বাংলা আমার দেশ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক পর বাংলাদেশ সরকার যখন গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন থেকেই এই বিচার প্রশ্নবিদ্ধ, বিঘিœত ও বানচালের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীরা দেশে ও বিদেশে বহুমাত্রিক তৎপরতা আরম্ভ করেছে। জামায়াত জানে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত এসব অপরাধের সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যেভাবে যুক্ত ছিল জামায়াতের তৎকালীন নেতা-কর্মীরাও একইভাবে যুক্ত ছিল। কখনও এসব অপরাধের ক্ষেত্রে জামায়াত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়ে বেশি নৃশংস ছিল।
পাকিস্তানি শাসকরা তাদের ২৪ বছরের শাসনামলে বাঙালিদের সব সময় নিকৃষ্ট ও ভৃত্যতুল্য গণ্য করেছে। বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তারা প্রতিহত করতে চেয়েছে ইসলাম ও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার দোহাই দিয়ে।
’৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানও ছিল অভিন্ন। এই রাজনীতি বাংলাদেশে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি করেছে, এসব অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে এবং এখনও এই রাজনীতি বাংলাদেশে অব্যাহত রয়েছে।
সা¤প্রতিক বিশ্বে ইসলামের নামে হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাসকে বৈধতা দিয়েছে মিশরে হাসান আল বান্না কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ইখওয়ানুল মুসলেমিন’ বা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং অখন্ড ভারতবর্ষে মওলানা আবুল আলা মওদুদি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামী’। ইসলামের নামে জেহাদী সন্ত্রাসের চরম অভিব্যক্তি ছিল ’৭১-এর গণহত্যা ও নির্যাতন। জেহাদের নামে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে নয় মাস সময়ের ব্যবধানে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা, ২ লক্ষ নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন এবং ১ কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত শুধু ইসলামের ইতিহাস নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গণহত্যার ৪০ বছর পর যখন এর বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তখন অভিযুক্তরা নির্বিবাদে তা মেনে নেবে এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই, বিশেষভাবে অভিযুক্তদের সংগঠন যখন আন্তর্জাতিক জেহাদী বলয়ের অপরিহার্য অংশ। উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘জামায়াতে ইসলামী’, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ‘জামা-আল ইসলাম’ এবং মধ্য এশিয়ার ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ নিবিড় সংযোগ রক্ষার মাধ্যমে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কাজ করছে। আফগানিস্থান ও পাকিস্তানের যে আলকায়দা ও তালেবানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা জগৎ ‘ওয়ার অন টেরর’ ঘোষণা করেছে তারা ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও ‘জামায়াতে ইসলামী’র ভাবশিষ্য। খোমেনি, মওদুদি, সাইয়িদ কুতুব, হাসান আল বান্না থেকে আরম্ভ করে মোহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব ও ইবনে তায়মিয়া এদের আদর্শিক গুরু। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের অবসানের পর যে আদর্শিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি পূরণের জন্য আবির্ভূত হয়েছে রাজনৈতিক ইসলাম তত্ত্ব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা তাদের প্রধান রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন মুসলমানপ্রধান দেশে এই রাজনৈতিক ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার সময় এ কারণেই আমেরিকা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশে ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ যৌক্তিক কারণেই আমেরিকা এবং মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওআইসি’র কিছু সদস্য সহজভাবে গ্রহণ করেনি। কারণ, তারা জানে এই বিচার ’৭১-এর গণহত্যার ভয়াবহতা ও ব্যাপকতার পাশাপাশি হত্যাকারীদের রাজনীতি এবং তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থকদের মুখোশ উন্মোচন করবে।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ’৭১-এর প্রসঙ্গ এখনও উপেক্ষিত বিষয়।
আমেরিকার পাশাপাশি সৌদি আরব ও তুরস্কের নেতৃত্বে ওআইসির দেশগুলো কীভাবে তাদের প্রধান মিত্র পাকিস্তানকে ’৭১-এ মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যায় সহায়তা করেছে এটি আলোচিত হলে বিড়ম্বিত হতে হবে এই ভয় থেকেই তারা গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। ২০১১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিফেন র্যাপ একাধিকবার বাংলাদেশে এসে এ কথাই সরকার ও নাগরিক সমাজকে বোঝাতে চেয়েছেন জামায়াত ইসলামী একটি ‘মডারেট ইসলামী দল’, ’৭১-এর গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এর বিচার ঠিক হবে না। ২০১২-এর ডিসেম্বরে স্বয়ং তুরস্কের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে প্রধান অভিযুক্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়ার কথা বলেছেন। সৌদি আরব, পাকিস্তান ও মিশরে জামায়াতের সহযোগীরা সর্বাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে গোটা ‘ওআইসি’কে এই বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার জন্য, যদিও সরকারিভাবে কেউ এখন পর্যন্ত বিচারের বিরোধিতা করেনি। এই বিচার বন্ধের জন্য জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা কীভাবে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে, কীভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তারা লবিং করছে এর বিবরণ জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক ‘সংগ্রাম’ ও ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা কোথাও দৃশ্যমান নয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে যখন দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় তখন জামায়াতের প্রধান মতিউর রহমান নিজামী একবার বলেছিলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে জামায়াত এই সরকারকে সমর্থন করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গত ২১ বছর ধরে দেশে ও বিদেশে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বহু সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার মহাজোট প্রধানতঃ এ কারণেই বিশাল বিজয় অর্জন করেছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তবে বিচার কীভাবে হবে এ নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ভেতর বিভ্রান্তিও কম ছিল না। যে কারণে ১৯৭৩-এর আইন অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
সভ্য মানুষ যখন থেকে যুদ্ধের আইন ও বিধান প্রবর্তন করেছে তখন থেকে এসব লংঘনের ঘটনাও ঘটছে, যা সাধারণভাবে যুদ্ধাপরাধ নামে পরিচিত। আধুনিক আইনে ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘আগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনা’ প্রথম সংজ্ঞায়িত হয়েছে নুরেমবার্গের ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনালে’ যা ‘নুরেমবার্গ ট্রাইবুনাল’ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নাৎসিদের প্রধান ঘাঁটি নুরেমবার্গে এই বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনাল ফর দি ফার ইস্ট’ যা ‘টোকিও ট্রাইবুনাল’ নামে পরিচিত। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লাইপজিগে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ প্রহসনে পরিণত হয়েছিল প্রয়োজনীয় আইন এবং উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার অভাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বহু দেশে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু বাংলাদেশের আগে কোন দেশ এসব অপরাধের বিচারের জন্য নুরেমবার্গ বা টোকিওর মতো বিশেষ আইন ও আদালত গঠন করেনি।
যে আইনের অধীনে বর্তমানে ’৭১-এর ঘাতক দালালদের বিচার হচ্ছে এই আইন বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়েছে ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩’ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নুরেমবার্গ ট্রায়াল’, ‘টোকিও ট্রায়াল’ ও ‘ইয়ামাশিতা ট্রায়াল’ (ম্যানিলা)-এর মডেলে এই আইন প্রণীত হয়েছে এবং এসব আইনে যে সীমাবব্ধতা ছিল সেগুলো বাংলাদেশের আইনে অতিক্রম করা হয়েছে। এই আইন ভবিষ্যতে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ বা বাতিল করতে না পারে এর জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমবারের মতো সংশোধন করেছিলেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে ’৭১-এর ঘাতক দালালদের চলমান বিচার বন্ধ করে দিলেও ’৭৩-এর আইন বাতিল করতে পারেননি এর সাংবিধানিক সুরক্ষার কারণে।
জামায়াত যখন বুঝেছে ’৭৩-এর আইনে বিশেষ ট্রাইবুনালে তাদের বিচার হলে পরিত্রাণের কোন উপায় থাকবে না তখন থেকে তারা এই আইনের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে অপপ্রচার আরম্ভ করেছে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানিদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশীদের বিচারের যথার্থতা, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা, ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে বিচার না করে ফেরত দেয়া, ৪০ বছর পর বিচারের যৌক্তিকতা, ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া, এই বিচার বিরোধী দল দমন এবং ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ ইত্যাদি বলে বিচার বিঘিœত, বিলম্বিত ও বানচালের জন্য এক বিশাল ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের একটি অংশকে বিভ্রান্তও করতে পেরেছে। আমরা জামায়াতের উত্থাপিত সকল প্রশ্ন ও অভিযোগের জবাব গত ২১ বছর ধরে দিচ্ছি, কিন্তু সরকারিভাবে এসব মোকাবেলার কার্যকর কোন পদক্ষেপ এখনও দেখছি না।
বিচারের পদ্ধতি, জটিলতা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে গত চার বছরেও সরকারের নীতি নির্ধারকদের ধারণা স্বচ্ছ হয়নি। এখনও বিচার কার্যক্রম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এবং বার বার হোঁচট খাচ্ছে। ট্রাইবুনালে সরকার পক্ষে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ আইনজীবীর অভাবের কথা বার বার বলা হলেও সরকারের নীতি নির্ধারকরা এর প্রতি কর্ণপাত করছেন না।
যার ফলে এখন এ্যাটর্নি জেনারেলকে এনে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যানের টেলিফোন সংলাপ চুরি করে রেকর্ড করা এবং বাইরে পাচার ও প্রকাশ ট্রাইবুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে। তুরস্ক থেকে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসা মুসলিম ব্রাদারহুডের ১৪ জন আইনজীবী কীভাবে পেছনের দরজা দিয়ে ট্রাইবুনালে ঢুকলেন, কীভাবে প্রধান আসামী সহ ট্রাইবুনালের আইনজীবী, আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বললেন এ নিয়ে কোন তদন্ত হচ্ছে বলে শোনা যায়নি। ট্রাইবুনালের বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দলিল কীভাবে বাইরে পাচার হয়েছে এ নিয়েও কোনও তদন্ত হয়নি। ট্রাইবুনাল গঠনের সময় কেন জামায়াতের একজনকে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কে কার সুপারিশে বা নির্দেশে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন এ নিয়ে আমরা তদন্ত দাবি করেছিলাম ট্রাইবুনালের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে।
নিরাপত্তা বলতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিচারক বা আইনজীবীদের গানম্যান দেয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। এই ‘গানম্যান’দের ভেতর জামায়াতের রোকন আছে কীনা এটি জানার দায়িত্ব কারও নেই। ২০১১ সালে পাকিস্তানে পাঞ্জাবের গভর্ণর সালমান তাসিরকে তার মৌলবাদী গানম্যানই হত্যা করেছিল। কিছুদিন আগে ট্রাইবুনালের রেজিস্ট্রার জেনেছেন তাঁর একজন গাড়িচালক ছিল জামায়াতের রোকন।
ট্রাইবুনালে কমপক্ষে ৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা ও ১০ জন অপারেটর প্রয়োজন।
বর্তমানে ক্যামেরা আছে ১৬টি কিন্তু কোন অপারেটর নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু’জন অফিসকালে এসে একটি মনিটরে গোটা ট্রাইবুনালের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করেন।
সরকারের কোন কোন মন্ত্রী বা নেতা এসব নিয়ে কথা বলায় উল্টো আমাদের অজ্ঞতার সমালোচনা করেন নাকি আমরা হতাশা সৃষ্টি করছি। এই ট্রাইবুনাল ও বিচারকে কেন ফৌজদারি আদালতের মতো মামুলি বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে এর মাহাত্ম্য অনুধাবন আমাদের মতো অজ্ঞজনদের উপলব্ধির অতীত। নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে প্রথম দফায় ২১ জন ব্যক্তি ও ৭টি সংগঠনের বিচারের জন্য প্রসিকিউশনের সদস্য এবং তাদের সহকারীদের সংখ্যা ছিল হাজারের কোঠায়, অথচ আমাদের ট্রাইবুনালে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পূর্ণকালীন এক ডজন আইনজীবীও নেই।
মিডিয়া সেল, গবেষণা সেল, লাইব্রেরি ও আর্কাইভ-এর অভাবের কথা বলে বলে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তদন্ত সংস্থার অর্গানোগ্রাম প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অনুমোদন করা হলেও জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে এটি অর্থ মন্ত্রণালয় অবধি এসে স্থবির হয়ে গেছে। তদন্ত সংস্থার সঙ্গে প্রসিকিউশনের এবং প্রসিকিউশনের ভেতরকার সমন্বয়হীনতার জন্য কে বা কারা দায়ী, কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোন উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। সরকার পক্ষের সাক্ষীরা একের পর এক গুম হয়ে যাচ্ছেন, ট্রাইবুনালে আসতে ভয় পাচ্ছেন এত বলার পরও এখন পর্যন্ত সাক্ষী নিরাপত্তা আইনটি তৈরি হয়নি।
ট্রাইবুনালের ভেতর জামায়াত শুরু থেকেই কালক্ষেপণের কৌশল অবলম্বন করেছে।
আইনে সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও ১ নম্বর ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর মামলার পুনঃশুনানির জন্য আসামী পক্ষ যেভাবে আদালতের সময় নষ্ট করেছে তাতে জামায়াতের স্বার্থসিদ্ধি হলেও বিচার বিলম্বিত হয়েছে, ট্রাইবুনালের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে। এ বিষয়ে প্রসিকিউশনের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এত স্বল্প সংখ্যক আইনজীবীর পক্ষে জামায়াতের বিশাল ডিফেন্স বহর মোকাবেলা সম্ভব নয়।
জামায়াতের ভান্ডারে বিপুল অর্থ আছে আমরা জানি, কিন্তু এই অর্থের উৎস আমরা জানি না। ওয়াশিংটনের ‘ক্যাসেডি এ্যান্ড এসোসিয়েটস’কে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেনদরবার করবার জন্য জামায়াত নেতা ও ইসলামী ব্যাংক-এর সাবেক চেয়ারম্যান মীর কাশিম আলী যে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিলেন এ নিয়ে কোনও তদন্ত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
খালেদা জিয়ার আমলেও জঙ্গী সম্পৃক্ততার জন্য ইসলামী ব্যাংককে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। এ সরকারের আমলে সরকারের উন্নয়নের সহযোগী হয়েছে জামায়াতের এই প্রধান ব্যাংক, যার বিরুদ্ধে জঙ্গীদের অর্থ আদানপ্রদানের বহু তথ্য প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার করা হবে আর জামায়াত ঘরে বসে তা দেখবে? যারা ভাবছেন দলের বিচার না করলে জামায়াত কিছু করবে না তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার করা হবে অথচ জামায়াতের বিচার ঠিক হবে না এমন বিবেচনা কেউটে সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর মতো বিপদজনক।
আমরা গত ২১ বছর ধরে বলছি ’৭১-এর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে হবে এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা টেলিভিশনের টক শো’-এ বলেন এই দাবি নাকি অগণতান্ত্রিক, নিষিদ্ধ করলে জামায়াত ও জঙ্গীরা আরও শক্তিশালী হবে, এতে নাকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব অপযুক্তি সম্ভবতঃ সরকারের নীতি নির্ধারকদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। মাননীয় আইনমন্ত্রী যখন বলেন, আমরা এই ট্রাইবুনালে শুধু ব্যক্তির বিচার করব, সংগঠনের বিচার করব না তাতে জামায়াত সন্তুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সংগঠনের বিচার না করলে ৩০ লক্ষ শহীদদের পরিবার ও স্বজনদের বঞ্চিত করা হবে ন্যায়বিচার থেকে এই সত্যটি মন্ত্রীরা বুঝতে চান না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের ৯৯ ভাগ সদস্য বলতে পারবেন না কোন ব্যক্তি তাদের প্রিয়জনদের হত্যা করেছে। তারা জানেন হত্যাকারীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর বা আল শামস এর মতো ঘাতক সংগঠনের সদস্য।
গো.আযম গং ’৭১-এ যেসব অপরাধ করেছেন সেগুলো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা পারিবারিক শত্রুতাবশতঃ ছিল না। ’৭১-এর গণহত্যা ঘটেছে পাকিস্তানি সরকার এবং কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। গো. আযমরা মওদুদির রাজনীতি ও দর্শন অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন।
২০১৩ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কীভাবে হবে এর মীমাংসা যদি হয়ও শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি যদি নির্বাচনের আগে নিশ্চিত না হয় তার মাশুল শুধু মহাজোটকে নয়, গোটা জাতিকে দিতে হবে।
যাদের বিচার শুরু হয়েছে সেগুলো যদি এ সরকারের মেয়াদকালে শেষ না হয় বাংলাদেশে আর কখনও তা সম্ভব হবে না। এই বিচার নিয়ে প্রথম দিকে দেশে ও বিদেশে মানুষের যে আগ্রহ ছিল তাতে এখন ভাটা পড়েছে প্রধানতঃ সরকারের নীতি নির্ধারকদের উপলব্ধির অভাবে। জামায়াতের অপপ্রচারে এবং বিচারবিরোধী ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে মানুষ যেমন ক্ষুব্ধ, একইভাবে ক্ষুব্ধ জঙ্গীসম্পৃক্তি এবং ’৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্তির অপরাধে জামায়াতের বিচার না হওয়ায়।
গত ৬ জানুয়ারি (২০১৩) মহাজোট সরকারের চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘প্রথম আলো’য় বিভিন্ন বিষয়ে যে জনমত জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে তার ভেতর দুটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে। ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে কি?’ এ প্রশ্নের জবাবে ২০০৯ সালে উত্তরদাতাদের ৮৬% ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪%-এ।
ট্রাইবুনালের লোকবল, রসদ ও নিরাপত্তার ঘাটতি যদি অব্যাহত থাকে, জামায়াতের বহুমাত্রিক চক্রান্ত সম্পর্কে সরকার যদি আগের আগের মতো উদাসীন থাকে ২০১৩ সালের শেষে সরকারের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা এ ক্ষেত্রে কোথায় এসে দাঁড়াবে ভেবে শঙ্কাবোধ করছি।
‘প্রথম আলো’র জরিপে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের পক্ষে ৫৮% উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, ৪১% বলেছেন ‘না’। যদি নির্দিষ্টভাবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হত আমি মনে করি অন্ততপক্ষে ৮০% উত্তরদাতা ‘হ্যাঁ’ বলতেন। বাংলাদেশ সহ উপমহাদেশের বহু ধর্মীয় সংগঠন এবং আলেম-উলামারা মনে করেন জামায়াত রাজনীতির নামে ইসলাম ধর্মকে কলঙ্কিত করছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার উপর যদি গণভোট হয় এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় সিংহভাগ মত হবে নিষিদ্ধকরণের পক্ষে।
তবে ’৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার দায়ে জামায়াতের বিচারের জন্য গণভোটের প্রয়োজন নেই। নির্বাচকমন্ডলী ২০০৮-এর নির্বাচনেই এই ম্যান্ডেট মহাজোটকে দিয়েছে। আমজনতা যা চান সরকারের বিজ্ঞ নীতি নির্ধারকরা যদি তা না বোঝেন তাহলে বুঝতে হবে সর্বনাশের আর বাকি নেই।
উৎস : -
১. যুদ্ধাপরাধের বিচার --- শাহরিয়ার কবির -- একাত্তরের ঘাতক দালাল নর্মিূল কমিটি।
২. গণআদালত ও জাহানারা ইমাম আর কতদিন -- একাত্তরের ঘাতক দালাল নর্মিূল কমিটি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।