আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে

ঢাকা মেডিকেল সহ দেশের আরও শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোকে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত । আসুন বাস্তবতার নিরিখে দেখি এই সিদ্ধান্ত দেশ,জনগন ও ডাক্তার সমাজের জন্য কি বয়ে আনছেঃ • মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হল দেশের নিঃস্ব জনগণের চিকিৎসার শেষ আশ্রয়। এখানে লাখ লাখ রোগী বিনা পয়সায় যে চিকিৎসা পাচ্ছে তার দ্বার অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। • দেশের জরুরী স্বাস্থ্য সেবার বেশীর ভাগই এসব হাসপাতালে হয়ে আসছে, তাও অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে যেমনটি হয়েছে বিএসএমএমইউ তে। • বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে জরুরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

ভাংচুর এবং আইনি বেড়াজালের ভয়ে কেউ আর জরুরী স্বাস্থ্য সেবা দিতে সাহস পাচ্ছেন না। তাই এসব হাসপাতালে রোগীর চাপ পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ইউনিভার্সিটি হলে এইসব রোগী কোথায় চিকিৎসা পাবে? অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। • এখন এইসব হাসপাতালে ধারণক্ষমতার ৩-৪ গুন বেশী রোগী থাকে। ইউনিভার্সিটি হলে তা সম্ভব হবে না।

তখন এইসব রোগী কোথায় যাবে? • সরকারী অনুদান অনেক কমে যাবে আর এর বিপুল পরিমান ব্যয় ভার সরাসরি জনগণকেই বহন করতে হবে । • এখন এইসব হাসপাতালে প্রায় সব পরীক্ষা- নিরীক্ষা বিনামূল্যে হচ্ছে, ইউনিভার্সিটি হলে তা হবে না • সমস্ত অপারেশান এখানে বিনামূল্যে হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি হলে কমপক্ষে ৫০ ভাগ রোগীকে অপারেশান এর জন্য পয়সা দিতে হবে। • বহিঃবিভাগের সব রোগীরা বিনামূল্যে প্রচুর পরিমানে ঔষধ পান। ইউনিভার্সিটি হলে তা অনেক কমে যাবে।

• বহিঃবিভাগের টিকেট এর মূল্য এখন মাত্র ১০ টাকা। ইউনিভার্সিটি হলে তা বেড়ে কমপক্ষে ৩০-৫০ টাকা হবে। • কেবিন ও পেয়িং বেড এর ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে। অপারেশান এর চার্জ সাধারন জনগণের আওতার বাইরে চলে যাবে। • সারা দেশের সমস্ত জটিল রোগী এইসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে ।

সবার শেষ ভরসা এইসব হাসপাতাল। এখানে এসে রোগীরা সীট না পেলেও মেঝেতে বা বারান্দায় শুয়েও চিকিৎসা পাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি হলে তা বন্ধ হয়ে যাবে । • দেশের যেকোনো জরুরী পরিস্থিতিকে সামাল দিতে এইসব হাসপাতাল সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। যেমনঃ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা, ৫২-৭১ সবসময় এই সেবা পেয়ে এসেছে দেশের আপামর জনসাধারন, ১৯৭১ এ জনগণের চিকিৎসা দিয়েছে, ১৯৯০ এর গণআন্দোলনে, ২১শে আগস্টে এ ঢাকা মেডিকেল এর দ্বার বন্ধ থাকলে কি হতো চিন্তা করেন।

যেকোনো জরুরী স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেল সহ এইসব হাসপাতাল জনগণের যে অফুরন্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। • আল্লাহ্‌ না করুন যদি ঢাকা শহরে কোন দুর্ঘটনা/ ভুমিকম্প হয় তবে জনগণের চিকিৎসা কোথায় হবে যদি ঢাকা মেডিকেল কলেজকে বন্ধ করে ইউনিভার্সিটি করা হয়!! • এসব হাসপাতাল ইউনিভার্সিটি হলে নিঃস্ব ,অসহায়, ছিন্নমূল মানুষগুলো কোথায় চিকিৎসা পাবে একবার ভেবে দেখেছেন কি? • এইসব হাসপাতাল হল ডাক্তার তৈরির কারখানা। হাজার হাজার সরকারী ও বেসকারি ডাক্তার এখানে ট্রেনিং নিয়ে মান সম্মত ডাক্তার হয়ে সারা দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছেন । এই ট্রেনিং এর জন্য সারা দুনিয়ায় এইসব হাসপাতালের বিকল্প একটিও নেই। সারাদেশের প্রায় সব ডাক্তার পর্যায়ক্রমে এইসব হাসপাতাল হতে ট্রেনিং নিয়ে থাকেন।

ইউনিভার্সিটি হলে সরকারী ডাক্তারদের জন্য এখানে ট্রেনিং নেয়া প্রায় অসম্ভব হবে। বেসরকারি ডাক্তাররাও সে সুযোগ হতে বঞ্চিত হবেন। যেমনটি এখন বিএসএমএমইউ তে হচ্ছেন। • সরকারী ডাক্তাররা প্রথম ২-৩ বছর অনেক আশা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে জনগণের সেবা দেন। তাঁদের আশা তাঁরা এই সময়টা কাটিয়ে মেডিকেল হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা ও ট্রেনিং গ্রহন করে বড় ডাক্তার হয়ে সারা দেশে আবার ছড়িয়ে পড়বেন জনগণকে বিশেষায়িত সেবা দানের জন্য।

তাঁরা যখন দেখবেন তাঁদের উচ্চ হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ ক্ষীণ তখন আর তাঁরা সরকারী চাকুরী বা গ্রামে যেতে চাইবেন না। এতে সাধারন জনগন স্বাস্থ্য সেবা হতে বঞ্চিত হবে। • দেশের শ্রেষ্ঠ সরকারী মেডিকেল কলেজগুলো হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়; আর স্নাতক কোর্স অনেকটাই চলে যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। সুতরাং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এসব স্থানে পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে না। • রোগী ভর্তি যেহেতু কমে যাবে এঁদের শিক্ষার মানও অনেক কমে যাবে।

কারন মেডিকেল এর আসল পড়াশুনা হল রোগী নিয়ে পড়াশুনা। রোগীই যদি না থাকে তাহলে কিসের আর পড়াশুনা। মান সম্মত ডাক্তার এর সঙ্কটে পড়বে দেশ। একটা কথা চালু আছে কেউ যদি শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ ঘুরাফেরা করে তাহলেও সে অনেক ভালো ডাক্তার হতে পারবে। এটা এ জন্য যে এখানে শুধু রোগী আর রোগী।

এটা একটা প্রাকটিকাল যায়গা। ভালো ডাক্তার হতে হলে রোগী দেখার বিকল্প নেই। আসলেই সারা দুনিয়ায় এই হাসপাতালের মতো আর একটি শিক্ষালয় হাসপাতাল আছে কিনা সন্দেহ। • অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এইসব এমবিবিএস কোর্স ইউনিভার্সিটি হলে বন্ধও হয়ে যেতে পারে। আর তাহলে,আর মান সম্মত ডাক্তার তৈরি হবে না।

• বর্তমানে অনেক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হচ্ছে। বেশীর ভাগ বেসরকারি মেডিকেল এ তেমন রোগী দেখার সুযোগ হয় না। তাই সবাই এমবিবিএস পাস করে ছুটে আসে এইসব হাসপাতালে ও বিনা বেতনে ট্রেনিং নিয়ে মান সম্মত ডাক্তার হচ্ছেন। ইউনিভার্সিটি হলে সে সুযোগ অনেকাংশেই কমে যাবে। যা হয়েছে বিএসএমএমইউ তে, আইপিজিএমআর(পিজি) কে অবলুপ্ত করার পর।

দেশে তখন মানসম্মত ডাক্তার এর সঙ্কট দেখা দিবে। • দলীয় লোক নিয়োগের কারনে এইসব হাসপাতাল অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এঁদের চাকুরী স্থায়ী ও বদলীযোগ্য নয় বলে একই বেক্তি স্থায়ীভাবে ট্রেনিং পদ ধরে রাখার কারনে দেশের অসংখ্য মেধাবী ডাক্তার উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং গ্রহন থেকে বঞ্চিত হবেন। আজ যে দল ক্ষমতায় সে তার লোক ইচ্ছামতো ঢুকাবে , দুদিন পর অন্য দল ক্ষমতায় এসে তার লোক ইচ্ছামতো ঢুকাবে। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান গুলো দলীয় লোকের আস্তানায় পরিণত হবে; বিএসএমএমইউ এর জ্বলন্ত উদাহরন।

নিয়োগ বাণিজ্য ,ভর্তি বাণিজ্য ,ডিগ্রি বাণিজ্য অবাধে শুরু হবে। দেশের স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষার যে কি হাল হবে ভাবতেই শিউরে উঠি। • বিশ্ববরেণ্য এইসব প্রতিষ্ঠানের নাম নিশানা মুছে দিয়ে নুতন ভাবে নামকরন করলে এখান হতে পাস করে সবাই পরিচয় সঙ্কটে ভুগবে । এইসব মেডিকেল কলেজ এর ৬০-৭০ বছরের ইতিহাস, জশ,দুনিয়াজোড়া খ্যাতি, পরিচিতি, সুবিধা সব মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। সারাবিশ্বের মানুষ যেখানে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে গর্বের সাথে আগলে রাখে সেখানে আমরা হীন ব্যক্তি স্বার্থে এহেন গর্হিত কাজে হাত দিয়েছি,এগুলোকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করছি।

দেশের এতো বছরের গড়ে ওঠা এইসব প্রতিষ্ঠানের নাম নিশানা মুছে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছি। কোন সভ্য সমাজ এতে সায় দিতে পারে না। • শুধুমাত্র যারা ইউনিভার্সিটি হলে ওখানে ঢুকতে পারবে তাঁদের কিছু ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া আর কিছুই লাভ হবে না। না জনগণের কোন লাভ হবে, না দেশের কোন লাভ হবে, না অন্যান্য ডাক্তারদের কোন লাভ হবে, না মেডিকেল ছাত্রদের কোন লাভ হবে। বরং সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আসুন সবাই একটু নিরপেক্ষভাবে ভাবি , আসলে আমরা এইসব হাসপাতালকে ইউনিভার্সিটি করে দেশ ও জাতিকে কি দিতে চাচ্ছি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো অনেক অপ্রতুল। আসুন আমরা ঐতিহাসিক স্মৃতিধন্য আমাদের প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোকে মূলউৎপাটন না করে জাতির প্রয়োজনমত নুতন যায়গায় নুতন ভবনে নুতন হাসপাতাল স্থাপন করে নুতন মেডিকেল ইউনিভার্সিটি গড়ে তুলি। আমাদের যা আছে তাকে উৎখাত উচ্ছন্ন না করে জনগণের চিকিৎসা সেবার সুযোগ ও দেশের চিকিৎসকদের উচ্চ শিক্ষার দ্বারকে আরও প্রসারিত করি। তা করলে সবাই সব দিক হতে উপকৃত হবে।

দেশ ও জাতি তাতে কিছু পাবে, কোন ক্ষতি হবে না। তাড়াহুড়া করে একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সাধারন মানুষের স্বাস্থ্য সেবার এইসব হাসপাতালকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবেন না দয়া করে। আমাদের যায়গার অভাব নাই । সময় নেন, পূর্ণ পরিকল্পনা হাতে নেন, ভালো করে নিজস্ব যায়গা নিয়ে , নুতন স্থাপনা বানিয়ে নুতন ভাবে কিছু শুরু করুন। এতে রোগীর চিকিৎসা সেবা বাড়বে, ডাক্তার ও অন্যান্য মেডিকেল লোকদের চাকুরী হবে, সবাই উপকৃত হবে।

কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ----সচেতন ডাক্তার,ছাত্র ও জনতা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.