জনমানুষের বিপরীতে বিশ্বায়নের স্বৈরতন্ত্র
ফকির ইলিয়াস
===================================
বিশ্ব আরেকটি নতুন বছরকে স্বাগত জানাল। ২০১২ সাল বরণ উৎসব বেশ জমজমাটভাবেই পালিত হল। নিউইয়র্কে খ্রিস্টীয় নববর্ষ পালনের একটি সুখ্যাত এলাকা আছে। ‘টাইম স্কয়ার’কে একনামে বিশ্বব্যাপী সবাই চেনে। এবারও টাইম স্কয়ারে মনমাতানো নাচ-গানে বরণ করা হয় ২০১২-কে।
হাজার হাজার মানুষের ঢল। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব কোলাহল পছন্দ করি না। তাই বছরের শেষ দিনটিতে কিছুটা আগেভাগেই প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ম্যানহাটান ছেড়ে আসি। শত শত ডাবল ডেকার বাস আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে ছুটে আসে নিউইয়র্কে। পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম অ্যাভিনিউ আর পাশের সড়কের সাইড পার্কিংগুলো ভরে যায় গাড়িতে।
এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। লাখ লাখ ডলার খরচ করে পালিত হয়েছে নববর্ষ বরণ উৎসব। এসব দেখলে মনে হয় না বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। কিংবা ‘ডিপ রিসেশনে’ কাঁপছে বিশ্বের অর্থনীতি। একই অবস্থা আমরা দেখেছি লন্ডন, প্যারিস, সিডনি, টরেন্টো কিংবা কুয়ালালামপুরেও।
তাহলে মানুষ গরিব কোথায়? টাকাকড়ি নেই কে বলল! পড়া যাক কয়েকটি খণ্ড সংবাদ।
যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে ঢল নেমেছিল উৎসবের। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারের টাইম বলটি ওপরে উঠে আলোকছটা ছড়াতে শুরু করে। শহরের মেয়র মাইকেল ব্ল-মবার্গ ও সঙ্গীতশিল্পী লেডি গাগা বর্ষবরণের উৎসবে যোগ দেন।
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে মধ্যরাতে নয়নাভিরাম আতশবাজি আর পটকার মুহুর্মুহু শব্দে মেতে উঠেছিল পুরো যুক্তরাজ্য।
সন্ধ্যা থেকেই লোকারণ্য হয়ে ওঠে টেমস নদীর দুই পাড়। উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। প্রায় আড়াই লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল টেমস নদীর ওপর আলোর খেলা দেখতে।
জার্মানিতেও বিপুল উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করা হয়। বর্ষবরণের বার্তায় জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ হবে আরও কঠিন।
তবে ইউরোপীয় ঋণ সংকট ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়াবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজিও জার্মানির চ্যান্সেলরের মতোই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০১২ সাল হবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে নতুন বছরের সম্ভাবনাও কম নয়।
একইভাবে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে বর্ষবরণের উৎসবে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উৎসব ব্যাহত হলেও থেমে থাকেনি আলো ও আতশবাজির খেলা। পুরান বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে রাশিয়ার রেড স্কয়ারে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। ব্রাজিলেও হাজার হাজার মানুষ আনন্দ-উৎসবে উদযাপন করেছেন বর্ষবরণ। রিও ডি জেনিরিওর সমুদ্র সৈকতে আয়োজন করা হয়েছিল আতশবাজির মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী।
হ্যাঁ, মানুষ পুরনোকে বিদায় জানায়।
নতুনকে পেতে চায় আনন্দ নিয়ে। কিন্তু সব চাওয়া কি পাওয়ায় পরিণত হয়? কেন হয় না? বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০১২ সাল হবে বিশ্বে একটি নতুন মেরুকরণের বছর। এ বছর মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা সব অসত্যের বিরুদ্ধে কতটা শক্ত হয়ে দাঁড়াবেন। আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরপরই ইরান-যুক্তরাষ্ট্র প্রায় মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গণবিক্ষোভ চলছে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে।
এই বিক্ষোভে কোন সমাধানে পৌঁছতে না পেরে এখনও ঝুলে আছে অনেক রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্য। সিরিয়া, ইয়েমেন ছাড়াও নতুন বছরে এ তালিকায় যুক্ত হতে পারে বাহরাইন, মরক্কোসহ সৌদি আরবের মতো মুসলিম রক্ষণশীল এবং রাজা-বাদশাহ শাসিত দেশ। ইরাক, লিবিয়া, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশে ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। এসব দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে দানা বাঁধা চাপা ক্ষোভ ২০১২ সালে বিস্ফোরিত হয়ে আন্দোলনে রূপ নেবে বলে মনে করছেন রাজনীতি-বিশ্লেষকরা। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কারণে যে কোন মুহূর্তে সেনা-অভ্যুত্থান ঘটতে পারে পাকিস্তানে।
চলতি বছরের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে, ২২ এপ্রিল ও ৬ মে ফ্রান্সে এবং ৪ মার্চ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। অবশ্যই এসব নির্বাচন বিশ্বে পরিবর্তন আনবে, নানা সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
বিশ্বের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। ফলে নিউইয়র্ক কিংবা রোমে ‘নববর্ষ-২০১২’-এর একটি ডিনার প্লেট বিক্রি হয়েছে দুই-তিন হাজার ডলারে। কোথাও এর চেয়েও অনেক বেশি দামে।
অন্যদিকে একটি স্যান্ডউইচ খেতে না পেয়ে তীব্র শীতে নিউইয়র্কের পাতাল ট্রেনের কামরায় মৃত্যু হচ্ছে জবুথবু গৃহহীনের। এই বাস্তবতা মেনেই চলছে পৃথিবীর চালচিত্র।
আমরা জানি, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে রাষ্ট্র ও সংবিধান নির্মিত সমতা বিধানের কথা বেশ জোরেশোরে বলা হয়েছিল এক সময়। অনেক দেশের সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থাকে তাদের স্বার্থের অনুকূলে বলে মনে করতে শুরু করেছিল। এভাবেই সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এক সময় বিশ্বব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল।
অনেকেই এর মাধ্যমে মানবজাতির মুক্তির দিশা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। এটা বুর্জোয়াবাদীদের চক্ষুশূল ছিল, ফলে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দুঃখের কথা হচ্ছে, যারা এক সময় সমাজতন্ত্রের উচ্চ প্রবক্তা ছিলেন, তারাই ক্রমশ হয়ে ওঠেন ধনতন্ত্রের পদলেহী। খুঁজলে দেখা যাবে এ সময়ে যারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা গরিব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বললেও নিজেরাই সবার অজান্তে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সংস্কার শুরু হলে অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়ে।
তখন বিশ্বব্যাপী এমন একটি ধারণা প্রচলিত হয় যে, মানুষের ব্যক্তিগত সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা না হলে কোনভাবেই অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। তাই মার্কিনি ছত্রছায়ায় শুরু হয় নতুন অর্থনীতির পথে যাত্রা। এভাবেই পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলতে শুরু করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির গুণগান তারা এমনভাবে শুরু করে যে সাধারণ মানুষের মনে হতে থাকে মুক্তবাজার অর্থনীতি মানেই অর্থনৈতিক মুক্তি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো উন্নত দেশের সমর্থন এবং আর্থিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে প্রশ্ন না তুলেই মুক্তবাজার অর্থনীতি মেনে নিতে শুরু করে।
পর্যায়ক্রমে পাশ্চাত্যের শিক্ষিত এলিটদের পশ্চিমা দেশগুলো প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ‘ত্রাতা’ হিসেবে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মনোনয়নদান শুরু করে। এই পশ্চিমা-ঘেঁষা কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে মন্ত্রিত্বও পান। অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে মুক্তবাজার অর্থনীতি যেন সর্বরোগ সংহারক বটিকা। বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক এই সমর্থনের কারণেই গোটা বিশ্বে লাইমলাইটে চলে আসেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র।
উন্নত দেশগুলো কথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশের বাজার দখল করে নিলেও তারা নিজেদের বাজার কিন্তু সেভাবে দরিদ্র দেশের জন্য উš§ুক্ত করেনি। আর সে কারণেই ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধে গোটা বিশ্বে ২০১১ সালে।
আসা যাক বাংলাদেশের কথায়। ২০১১ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে গেল সাড়ে তিন বছরে নতুন প্রায় ১০ হাজার কোটিপতি আমানতকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ তালিকায় শুধু ব্যবসায়ী নন, সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিক, শিল্পপতি, জমির মালিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও তাদের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে ২০১০ সালে আমানতকারী কোটিপতির সংখ্যা ছিল প্রায় ২৭ হাজার, যা ২০০৯ সালের চেয়ে প্রায় চার হাজার বেশি। ২০০১ সালে এ সংখ্যাটি ছিল পাঁচ হাজার ৭৯৯। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে কোটিপতি বেড়েছে ২২ হাজারেরও বেশি।
এই টাকা কোথা থেকে আসছে? হ্যাঁ, এরাই হাজার হাজার ডলার মূল্যের ডিনার খাচ্ছে, ঢাকায়, লন্ডনে কিংবা নিউইয়র্কে।
অথচ বেকারত্ব বিশ্বে একটি কালো হাতির নাম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে অঙ্গীকার নিয়ে এসেছিলেন, তার সিকি ভাগও পূরণ করতে পারেননি। এর হিসাব তাকে এ বছরই ভোট পরীক্ষায় দিতে হবে।
সব মিলিয়ে বিশ্বের মানুষ সত্যিকারের যে শান্তির অন্বেষণ করছেন, তা পেতে হলে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দরকার। যুদ্ধ, অবৈধ ড্রাগ ট্রাফিকিং, চোরাকারবার, মুনাফাখোরী থেকে জনমানুষকে বাঁচানো দরকার।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বায়নের স্বৈরতান্ত্রিক প্লাবন যেন ছাপোষা মানুষকে ভাসিয়ে না নেয়। কারণ যে শিশুটি হাজার ডলার রাষ্ট্রীয় ঋণ মাথায় নিয়ে আজ জন্ম নিচ্ছে, তাকেও তো এই বিশ্বেই খুদ-দানা খুঁটে খেতে হবে।
৩ জানুয়ারী ২০১২
--------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক যুগান্তর / ঢাকা / ৫ জানুয়ারি ২০১২ বৃহস্পতিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।