ঘুমাতে ভালবাসি ক্রমাগত অবহেলা, সুষ্ঠু তদারকি আর সচেতনতার অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব-ঐতিহ্য-চেতনার ধারক ভাস্কর্যগুলো জৌলুস হারাচ্ছে। অযত্ন-অবহেলায় এসব ভাস্কর্য এখন নষ্ট হওয়ার পথে। কখনো কখনো এসব ভাস্কর্য পরিকল্পিতভাবেও ভেঙে ফেলা হয়। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে টিএসসির সড়কদ্বীপে ডাস চত্বরে অবস্থিত শিল্পী শামীম সিকদারের স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ একাধিক ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ এসব ভাস্কর্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে দায়সারা গোছের একটি পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি নেয়া হলেও বছরব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যেরও বেহাল দশা। প্রাচীর না থাকায় পথচারীদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও জুতা পায়ে ভাস্কর্যটি নোংরা করছে। এ ভাস্কর্যের চারপাশে বিভিন্ন পোস্টার সাঁটানো। অনেক জায়গায় গায়ের সিমেন্ট ও পাথর ক্ষয় হয়ে গেছে। ফলে ভাস্কর্যটি দিন দিন জৌলুস হারাচ্ছে।
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়কদ্বীপে ডাস চত্বরে রয়েছে ভাস্কর শামীম সিকদার নির্মিত স্বোপার্জিত স্বাধীনতা শীর্ষক ভাস্কর্যটি। এটির ওপরের অংশ ফেটে গেছে, কটি মূর্তির মাথার অবয়ব ভাঙার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে, হাতে থাকা রাইফেলটির সামনের অংশ ভাঙা। অভিযোগ রয়েছে, পরিকল্পিতভাবে কোনো মহল ইতিহাসের এ অনন্য সাক্ষীটি ধ্বংসে মেতে উঠেছে। এদিকে বিভিন্ন সংগঠন এই ভাস্কর্যের ঠিক পাদদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে নির্বিচারে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছে অহরহ। ফলে ক্ষয়ে যাচ্ছে স্থাপনা, ভেঙে যাচ্ছে মূর্তির বিভিন্ন অংশ।
ভাস্কর্যের গায়ে কালো ধুলার আস্তরণের কারণে ভাস্কর্যটির জীর্ণদশা স্পষ্ট।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা শীর্ষক ভাস্কর্যটি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা জোগায় সব দর্শনার্থীকে। এটিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’- এ ধরনের নানা উদ্দীপনামূলক উক্তি রয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ। এটির চৌকো বেদির ওপর মূল স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। পতাকা ওড়ানো বাঙালি যে রক্ত দিয়েছে, নির্যাতন সয়েছে তার কিছু চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে এতে। এর আরেক পাশে চিত্রিত হয়েছে ছাত্র-জনতার ওপর নির্যাতনের চেহারা।
টিএসসি মোড়ে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মৃতি ভাস্কর্য।
ঢাকার একটি অন্যতম প্রধান ভাস্কর্য নিদর্শন এটি। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এই ভাস্কর্যটির সাদা রং কালচে হয়ে গেছে, পাদদেশটি জঙ্গলে ভরে গেছে। পথচারীদের নির্বিচার জলবিয়োগে ভাস্কর্যটির চারপাশজুড়ে দুর্গন্ধ।
ক্যাম্পাসে ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে নির্মিত স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটির বেহাল দশা উল্লেখ করার মতো।
স্বাধীনতার চেতনা বহন করে ভাস্কর্যটি ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয়। এ বিশাল স্থাপত্য শিল্পটি বাংলার কৃতী সন্তানদের প্রতিকৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতিটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের আদলে তৈরি। এছাড়া কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাত্মা গান্ধীসহ গ্রাম-বাংলার নানা পেশার মানুষের প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে। নিজ অর্থায়নে এ ভাস্কর্যটি দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছেন শিল্পী শামীম সিকদার।
প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পার হলেও আজ অবধি মূর্তিগুলোর নেমপ্লেট বসানো হয়নি। ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে কিছু মূর্তির মাথা ও মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে দর্শনার্থীরা দেখে মুগ্ধ হলেও মূর্তিগুলো চিনতে প্রতিনিয়তই বিপাকে পড়ছেন। এখানে নিরাপত্তারও চরম অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাশেই পুলিশশূন্য সিকিউরিটি বক্স পড়ে আছে।
এক সময় নিয়মিত পুলিশ পাহারায় থাকলেও পরে তাদের উঠিয়ে নেয়া হয়।
এদিকে জগন্নাথ হলের উত্তর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে বুদ্ধদেবের ভাস্কর্যটি। চার বছর ধরে অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এখনো ভাস্কর্যটির একটি হাত পড়ে আছে, অন্যটি নির্মিত হয়নি। শরীরের অবয়ব গঠন সম্পন্ন হলেও মাথা ও মুখের চিহ্নমাত্র নেই।
চার বছর আগে শুরু হয়ে বর্তমানে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হলের সামনেই রয়েছে মা ও শিশু ভাস্কর্য। গত কয়েক বছর ধরে ভাস্কর্যটি আবর্জনাস্বরূপ মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের মূল গেট দিয়ে ঢুকতেই বসুনিয়া তোরণ, বেগম রোকেয়া, মধুদা, সিরিয়াস ডিসকাশন, ভাস্কর্য ‘শান্তির পায়রা’সহ শতাধিক ভাস্কর্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার অভাব, সঠিক তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে জানা যায়, ক্যাম্পাসের ভাস্কর্যগুলো দেখভাল-রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য আলাদা কোনো বিভাগ নেই।
নেই কোনো অর্থ বরাদ্দও। এছাড়া রয়েছে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয় সৌন্দর্য বর্ধন কমিটি থাকলেও তাদের এ ব্যাপরে কোনো তৎপরতা নেই। সৌন্দর্য বর্ধন কমিটির সদস্য ও ঢাবি প্রক্টর ড. আমজাদ আলী বলেন, ভাস্কর্যগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনে কমিটি কোনো কাজ করে বলে আমার জানা নেই।
ভাস্কর শামীম সিকদার মানবকণ্ঠকে বলেন, স্বোপার্জিত স্বাধীনতার মাথা ও পা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভাস্কর্যে বিশ্বাস করে না তারাই ভাস্কর্য ভেঙেছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে থাকা সব ভাস্কর্য রক্ষণাবেক্ষণে কর্তৃপক্ষকে আরো মনোযোগী হওয়ার দাবি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মফিজুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, বড় কোনো সংস্কার না করা হলেও বছরে একবার বিজয় দিবসের আগেই ভাস্কর্যগুলোর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হয়। আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন, রাস্তাঘাট মেরামতের বাজেট থেকেই এ কাজ করা হয়। অথচ এ খাতে সামান্য অর্থ বরাদ্দ দিলেই ভাস্কর্যগুলোর সঠিক পরিচর্যা করা সম্ভব।
তিনি বলেন, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা মেরামত করতে আমরা গত ৩০ জুন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। আশা করি শিগগিরই কাজ শুরু হবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক মানবকণ্ঠকে বলেন, ক্যাম্পাসের ভাস্কর্যগুলো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে কয়েকটি ভাস্কর্য মেরামত করা হয়েছে। আমরা মূলত যে শিল্পীর তৈরি ভাস্কর্য সেই শিল্পীকে দিয়েই মেরামত করাই।
তা না হলে ভাস্কর্যেরও ক্ষতি হয়। সম্প্রতি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা মেরামত করতে ভাস্কর শামীম শিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব ভাস্কর্য মেরামত করা হবে।
উপাচার্য আরো বলেন, ভাস্কর্যগুলো আমাদের চেতনার জায়গা। তাই এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সেই সঙ্গে এসব ভাস্কর্য ও এর পাদদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যানার লাগানো, প্রোগ্রাম করা বন্ধ করতে হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।