আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষমতায় যাওয়ার বিনিয়োগ ও ক্ষমতাসীনদের তান্ডব

ক্ষমতায় যাওয়ার বিনিয়োগ ও ক্ষমতাসীনদের তান্ডব ফকির ইলিয়াস ====================================== বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি দেশে 'ক্ষমতায় যাওয়ার বিনিয়োগ' করেই যাচ্ছে। কোটি টাকার রোডমার্চ করছে দেশের প্রত্যেকটি বিভাগে। লক্ষ্য একটাই জনগণকে সংঘবদ্ধ করা। ক্ষমতায় যাওয়া। বিএনপি জন্ম থেকেই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল।

তাদের জন্মই হয়েছিল হত্যা এবং ক্যু-এর মাধ্যমে। এটা দেশবাসীর অজানা নয়। বিএনপি যে কোন সংস্কারের বিরোধিতা ঠিকই করে। কিন্তু ফলাফল তাদের অনুকূলে গেলে মৌনতা অবলম্বন করে তারা তা মেনে নেয়। একটি সম্প্রতি উদাহরণ দেয়া যাক।

বিএনপি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতির তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। এই বিরোধিতার কারণে বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারকে শেষ মুহূর্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয় তিনি সরে দাঁড়ান। একইভাবে বিএনপি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। সাক্কু তা মেনে নেননি। তাই তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সেই মনিরুল হক সাক্কু প্রায় ত্রিশ হাজার ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইভিএম পদ্ধতির বিরোধিতা করেই সাক্কুকে বহিষ্কার করে বিএনপি। অথচ সেই পূর্ণ ইভিএম পদ্ধতির ভোটেই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাক্কু। নির্বাচিত হওয়ার পর পরই তিনি বিএনপিতে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিএনপির চিপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে তার ফোনে কথাও হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।

বিএনপি তাকে ফিরিয়ে নেবে বলেও ধারণা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। নির্বাচনে ফলাফল বিএনপির পক্ষে গিয়েছে এবং তা হয়েছে ইভিএম পদ্ধতির ভোটে। আর সেই ফলাফলে সাক্কু মেয়র হয়েছেন। মনিরুল হক সাক্কুকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপিতে ফিরিয়ে নেয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকারান্তরে ইভিএম পদ্ধতি মেনে নেয়া। বেগম জিয়া রোডমার্চের পথে চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রাক্কালে ফেনীতে জনসভা করেছেন।

সেই জনসভা মঞ্চে মেয়র সাক্কু, বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণের সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হাসিমুখে। সে চিত্র আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি। এর অর্থ হচ্ছে সাক্কুর বিএনপিতে ফিরে যাওয়া এবং পুরস্কৃত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কুমিল্লার মেয়র পদটি পাওয়ার পর বিএনপি তা গ্রহণ করবে সেটাই স্বাভাবিক বিষয়। তাহলে তারা ইভিএম পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন কেন? কেন বার বার বলছে, ইভিএম পদ্ধতি তারা মেনে নেবে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান বিচারপতি (অব.) হাবিবুর রহমান বিভিন্ন সমাবেশে বারবার বলছেন, কোন সভ্য জাতি এ পদ্ধতি মেনে নিতে পারে না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, গণতান্ত্রিক সভ্য কোন দেশে পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে সৃজনশীল রাজনীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে না। আর তা অব্যাহত না থাকলে সুস্থ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তার কথাটি তাত্তি্বকভাবে মিথ্যা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ কিংবা বাঙালি জাতি গত চার দশকে সার্বিকভাবে তেমন সুসভ্য কি হতে পেরেছে? না পারেনি।

আর পারেনি বলেই একাত্তরের নরঘাতক আলবদর-রাজাকার চক্র ফুলে-ফেঁপে বিত্তবান হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারাও হয়ে উঠেছে কেয়ারটেকার সরকারের তাত্তি্বক রূপকল্পের দাবিদার। এটা শহীদের রক্তের চরম অবমাননা তো বটেই। এর জন্য দায়ী কে? কারা এদের পুনর্বাসনে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে? চট্টগ্রামের রোডমার্চ শেষে বেগম জিয়া যে ভাষণ দিয়েছেন, তার যথার্থ ইচ্ছে যে কোন মূল্যে বর্তমান মহাজোট সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া এবং তার বিগত পরিষদের সব দুর্নীতি মুছে দিয়ে ক্ষমতা ও দখলের নব্য সংস্করণ করা। একটি বিষয় খুব স্পষ্ট বাংলাদেশে এই সময়ে মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে।

কিন্তু তাই বলে কি বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে? না বাড়েনি। না বাড়ার কারণগুলো হচ্ছে, খালেদা জিয়ার চরম দুর্নীতির বিভিন্ন সাক্ষী প্রমাণ প্রকাশ, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বেগম জিয়া ও তার দলের স্পষ্ট অবস্থান, সরকারের অপকর্মগুলোর সঠিক সমালোচনা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার নানা রকম শর্টকাট রাস্তা খোঁজা ইত্যাদি। বেগম জিয়া তরুণ প্রজন্মের হাতে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব তুলে দেয়ার কথা বলছেন। অন্যদিকে এই তরুণ প্রজন্মের সব ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে ঘাতক রাজাকারদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন বেগম জিয়া। মনে রাখা দরকার, নতুন ভোটারদের লাখ লাখ ভোটেই বর্তমান সরকার ব্রুট মেজরিটি পেয়েছে।

আর নব্য লাখ লাখ ভোটারের প্রাণের দাবি ছিল, ঘাতক রাজাকার আল-বদরদের বিচার চাই। এই দাবিকে অবজ্ঞা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বেগম জিয়া কীভাবে দেখছেন? সুবিধাবাদ কখনই কোন শুদ্ধ রাজনীতির প্রতীক বহন করে না। ইভিএম মানবেন না, আর এই পদ্ধতিতে নিজেদের প্রার্থী ভোটে জিতলে তাকে হালাল করে নেবেন, তা হলো দ্বৈত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। নিজে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও চিহ্নিত আলবদর-রাজাকারদের সরাসরি মন্ত্রিত্ব দিয়ে জেনারেল জিয়াও তেমনি দ্বৈত চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিএনপি সেই উত্তরসূরির ভূমিকা ঠিক মতোই ধরে রেখেছে।

বর্তমান সরকার তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে। এ তিন বছরে তারা আরও অনেক কিছু করতে পারত। বিশেষ করে দলীয় দখলদার বাহিনীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সরকারের ইমেজ উজ্জ্বল থাকত। যিনি দলের চেয়ারম্যান তিনিই প্রধানমন্ত্রী নন এমন উদাহরণ প্রতিবেশী ভারতেই রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি গত চার দশকে।

পার্টিপ্রধান পার্টি চালাবেন। আর প্রধানমন্ত্রী চালাবেন সরকার। এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশেও হতে পারত। তাহলেই গণতন্ত্র সুসংহত হতো। এটা বড় দুই দলই মানেনি।

হয়তো মানবেও না। তার ওপর রয়েছে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানা রকম উসকানি দিয়ে বক্তব্য দেয়ার অপচেষ্টা। চট্টগ্রামে বেগম জিয়া বলেছেন, সেনাবাহিনীর সদস্যদের নাকি গুম করা হচ্ছে। তার এই বক্তব্যের দুই দিনের মধ্যেই এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে আইএসপিআর। তারা বলেছে, সেনাবাহিনীর নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে এবং তা মেনেই চলছে আন্তঃগণসংযোগ বিভাগ।

সেনাবাহিনীর বিষয় নিয়ে এমন মিথ্যা বক্তব্যের নিন্দাও করা হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিডিআর হত্যাকান্ডে পিলখানার ঘটনা বেগম জিয়ার উসকানি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। এই লেখার শুরুতেই বলেছি, বিএনপি ক্যু করে শর্টকাটে ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তাই এসব বিষয় নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টা বেগম জিয়ার পক্ষেই সম্ভব। যে সেনানিবাসের বাড়ি তিনি খুইয়েছেন সে বেদনা ভুলতে তার কষ্ট তো হচ্ছে বটেই।

এটা এ দেশের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা বারবার বলেছেন, জঙ্গিবাদীদের দোসর করে রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যেতে এবং টিকে থাকতে ভালোবাসে বিএনপি। কিন্তু এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক প্রজন্ম তা হতে দিতে পারে না। বিশেষ করে পাকিস্তানের আদলে তালেবানি রাষ্ট্র কায়েমের অপচেষ্টা সফল হলে দেশ চির অন্ধকারে নিপতিত হবে। কথাগুলো মনে রাখার অন্যতম দায়িত্ব বর্তমান মহাজোট সরকারেরও। সাতক্ষীরায় একজন নৃত্যশিল্পীকে ধর্ষণের অপচেষ্টা কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জোবায়ের হোসেন হত্যাকান্ডের পর বর্তমান ছাত্রলীগ সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় নামিয়েছে, তা ভেবে দেখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

প্রধানমন্ত্রী মাত্র ক'দিন আগে একটি পুলিশ সমাবেশে বক্তৃতাকালে নারী ও শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে পুলিশ বাহিনীকে অনুরোধ করেছেন। সেই নারীই ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রলীগের কিছু পাষন্ডের হাতে। এর চেয়ে চরম দুঃখ ও লজ্জাজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে। দেশে সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা ঘোরতর হতে পারে। তাই সরকারকে সতর্ক হতে হবে।

নিজেদের শুদ্ধির মাধ্যমে। ১১ জানুয়ারি, ২০১২ নিউইয়র্ক। ------------------------------------------------------------------------------ দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ১৩ জানুয়ারি ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.