার পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধাবে বলতে শুনেছি যার সহযোদ্ধা শহীদ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে তাকে অনুরোধ করে বলে গিয়েছিলেন তিনি যেন শেষ পর্যন্ত লড়ে যান দেশের জন্য। কারণ এখনই তার মৃত্যু হবে, তার মৃত্যুপর পরে তার কবরের স্থানটি যেন পরাধীন না থাকে।

এমনিতে মানুষ মারলে বিচার হয়, কিন্ত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ মারলে তার বিচার হয় না। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে গাজীপুরের কাশিমপুরে একজন মুক্তিযোদ্ধা পিটুনিতে নিহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সিলেটে রিমান্ডে থাকাকালে পুলিশের হাতে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে পরবর্তীতে সকল আসামী বেকসুর খালাশ পায়। ’৭১ এ আমাদের ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে তা কি কেবলই গণহত্যা? ওই গণহত্যার দাগে আঁকা আমার প্রিয় মানচিত্র। কেবল মৃত্যুই দেখেনি বাংলাদেশ, ধ্বংস দেখেছে, নিকৃষ্টতম ঘৃণা দেখেছে।

কী বিষ্ময়, বলা হয়েছিল ঘাতক দালালদের বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে, কাউকেই মাফ করা হবে না। সাগর পাড়ের দেশ হয়েও বাঙালি সাগরে ভয় পায়। নদী নালা আর বন্যায় ভাসা তার মজ্জাগত অভ্যাস। সেকারণে শোকের নদীতে ভাসা আর অশ্রুর বন্যায় প্লাবিত হওয়াই বোধহয় আমাদের রীতি। শোকের প্রতিবিধান না করতে পেরে আমরা এখন শোকের কারণটাকেই ভুলতে বসেছি।

এতবড় একটা যুদ্ধ জাতি করলো, তারপরও কেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বীর রসের কথা নাই! বীর রসে সঞ্জিত গল্প, কবিতা, গান, নাটক বা উপন্যাস কেন এতো হাতে গোনা? কেন আমাদের দেশাত্মবোধক ভাবের বেশিরভাগটাই পুতুপুতু আবেগে জবজবা? দেশটা কি ময়রার ভিয়েন যে সবকিছুই শোকের শিরায় না চোবালে বিকায় না! আমাদের ওই বিচার চাইতে হয় কান্নাকাটির সুরে। এপ্রিল মাস চলে এসেছে। তাই আমাদের চেতনা একটু নেতিয়ে পড়ছে বৈকি। ডিসেম্বর আসলে আমাদের বিজয়ের চেতনা জেগে ওঠে। মধ্যে জানুয়ারি ঘেসে আসে ফেব্রুয়ারি আর মার্চ।

তারপর আর নাই। কেউ বলে বসতে পারেন সাড়া বছরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থাকতে হবে? আসলে আমাদের আর কিই বা আছে? এই পৃথিবীতেই এমন জাতি আছে যারা স্বাধীনতা অর্জন করার পর তাদের শহীদদের সম্মান জানিয়ে প্রতিদিন তাদের দিনর কাজ শুরু করেন। সেই তুলনায় আমরা কি করি ওই জ্জ মাস ছাড়া। তাও আবার সামান্য আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া। এখানে আবার বছর বছর অনুষ্ঠানের রং বদলে যায় সরকারের চেহারার ওপর।

অন্যদিকে স্বাধীনতার স্বাদ রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদন করতে আমাদের দেশের ভাল থাকা অংশ কখনোই বিরত হন নাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দিগম্বর করে রেখে তারা একাই স্বাধীনতার সুখ ভোগ করে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই । রাষ্ট্র ও সমাজকে দুইয়ে, চুষে, চিবিয়ে ছোবড়া করে করেই তাদের নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠা। এ কাজে এরা যেমন দক্ষ এদের রাজনীতিটাও তেমন। দক্ষ বিউটিশিয়ানের মতো এরা স্বাধীনতার দেহ থেকে ৩০লাখ মানুষের রক্তদাগ মুছে ফেলতে পেরেছে, শারীরীক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হওয়া লাখ লাখ নারীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে চেপে যাওয়া হয়েছে।

লুকিয়ে ফেলা হয়েছে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের ধর্ষণের ফসল যুদ্ধশিশুদের অস্তিত্ব¡। সেইসব মা ও তাদের সন্তাদের পরিণতির কোনো খোঁজ কি আমরা রেখেছি? এমন এক স্বাধীন দেশের জন্য তারা সর্বস্ব দিয়েছে, যে দেশ তাদের স্বীকার করেনি। পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দেশীয় দোসররা লাখ লাখ নারীর জীবনকে পুড়িয়ে খাকি করে দিয়েছে, আর বীরাঙ্গনা বলে আমরা সেই পোড়া ঘায়ে লবণ দেওয়ার কাজ সেরেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই যে সোনার বাংলার স্বপ্নে সর্বস্ব দিল, তা কি তারা আর ফেরত পেয়েছে? নির্যাতিত বা শহীদ নারীদের ষ্মরণে স্মৃতিসৌধ তো দূরের কথা একটা ষ্মারক ডাকটিকিট পর্যন্ত হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, জাতির ধারণা কি কেবলই পুরুষালি, নারীর অস্তিত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি সেখানে কোথায়? যদিও ব্যক্তি উদ্যোগে দুয়েকটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভ’মিকা নিয়ে সামান্য কিছু লেখা সঞ্চয় করেছে।

এসব এখন কিছু লেখক গবেষক আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের বিষয়। আজো রাষ্টীয় এজেন্ডাভুক্ত হয়নি ’৭১ এ সংঘটিত গণহত্যা, জাতিগত নিধন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রয়োজনীয়তা। আমাদের কত কত রাষ্ট্রীয় দিবস, কিন্ত ১৯৭১ এর নারকীয় গণহত্যার জন্য একটি ‘গণহত্যা দিবস’ও এখনো ঘোষিত হয়নি। এমনকি এ গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণ করতে গেলে যে ধরনের পদ্ধতিগত তদন্ত দরকার, তাও সমাধা করা হয়নি। বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়া যেটি চলছে ত তে জনগণ আজও মনে করতে পারে কি না যে বিচার হবে তা কেবল যারা বিচার চালাচ্ছেন তারাই ভাল বলতে পারবেন।

হত্যা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ হয়েছে, কিন্তু তার চরিত্রটা যে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ তা প্রমাণের উপযুক্ত আইনী ভাষা কি আমাদের আছে? দেশীয় দালালদের বিচারের উপযোগী ১৯৭২ এর দালাল আইনটিও জিয়াউর রহমানের আমলে রদ করা হয়েছে। আমরা স্বাধীনতা মানি কিন্ত যে পথে তা অর্জিত হয়েছে তা মান্য করি না। মানলে অপরাধীদের বিচারের দায় এড়িয়ে স্বাধীনতাকে হালাল ভাবতে অসুবিধা হবার কথা। টিকটিকি যেমন বিপদে পড়লে শত্রুর হাতে লেজ ফেলে দেহ নিয়ে পালায়, তেমনি আমাদের শাসকরা স্বাধীনতার দেহ থেকে গণহত্যাকে কেটে গদি মাথায় করে পালিয়েছে। এ কারণেই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সমাপ্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্ত কিংবা স্থবির চলমান।

আমাদের শাসকদের নানান ধরণের জাতীয়তাবাদই স্বাধীনতার মহিমা কীর্তন করে, কিন্তু গণদুর্ভোগের বিচারে যন্ত্র প্রশ্নকে এড়িয়ে যায়, ভুলিয়ে দেয়। আপস করে ঘাতকের সঙ্গে। সরকারিভাবে ’৭২ সালের জুলাই মাসে মাত্র ৪০০ জনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্ত কিছুকাল পরেই তা কমিয়ে ১৯৫ জন এবং পরে আবারও কমিয়ে ১১৮ জনে আনা হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষওয়ালাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্ত থামে নাই।

এই সংখ্যা নিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে রিট পর্যন্ত হয়েছিল। যা আমাদের বিচারপতিরা আইন দিয়ে বাচিয়ে দিয়েছেন। না হয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির অপপ্রচারে মাথা হেট হতো বারবার। নিজ জাতির ক্ষমতাবান রাজাকারদের সঙ্গে তারা আপোস করে আর একাত্তরের লড়াই এখনও বিহারিদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যায়। ২৫ মার্চের আগে এবং ১৬ ডিসেম্বরের পরে তাদের ওপরও তো প্রতিহিংসার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল? সেটাও কি যুদ্ধাপরাধ নয়? একাত্তর তাই কোনো সরল কাহিনী নয়।

এ সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা কেবল আত্মপ্রতারণাই নয়, সুবিধাবাদিতা। এটাই সত্যের ভেতরকার তিতা শাঁস। চাই কি না চাই, সত্যের আঁটি তিতাই হয় এবং তাতে কখনো কখনো জিভ ঠেকাতে হয়। আর এখানে রবীন্দ্রনাথকে সামনে নিয়ে আসলেই ভাল। দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুই লাখ মা-বোন! এদের আমি কোথায় কী করব?’ ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’।

‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা’দের একটা সুব্যবস্থা করার জন্য নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী হবে, তা জানতে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি তাকে বলেন, ‘না বলে দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। তাদের সন্তানদের মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না।

’ এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল। সরকারের তরফ থেকে এসব নির্যাতিত নারীকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তারা ভেবেছেন সেটাই নারী জীবনের একমাত্র গন্তব্য। অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন।

ইতিহাসের দায় কি এতেই শোধ হয়? এ নিয়ে গবেষক ড. ডেভিস মন্তব্য করেন, ‘না, কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি। ... পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।

পরিবারের পিতা বা বড় ভাই আর জাতির স্থপতি এখানে এক সুরে কথা বলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরুষালি ইতিহাস নারী মুক্তিযোদ্ধাকেও কেবল সতীত্বের তকমা আঁটা চেহারাতেই দেখতে চেয়েছে। নারী যুদ্ধও করবে, পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বলিও হতে পারবে কিন্তু কোনোভাবেই পুরুষের পরিবারের রাষ্ট্রের সদস্য হওয়ার উপযুক্ত হতে পারবে না, তাকে পুরুষালী শুদ্ধতা রাখতেই হবে। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খায়, তেমনি বড় ইতিহাস ছোট ইতিহাসকে লোপাট করে। বড় ইতিহাস মানে জাতীয় ইতিহাস, সেখানে নায়ক মহানায়ক আছে, বীর আছে।

তারা জাতি গঠনের স্থপতি। তাদের অনুসারীদের ভাবে ইতিহাসের ছোট ছোট কারিগরের ভূমিকা ঢাকা পড়ে যায়। ইতিহাসেও মাৎস্যন্যায় আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ সত্য বিরল নয়। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের শ্রেণীগত বিচারের প্রয়োজন পড়ে।

মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজস্ব রাষ্ট্র চেয়েছে, চেয়েছে বিদেশী শাসক হটিয়ে ক্ষমতার গদিতে নিজেরা বসতে। আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা গদীতে বসতে চেয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই শ্রেণীগত আকাংখা তখন ইতিহাসের মোড়ে জাতীয় আকাংখা উঠতে পেরেছিল। কিন্ত এই আকাংখার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাসনা যতটা পাকা ছিল, ক্ষমতার চরিত্র বদল ততটা ছিল না।

অথচ কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষ চেয়েছিল মুক্তি। সেই মুক্তির চেহারা ছবি তাদের কাছে অস্পষ্ট হলেও, জমি জীবন ও ভবিষ্যতের ওপর তারা বাঙালি বা অবাঙালি কারো আধিপত্য চায়নি। মুক্তিবাহিনীতে দলে দলে এরাই যোগ দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক হিসাবে আমরা লুঙ্গি গামছা পড়া কৃষককেই বুঝে থাকি। কিন্তু তাদের লড়াই আর ছয় দফার লড়াই কি এক ছিল? না থাকলেও পাকিস্তানীদের গণহত্যার নিশানায় এরাই বেশি করে পড়েছিল।

যে চার লাখ ‘বীরাঙ্গনার’ কথা বলা হয়, তারাও কিন্ত গ্রাম শহরের গরিব ঘরেরই নারী। মুক্ত বাংলাদেশ এসব গরিব নারী পুরুষকে ভুলে গেল। এরা অস্ত্র ও জীবন সমর্পণ করে ফিরে গেল, মেয়েদের অনেকে আত্মহত্যা করলো অনেকে ভীড় জমালো পতিতালয়ে। এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পুরুষরাই তো সেখানে গিয়ে তাদের পয়সার বিনিময়ে ধর্ষণ করে আসতে পারে; দেশ গড়া ও রাষ্ট্র পরিচালনার ডাক এদের কাছে যে আসবে না তাতে বিষ্ময় নাই। এমনকি যে সাতজন মুক্তিযোদ্ধকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়া হলো, তাদের মধ্যে কৃষক সন্তানেরা থাকলেও সেই পরিচয়ের জন্য তারা সম্মানিত হননি, হয়েছেন সামরিকতার জোরে।

নইলে সেনাসদস্যের বাইরের বীরদেরও আমরা দেখতে পেতাম। গণযুদ্ধ'র প্রয়োজনে শ্রেণীতে শ্রেণীতে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনতার পরপরই তা ভেঙ্গে গেল। রাষ্ট্র একদিকে চলে গেল, সমাজ আরেক দিকে। অন্যদিকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রুখতে সফল হলেও নিজ জাতির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হলো। তারই ফল গণহত্যাকারীদের বিচার না হওয়া।

স্বাধীন বাংলাদেশেই পরাস্ত হলো তাদের শ্রেণীর লাখ লাখ মানুষ হত্যার বিচারের দাবি। এবং স্বাধীনতার শত্রু আমেরিকা ও সৌদি আররে পুনরাভিষেক ঘটলো স্বাধীন বাংলাদেশে। গত ৪০ বছরে যারা ক্ষমতাবান হয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে তাদের তো খুব বেশি কিছু হারাতে হয়নি। বরং রাজনীতির মাঠে ব্যতিক্রম ছাড়া আর সবাই এখন রাজনীতির বাইরে থেকেই রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। এদের চেতনার কাঠখড়ে আর আগুন জ্বালানো যাবে না।

জ্বলবে না, নানান আরামের রসে সেটা ভিজা। বড় যুদ্ধের ভেতরে যে ছোট ছোট গোষ্ঠীগত যুদ্ধ চলে তার চরিত্র নিরূপণ এবং তাতে কার কী ভূমিকা তা সনাক্ত করা ছাড়া তাই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কী থেকে কী হয়ে গেল তার কার্যকারণ নিরূপন সম্ভব না। তাই ১৬ ডিসেম্বর একইসঙ্গে জয় পরাজয়ের দিন। আমরা জয়ী হলাম, কিন্ত জনগণের বড় অংশের শরিকানা ছিনতাই হয়ে গেল। বিপ্লব সম্পর্কে বলা হয় যে, তা প্রথমেই তার সন্তানদের খায়।

সিরাজ শিকদার, কর্নেল তাহের নিহত হলেন, জাসদের গণবিপ্লবে অনেক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার অকাল মৃত্যু ঘটলো। রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন নিহত হলেন। সবই কিন্ত হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভেতর থেকে, বাইরের বিদ্রোহ বা আক্রমণে নয়। এটা একটা দিক। অন্য দিকে, লড়াই ও ত্যাগের অগ্রভাগের শ্রেণীটিকে পিছু হঠানো হল।

পরবর্তী শাসকেরা চেষ্টা করেছে গরিব জনগোষ্ঠীর শ্রেণীগত পরাজয়ের এই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেয়ার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষপূজক এবং জাতীয়তাবাদী মহাত্মনেরাই এ ব্যাপারে শিরোমণি। বঞ্চিত জনগণকে যদি তাদের পরাজয়ের স্মৃতি ও জ্বালা ভুলিয়ে দেয়া যায়, তবে তারা কখনোই ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে মাথা তুলবে না। গণহত্যার বিচার না হওয়ার সঙ্গে এই ভুলিয়ে দেয়ার রাজনীতির সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশে ’৭১ এর গণহত্যার বিচারের দাবি যদি কখনো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, যদি সত্যিসত্যি গণশত্রুদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়, তবে রাষ্ট্র ও সমাজের কোটরে বেড়ে ওঠা গোটা বিষবৃক্ষের ঝাড়ই আক্রান্ত হবে।

যে রাজনীতির গাফিলতিতে ঘাতকেরা রক্ষা পেয়েছে ও পাচ্ছে, গণরোষের তীরের নিশানা থেকে তারাও রেহাই পাবেন না। অতীতের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে অতীতের সমস্যার নিদান যদি যদি অতীতে না করা হয় তবে তা ফিরে ফিরে আসবেই। ক্ষত যদি না শুকায় তবে তা বারবার ব্যথা জাগাবেই। যতদিন না যার যা প্রাপ্য তা তাকে দেয়া হচ্ছে, ততদিন সেই কর্তব্য আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। এখন তাই একাত্তরের দুটো সম্ভাবনা।

একাত্তরের বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করা এবং অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করে জনগণের মুক্তি ঘটানো। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চে তাদের কথা বা স্মৃতি শোনার জন্য মিডিয়া কান খাড়া করে রাখে আর জাতি শোনে। তারা গরিব মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নন। সমাজে তারা মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। সবচেয়ে বড় কথা তাদের পেছনে বড় বড় দল আছে।

কিন্ত এভাবে যে মুক্তিযুদ্ধটা একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতে চলে গেল, বাদবাকি লোকজনদের ত্যাগ ও রক্তের ছাপ যে মুছে ফেলা হলো, তার বিচার কে করবে? ইতিহাসের বিচার অনেক লম্বা। অনেক সময় লাগে তাতে। এখন একাত্তর যেন তামাদি প্রসঙ্গ। যদিও গঠিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল। কিন্তু এক বছরেও ট্রাইবুনাল কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সরকারের গাফিলতির কারণে।

মাত্র কয়েকদিন আগে তদন্ত সংস্থার সদস্য আব্দুর রাজ্জাক নিজেকে ঢাল নাই, তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের সাথে তুলনা করেছেন। আর আইনজীবি প্যানেলের সদস্য জেয়াদ আল মালুম বলেছেন, বুক দিয়ে পাহাড় ঠেলছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন সংগ্রামের করুণ কাহিনীর যে কদর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তার কারণও কি এই করুণ রসের মানসিক অর্থনীতি? মঞ্চে বা ছাপা কাগজে আর টিভির পর্দায় এত যে অশ্রুবর্ষণ তা কি তবে জনতোষণের নতুন ফন্দি? জনগণের আবেগকে কাজে লাগাবার মোহনীয় আয়োজন? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক পাতার ঘটনা এমন। যশোরে এক বাড়িতে রাজাকার আসে। সে (একটি মেয়ের জবানবন্দি) পালায় কিন্তু, ছোট ভাই ধরা পড়ায় সে ফিরে আসে।

তখন তারা (রাজাকাররা) তাকে পায়। তাদের কাজ (ধর্ষণ) হয়ে যাবার পর তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। কিন্ত আমি তো আমার ভাইটিকে মরতে দিতে পারি না। তাই অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও নিজেকে কোন মতে তুলে ভাইকে দরজা ভাঙায় সাহায্য করলাম। তা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলাম।

সেই রাতে লুকিয়ে থাকলাম বাড়ির পেছনের পুকুরটাতে। পরদিন ভোরে যখন পুকুর থেকে উঠলাম, আমার গায়ের মাংস খাবলা খাবলা করে খসে পড়তে লাগল। দু’একটা টুকরা ছাড়া গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, গাঁয়ের কিছু লোক ভোরের নামাজ পড়ে ফিরছে। আমাকে দেখে তারা মজা পেয়ে হৈহৈ করে উঠল।

আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমি বেশ্যা নই, ওমুক আমার বাবা, আমাকে সাহায্য করুন। ’ কিন্তুু তারা চলে গেল। সেদিন থেকে আমি জ্যান্ত মরা। আমার শরীরে যন্ত্রণা। আজ আমার কোনো স্থানে কোনো মর্যাদা নেই।

ভাইয়ের জন্য আমার জীবন, সম্ভ্রম সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি। অথচ আমি এখন তার চাকরের থেকে বেশি কিছু না। এই ই বাংলাদেশে মেয়েদের কপাল। ’’ যোদ্ধা হওয়া বা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের গর্বের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে তার সর্বনাশের ইতিহাস। পরিবারের ধর্ম এবং রাজনীতিই তাদের শত্রুর শরীরে পরিণত করেছে।

পাকিস্তানি সৈন্য, বাঙালি রাজাকার এবং বিহারিরা দেশ ও জাতির নামে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ফেলে গেছে পুড়ে মরার জন্য। যখন সে পুকুর থেকে উঠে এলো, তখন তার গায়ের পোড়া মাংসের ঘ্রাণ কি আমাদের নাকে লেগেছিল? কিংবা তার যন্ত্রণা কি আমরা টের পেয়েছিলাম? আমরা তাকে ফেলে এসেছি দূর অতীতে, কখনোই না ফুরানো একাকীত্বের মধ্যে,যেখানে সে কিংবা আরো অসংখ্য বিধবা, পঙ্গু পরাস্থ যোদ্ধার স্মৃতি, ভয়, উদ্বেগ অথবা আশার কোনো অংশীদার নেই। কোনো মুক্তির যুদ্ধই তাদের আর মুক্ত করতে পারবে না, কেবল অপরাধীদের শাস্তি ছাড়া। অপরাধ কখনো পুরাতন হয়না, অপরাধ সবসময় অপরাই থাকে। তবে এই নিয়ে আর বেশি দেরী করা যায়।

বিচারটা যেহেতু মানুষরূপী কতগুলো দানবের হবে তাদের শরীরের ক্ষমতায় সেই বিচার মানিয়ে দেওয়ার একটা জায়গা লাগবে। না হয় এইতো কয়েকদিন আগে জয়পুরহাটের রাজাকার আব্দুল আলীম গ্রেফতার হলেন আর জামিনে বেরিয়ে গেলেন। আরো অনেকেই একই লাইনে দাড়িয়ে যাবেন। অরো কিছুদিন গড়িয়ে গেলেতো আর বিচারের প্রয়োজনই থাকবেনা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.