যদি কখনও সুযোগ পাই, সাত বাজারের চুড়ি এনে দেব, যত্ন করো!
এ নিয়ে দু'বার হিন্দী ভাষা এবং এর ব্যবহার নিয়ে ফেইসবুকে আমার সাথে কয়েকজনের তর্ক হল। বিষয়টিকে পরিস্কার করার দরকার বিধায় আমি পোস্ট দিবার ব্যাপারে মনস্থির করলাম।
এর আগে কয়েকটি খন্ড চিত্র তুলে ধরি।
চিত্র-১:
ময়মনসিংহের ফুলপুর নামে একটি উপজেলা আছে। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে একটি মফ্বসল এলাকা।
সেখানে বাউলা/বওলা গ্রামের বাজারে একটি পুরোনো দ্বিতল ভবনে মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের ফিজিবিলিটি সার্ভে করতে গতবছর গেছিলাম। ছাদে দেখি একটি টাটা স্কাইয়ের ডিশ এন্টেনা। গ্রাম্য এলাকায় কেউ ব্যক্তিগতভাবে এটা ব্যহার করে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। এরকম বিভিন্ন মফস্বলে এ ধরনের টাটা স্কাই বা ডিশ টিভির ব্যবহার দেখে কৌতুহলি হলাম আসলে এটা কি বা কারা ব্যবহার করে। জানতে পারলাম এটা দিয়ে ক্যাবল অপারেট করা হয়।
অর্থাৎ যারা ক্যাবল টিভি অপারেশনের অনুমতি পায়নি একেবারে রুরাল এলাকায়, তারা এর মাধ্যমেই অবৈধভাবে ব্যবসা করতেছে।
টাটা স্কাই বা ডিশ টিভি বা এ রকম ছোট ডিশ এন্টেনা বা ভেরী স্মল এ্যাপারচার টারমিনাল দিয়ে সাধারণত কিউ/কে. ইউ. (Ku- band) ব্যান্ডে সিগনাল ট্রান্সমিট বা রিসিভ করা হয় যেটা দিয়ে প্রচলিত 'সি' (C-Band) এর যে সমস্ত চ্যানেল আছে, সেগুলো অপারেটররা আপলোড করে Ku- band এ ট্রান্সমিট করে থাকে। পরে গ্রাহকরা এই টাটা বা ডিশ টিভির ছোট এন্টেনা দিয়ে রিসিভ করে। এ পদ্ধতিতে আমাদের দেশে অবৈধ অর্থাৎ বিটিআরসি এ পদ্ধতিতে ক্যাবল টিভি এবং এর ব্যবসা বন্ধ রেখেছে। আমাদের দেশীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো সি ব্যান্ডে অপারেট করে থাকে এবং শহরে কেবল অপারেটররা এই C-Band-ই রিসিভ করে হোম-সার্ভিস দিয়ে থাকে।
চিত্র-২:
আমার এক ভগ্নিপতির বন্ধু দুবাইয়ে একটি বড় রেডিমিক্স (কন্সট্রাকশান রিলেটেড ইন্ডাসট্রি) ফার্মের প্লান্ট ম্যানেজার বা এই টাইপের কিছু একটা। গত বছর তার সাথে দেখা হয়েছিল। দেশে এসেও বেচারা ফোন কান থেকে নামাতে পারে না অফিসিয়াল কলের জন্য। প্রতি ৫ মিনিট পর পর ফোন আসছে দুবাই বা সিঙ্গাপুর থেকে (মাদার কোম্পানি সিঙ্গাপুরের) এবং ভদ্রলোক অনবরত হিন্দীতেই কথা বলে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গটা তুলতেই তিনি বললেন যে হিন্দী সেখানে "আনঅফিসিয়াল" সেকেন্ড লেঙ্গুয়েজ।
আরবী সবাই পারে না, ইংরেজীতেও অনেকের সমস্যা হয়। কিন্তু হিন্দী টিভি চ্যানেল, মুভি এবং সিরিয়ালের কল্যাণে সবাই পারে বিধাই এটাতে কমিউনিকেট করতে হয়। দুবাইয়ের অন্যান্য অংশের কথা আমি জানি না তবে সেই কোম্পানির অবস্থা স্বচোক্ষে দেখে একটু অবাকই হলাম।
চিত্র ৩:
ব্রডকাস্ট ইন্জিনিয়ারিং এ সুইচ করার পর Ku- band নিয়ে আরও কিছু বাস্তবসম্মত জ্ঞান লাভ করলাম। বায়তুল মোকাররমের ইলেকট্রনিক্স দোকানে এই ব্যান্ডের এন্টিনা দেদারসে বিক্রি হয়।
শহরের লোকজন পারসোনাল কাজে নিলেও মফস্বলের লোকজন নিয়ে যায় ব্যবসার জন্য। তারা অবৈধ কেবল অপারেটরের বিজনেস করে। মাঝে মাঝে পুলিশ রেইড দিলে ব্যবসায়ীরা এন্টিনা এবং রিসিভার সরিয়ে ফেলে। কিন্তু পরে আবার যথাস্থানে হাজির হয়।
এই Ku- band এর সুবিধা হচ্ছে একটি রিসিভার দিয়েই আপনি আপনার প্রয়োজন মত চ্যানেল দেখতে পাবেন।
অনেকগুলো রিসিভার বা অনেকগুলো সেটেলাইটএর ফ্রিকুয়েন্সি ডাউনলোড করতে হয় না। তাছাড়া একেবারেই ছোট হওয়াতে নাড়াচাড়া বা টিউনিংএও সুবিধা। ছবির মানও বেশ ভাল। বিদ্যুৎও অনেক কম লাগে বিধায় ডিসি ভোল্টেও রিসিভার চলে।
Ku- band এর অপারেটরদের বিভিন্ন প্যাকেজ আছে, আপনি আপনার সুবিধামত প্যাকেজ (কতটা চ্যানেল, কিকি, রেট ইত্যাদি) বার্ষিক বা ষ্নমাসিক ভিত্তিতে কিন্তে পারবেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব Ku- band এর অপারেটরদের লিস্টিতে কোন বাংলা চ্যানেল নেই। অর্থাৎ বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলের কোন প্যাকেজ তারা অফার করে না।
তো এখন আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? গ্রামে গঞ্জে দেদারসে মানুষ স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখছে, কিন্তু এর মধ্যে কোন বাংলা চ্যানেল নেই।
এবার একটু হিন্দী চ্যানেলগুলো দেখুন। কি দেখায় সেগুলোতে।
যাই দেখাক না কোন, বিঞ্জাপনগুলোর দিকে খেয়াল করুন। এসমস্ত পন্যের কয়টা বাংলাদেশের উপযোগি, যথাযথ ট্যাক্স দিয়ে কয়টা এদেশে আসে এবং এসমস্ত পণ্যের কয়টা আমাদের আসলেই দরকার। আমি অর্থনীতির ছাত্র না এবং এ বিষয়টা ভাল বুঝি না বিধায় গুছিয়ে বলতে পারবো না তবে যদ্দুর জানি সেটা হল এগ্রেসিভ মার্কেটিংএর মাধ্যমে আপনি কিন্তু একজন মানুষকে এমন পণ্য কিনাতে বাধ্য করতে পারেন যেটা তার আদৌ কোন প্রয়োজন নাই। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আপনি খেয়াল করলেই আপনার আশেপাশেই দেখতে পাবেন।
আমাদের বাজারে যে সমস্ত ভারতীয় পন্য আসছে, তার বিরাট একটা অংশ চোরাই পথে আসে যেটা আমাদের সরকার অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
আমার মনে হয় আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা/ব্লগার রা এ ব্যাপারে আরও ভাল উদাহরণ দিতে পারবেন। অর্থাৎ শুধু মাত্র শক্তিশালি স্যাটেলাইট চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণের সুবাদে অনেক ভারতীয় পণ্য আমাদে বিশাল একটা মার্কেট পেয়ে যাচ্ছে একেবারে বিনা পয়সায়। তাদেরকে পণ্যের প্রচার, উৎপাদন, বিনিময়, এলসি, ইত্যাদি কোন কারণেই আমাদের সরকারকে কোন রকম ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। (উল্লেখ্য 'সি'-ব্যন্ডের বিদেশী চ্যানেলের অনেক দেশীয় পরিবেশক আছে যারা চ্যানেল দেখানোর কারণে বিটিআরসিকে ট্যাক্স দিয়ে থাকে। )!
এবার আসি ভাষার প্রসঙ্গে।
আমার এক বন্ধু একটি দেশীয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিতে কেমিকেল প্রকৌশলী পদে চাকরী করত। সেখানে প্রচুর ভারতীয় অভিজ্ঞ অপারেটর এবং প্রকৌশলী কাজ করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা কেউ ইংরেজীতে কথা বলত না। এমনকি বাংলাদেশীদের সাথেও না। কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল হিন্দী।
আমার বন্ধু বা তার কলিগরা ইংরেজীতে কথা বললে তারা বুঝত না বা না বুঝার ভান করত। তাদের ভাবটা এমন ছিল যে "আরে, এরা সবাই তো হিন্দী জানে বা বুঝে, কাজেই সমস্যা কি?"
বাংলাদেশে কত ভারতীয় কাজ করেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। গত বছর বা তারও আগে কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম যে সংখ্যাটা লাখখানেক হবে। আমার মতে সংখ্যাটা এত বেশী না হলেও ৫০/৬০ হাজার তো হবেই। এদের বায়িং হাইজসহ গার্মেন্টস সেক্টরই তার প্রমাণ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মাত্র ৫-৬ হাজার ভারতীয় সরকারের ওয়ার্ক পরমিট নিয়ে ট্যাক্স দিয়ে কাজ করছে। বাকিরা সব অবৈধ। আমার বন্ধুর ঐ কোম্পানিতে এক জন মেট্রিক পাশ ভারতীয় অপারেটর বুয়েট পাশ প্রকৌশলীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশী বেতন পেত। যার ফলে আমরা হারাচ্ছি মূল্যবান পুঁজি এবং সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।
ব্যাপারটা যদি শুধুমাত্র অর্থৈতিক কর্মযজ্ঞের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে সেটা দিয়ে এত বড় ব্লগ লিখতাম না।
এখন থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে আমাদের সোনালী প্রজন্মের পূর্ব পুরুষরা বুঝতে পেরেছিলেন মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটুকু। শুধুমাত্র উর্দুকে তাঁরা রাষ্ট্রভাষা (অফিসিয়াল ভাষা) হিসেবে মেনে নেননি। দাপ্তিরক ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার যদি সীমিত হত বা রোধ হত তাহলে ভাষার যে স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি কিংবা উত্থান-পতন সেটা বাংলা হারিয়ে ফেলত। মৃত নদীর মত হারিয়ে ফেলত তার যৌবন। ভাষার প্রয়োগ সীমিত হলে সেটার তীক্ষ্ণতাও যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা এ অঞ্চলের আপামর জনতার বুঝে এসেছিল।
যার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে তাঁরা রক্ষা করেছিলেন ভাষার সৌকর্যকে। যেটার সুফল আজ ভোগ করছি আমরা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছি আগামী ৬০ বা ১০০ বছর পর কি হবে? অনেকেই এ ব্যাপারে কনফিডেন্ট যে আগামী ১০০ বছরেও বাংলা ভাষার কোন 'অবনতি' (এই শব্দটা তখনকার পরিস্থিতিতে যে কোন অর্থ বহন করতে পারে। ) হবে না। কিন্তু আমরা কি আসলেই এতটা নিশ্চিত? আমাদের শিশুরা যারা হিন্দী টিভি সিরিয়াল, মুভি অহরহ দেখে থাকে, তাদের চিন্তা চেতনা, ভাষার প্রকাশ ভঙ্গি কি এখনকার মতই থাকবে? (ভাষা সময়ে সময়ে বদলায়, কিন্তু সেটা যেন বর্তমান যেই ডিজুস প্রজন্মের ব্যাংলিশ, সেরকম না হয়!)।
উপরের যেই চিত্র(২ নং) বর্ণনা করলাম সেটা যদি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, তাহলে আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে আসলেই নিশ্চিন্ত হতে পারি?
পোস্ট পড়ে কেউ যদি আমাকে হিন্দুত্ব বাদ বা হিন্দু বিরোধী বলে মনে করে থাকেন তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি। কারণ আমি সেরকম কিছু বুঝাতে চাইনি। আমি বরঞ্চ নিজেকে হিন্দীইজম বা হিন্দীত্ববাদ বিরোধী বলেই দাবী করব। এই বিরোধিতা হিন্দী ভাষার প্রতি নয় বরং হিন্দী ভাষাকে ব্যবহার করে যে চটুল বানিজ্য এবং আগ্রাসি উপনিবেশবাদ চলছে (চিত্র ২ ও ৩) সেটার বিরোধী। এর ফলে শুধু বাংলা কেন, এর আঞ্চলিক ভাষা এবং আদীবাসি ভাষাসমূহও বিপন্নের মুখে পড়বে অবধারিত।
কারণ বাংলা শক্তিশালি ভাষা হওয়ায় (ব্যাকরণ, ব্যবহারের ক্ষেত্র, প্রয়োগ ইত্যাদি) আঞ্চলিক এবং উপজাতি ভাষাসমূহ এত বেশী শক্তিশালি না। আর এ সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাণস্পন্দ।
আজ থেকে ৬০ বছর পর আমি বা আপনি হয়ত থাকবো না। বা থাকলেও হুইল চেয়ারে অন্যের সাহায্য নিয়ে চলাচল করতে হতে পারে। তখন আমারই বা আপনার কোন নাতি বা নাতনি আপনাকে চলাচলে সাহায্য করার জন্য আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় যদি বলে,"কুচ পরওয়া নেহি দাদু, মে হুঁ না?" .... তখন আপনার অনুভুতি কি হবে?
এ পরিস্থিতি দেখার আগেই যেন আল্লাহ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান এই কামনা করি।
(উল্লেখ্য, আমি কোন ভাষাবিদ নয়। উপরোক্ত বর্ণনা আমার নিজস্ব উপোলব্ধি। কোথাও কোন ভুল তথ্য বা তত্ব দিয়ে থাকলে দয়া করে উল্লেখ করবেন। কৃতজ্ঞ থাকব। )
(ফেইসবুকে যাদের সাথে ভাষা নিয়ে তর্ক করেছি, তাদেরকে ধন্যবাদ এই জন্য যে ঐ তর্কটা না করলে এই লেখা লিখতে পারতাম না।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।