দাম্পত্য জীবনে সেপারেশন চলছে আজ প্রায় ছয় মাস হল। তারপর থেকে দু' সন্তানকে আঁকড়ে ধরে চালিয়ে যাচ্ছি একাকী যুদ্ধ। কষ্ট হয়,কিন্তু তা শেয়ার করি শুধু নিজের সঙ্গেই। বাইরে চকচকে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলি,"এই বেশ ভালো আছি!"এভাবে চলত চলতে কখন যে বাইরের পৃথিবী আর সমাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেকে আটকে ফেলেছি একটি নির্জন ,বদ্ধ ঘরের ভেতর,নিজেও জানি না। চারিদিকে তুলে রেখেছি দুর্ভেদ্য দেয়াল,যার ভেতরে না পৌছায় কারো ভালোবাসা,না কারো করুনা।
এখন পাথর চোখে একটাই স্বপ্ন,সন্তানদের মানুষ করা। শুধু শিক্ষিত নয়,সত্যিকার শিক্ষিত মানুষ!
সন্তানদের মুখের দিকে তাকালেই ভুলে যাই সব। সব কষ্ট,সব দুঃখ,স-ব। জীবনে কি কি পাইনি তার হিসেব মনে আসে না,কি অসাধারন সম্পদ না চাইতেই পেয়ে গেছি,তাই ভেবেই তৃপ্ত হই। আর সেই তৃপ্তির ছাপ পড়ে সন্তানের চোখের ঝিলিকে,আমার উদ্দাম হাসিতে,কিংবা টবের ক্যাকটাসে ফোটা ফুলে অথবা জানালা বেয়ে আসা ঝাঁ চকচকা রোদে!
এই গতিময় সুখের রাজ্যে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটাল আমার অসুস্থতা!মা দুর্গার মতন দশহাতে যখন সামলে যাচ্ছি সংসারটাকে,তখনই কোথা থেকে যেন রাবনের মত এসে হাজির হল ডেঙ্গু!অথচ আমার তখন অসুখ কেন, মৃত্যুকেও সময় দেয়ার সময় নেই!কিন্তু অসুখ কি কথা শোনে?কাবু করে ফেলল এক নিমেষেই শরীরটাকে!
শক্ত পোক্ত শরীরটা কখনো অসুস্থ হয় না বললেই চলে।
হঠাৎ জ্বরে তাই অবাক হলাম। কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় কই আমার। তাই সামান্য জ্বর ভেবে ব্যাপারটাকে ইগনোর করে গেলাম। কিন্তু রাত বাড়তেই জ্বরও বাড়তে লাগল। ভয় পেয়ে গেলাম,নিজের জন্য নয়,সন্তানদের কথা ভেবে।
প্রথমেই মাথায় এল,ভাইরাস জ্বর হলে ওরাও আক্রান্ত হতে পারে। ওদের স্কুল,সামনে পরীক্ষা,আরো কত কিছু এক মুহূর্তে মাথার ভেতর ঘুরে গেল। না,ওদেরকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।
কিন্তু ছেলে-মেয়ে তো নাছোড়বান্দা!মা'র পাশে না ঘুমালে যে ঘুমই আসে না। এই মা'ই যে ওদের সব।
রোজ রাতে দু'জনের খুনসুটি,কে মায়ের গায়ে হাত রেখে শুবে এই নিয়ে। শেষ পর্যন্ত দুজনকেই সমান সুযোগ দিয়ে মিমাংসা করতে হয় । কিন্তু প্রচন্ড জ্বর নিয়ে ওদের মাঝে শুতে মন সরছে না।
মেঘা জিজ্ঞেস করে,"মাম্মা,তোমার গা তো এখনো গরম। ওষুধ খাওনি?"
"খেয়েছি।
"
আড়চোখে দেখি ওহী উঠে গেছে থার্মোমিটার আনতে। ছোট ছোট হাতে থার্মোমিটারটাকে ঝাঁকিয়ে এগিয়ে দেয়। মেয়ে বসে আছে পাশে গম্ভীর মুখে। যেন সন্তানের জ্বরের আপডেট জানার অপেক্ষা!আমি বাধ্য মেয়ের মত থার্মোমিটার বগলে দিয়ে বসে থাকি।
ছেলে আপডেট দেয়,১০২ ডিগ্রি।
একটু আগেই ওষুধ খেয়েছি,নিশ্চই সেরে যাবে,ভাবি। ওদেরও সেই আশ্বাস দিয়ে বলি শুয়ে পড়তে।
"আমি জেগে থাকি,মাম্মা?রাতে যদি জ্বর বাড়ে!"ওহীর কাকুতি।
"নারে,আর বাড়বে বলে মনে হয় না। তোমরা ঘুমাও।
"
"ঠিক আছে। জ্বর এলে কিন্তু ডেকে দিও। "পাকা মানুষের মত বলে দু'জন ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘন্টাখানেক পর দু'জনকে গভীর ঘুমে দেখে নিয়ে আস্তে করে উঠে পড়ি। মেয়েটার সামনেই ফাইনাল।
এ সময় জ্বর এলে পরীক্ষা খারাপ হবে। আমাকে অন্য ঘরে সরে যেতে হবে। আমার নিঃশ্বাসে বিষ তখন।
পাশের ঘরে এসে শুয়ে পড়ি বিছানায়। বুঝলাম জ্বর বাড়ছে।
সমস্ত শরীরে ব্যাথা আর কাঁপুনি । ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভীষন অসহায় মনে হয় নিজেকে। মা'র কথা ম০নে পড়ে।
আজ বেঁচে থেকলে তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম নিশ্চিন্তে। মা,তুমি কোথায়?কত দূরে?দেখো মা,আমার কেউ নেই। বড় একা লাগে মা। তোমার মত আমিও যেন অন্ধকার কবরে একা শুয়ে আছি। বড় কষ্ট মা!
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতেই দেখি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে,হাতে থার্মোমিটার । ছেলে পায়ের কাছ থেকে কম্বল টেনে দিচ্ছে গায়ে। অবাক হয়ে যাই,স্বপ্ন দেখছি না তো!
"তোমরা!"
"ঘুম ভেঙ্গে দেখি তুমি পাশে নেই। তারপর মেঘা আপুকে ডেকে বাথরুম চেক করলাম। সেখানেও তুমি নেই।
এই ঘরে এসে তোমাকে পেলাম। "ওহী উত্তর দেয়। "তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর। ডাকলে না কেন?"
আমি জলভরা চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই কবে পড়েছিলাম বায়েজিদ বোস্তামীর কথা।
আজ মনে হয়,আমার ঘরেই তো দু'জন বায়েজীদ বোস্তামি জন্ম নিয়েছেন!আমার আর কষ্ট কিসের?আমি তো একা নই!!
ছেলে কানের কাছে মুখ এনে বলে,"মাম্মা,একটা কথা বলি?"
"কি?"
"বাবাকে বলব আসতে?"
একটু থমকে যাই। যে মানুষটা নির্দ্বিধায় তার ১২ বছরের সংসার ফেলে চলে গেল শুধু ভাল লাগে না বলে,তার কাছে হাত বাড়াব সাহায্যের?তাও নিজের জন্য?আত্মসম্মানে লাগে!
"না বাবা,বলো না। বাবা তো ব্যস্ত মানুষ,খামোখা সব কাজ ফেলে চলে আসবে। কি দরকার?"
ওরা কি বোঝে কে জানে,কিন্তু কোন দ্বিরুক্তি করে না।
বাকি রাত কখন জেগেছি কখন ঘুমিয়েছি জানি না।
কিন্তু ওদের জোর করেও ঘুম পাড়াতে পারিনি। পরদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়ার তো কেউ নেই,তাই ছুটি। আমিও আর না ভেবে বেহুশের মত ঘুমিয়েই পড়ি।
সকাল হতেই দেখি দু'জনে কি যেন শলা পরামর্শ চলে। জিজ্ঞেস করি,রাগ করি,কিন্তু উত্তর পাই না।
অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকি। আমার হাতের রান্না ছাড়া তো খাবে না কেউ। দুর্বলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে রান্না শেষ করেই নিজেকে ছুড়ে ফেলি বিছানায়। আর যেন এক ফোটা শক্তিও নেই শরীরে।
অচেতন অবস্থাতেই টের পাই ছেলে নিজ হাতে ট্যাং বানিয়ে আনে।
মেয়ে মাথায় পট্টি দেয়,জ্বর মাপে। এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়ি নিজেই জানি না।
ঘুম ভাঙ্গে পরিচিত স্বরে। চোখ মেলে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে রেহান। স্তম্ভিত হয়ে যাই।
অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করি,"তুমি??!!"
"হুম,ওহী ফোন করে বলল, তোমার দু'দিন ধরে জ্বর। বার বার অচেতন হয়ে যাচ্ছ। তাই চলে এলাম। "
শরীরটাকে কোন শক্তিবলে যেন একটু উঠিয়ে বললাম,"না,না,আমি ভাল আছি। "
ওহী দৌড়ে আসে,"মাম্মা,প্লিজ,তুমি উঠো না।
বাবা ডাক্তার আঙ্কেলকে নিয়ে এসেছে। তুমি ভাল হয়ে যাবে,দেখো। "বলতে বলতে কেদে ফেলে সে। পাশ থেকে মেঘাও ফুপিয়ে উঠে মুখ লুকায়।
ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যাই।
কি এক অজানা ভয় দু'জনের মুখে। যে মা'কে কখনো উহ করতে দেখেনি,সেই মা'কেই অচেতন পড়ে থাকতে দেখে কি এক হারানোর ভয় চেপে বসেছে ওদের চোখে মুখে। ওদের যে আমি ছাড়া কেউ নেই!
বুকটা মুচড়ে ওঠে। বুঝি, ওদের ভালোবাসার কাছে হেরে গেছি আমি। না,ওদের ভয় পেতে দিব না আমি।
এতটুকু ভয়,এতটুকু কষ্টও যেন ওদের ছুতে না পারে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে হলেও ওদেরকে আমার আড়াল করে রাখতে হবে সব দুঃখ-কষ্ট-বেদনা থেকে। ওদের ছায়া দিতে হবে,রোদ দিতে হবে,অন্তত যতদিন না ওরা শক্ত শেকড় গেথে মাটিতে দাঁড়াবে!ওদের জন্য হলেও আমাকে সুস্থ থাকতে হবে বছরের ৩৬৫ টা দিন!
"কি ভাবছো?"
চমকে উঠি। "কিছু না। "একটু চুপ থেকে বলি"আমি মুখ হাত ধুয়ে আসছি,তারপর যাব ডাক্তারের কাছে।
"
"দাড়াও। " এগিয়ে এসে পাশে দাড়াল রেহান,"তার আগে বল,আমি যদি ফিরে আসতে চাই,তুমি কি গ্রহন করবে?"
বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি,স্থির। যেন কি বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। গত কয়েকটি মাসের ফ্ল্যাশব্যাক চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কত কাকুতি মিনতি,কত অনুনয়!সব কিছুকে তুচ্ছ করে রেহানের চলে যাওয়া!তারপর থেকে একার সংগ্রাম।
সমাজের কত কটুক্তি সহ্য করেও মাথা উচু করে সন্তানের হাত ধরে অজানা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা!কত রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবলই শুন্যের দিকে প্রশ্ন তোলা,কেন?কেন?কেন?উত্তর না পাওয়ার কষ্ট বুকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যে হাসির অভিনয় করা!আরো কত কি!ছয় মাস যেন ছয়শ'টি বছর পার করা!আর রেহানের কাছে মনে হচ্ছে ছয় মুহূর্ত!
"লীনা,আই'ম স্যরি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। ওহী আর মেঘার অসহায় মুখ আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি জানি,আমার প্রতি তোমার যতটা ঘৃণা ,ঠিক ততটাই ভালোবাসা। আমি তার মূল্য দেইনি কখনো।
বরং ভুল বুঝে দূরে সরে গেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আজ তোমার অচেতন মুখ আমার অন্তরকে নাড়া দিয়ে গেছে। বার বারই মনে হচ্ছে,এ আমি কি করেছি!প্লিজ লীনা,আমাকে ক্ষমা করো। আমাকে তোমার সংসারে ফিরিয়ে নাও।
প্লিজ!"
ভালোবাসা?? ঘৃণা, রেহান, ঘৃণা! প্রচন্ড ঘৃণায় পরিনত হয়েছে সেই ভালোবাসা!! কি করে বোঝাই তোমাকে। আমি আর আমি নই,শুধুই রক্তের মাংস পিন্ড!কিন্তু কি করে বলি!তুমি যে এখনো ওদের বাবা!!
দরজার আড়ালে ছেলেকে দেখতে পেলাম। কি এক প্রত্যাশা তার চোখে। বাবা-মা'কে আবার এক সাথে পাবার আশা হয়ত। আমি ওই চোখের সামনে নিজের আত্মসম্মান নিয়ে দাড়াতে পারলাম না।
ভেঙ্গে পড়লাম। চুর চুর হয়ে মিশে যাওয়ার আগে মনে মনে বললাম,"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে!"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।