আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিজাত ক্লাবগুলো শুল্কমুক্ত মদ বিয়ারে সয়লাব, একটি যুগান্তকারী রিপোর্ট

রাজধানীর অভিজাত শ্রেণীর বিনোদন কেন্দ্র অভিজাত ক্লাবগুলোতে চলছে অবৈধ মদ-বিয়ারের রমরমা ব্যবসা। কালোবাজার থেকে কেনা শুল্কমুক্ত মদ-বিয়ার নামমাত্র মূল্যে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এসব ক্লাবে। সমাজ ও দেশের নীতিনির্ধারক, সরকারি আমলা, অভিজাত শ্রেণীর নামিদামিরা এসব ক্লাবের সদস্য। কিন্তু তারা হয়তো জানেনই না সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কেনা কালোবাজারের মদই গিলছেন তারা। এভাবে না জেনেই তারা জড়িয়ে পড়েছেন অপরাধমূলক প্রক্রিয়ায়।

অবশ্য ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ কিছু অভিজাত ক্লাব মদ আমদানির লাইসেন্সধারী। সদস্যরা জানেন তারা আমদানি করা বৈধ মদই খাচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ অভিজাত ক্লাব দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কালোবাজার থেকে শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা মদ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কিনছেন এবং অবৈধ মাদক ব্যবসার অপরাধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ছেন। ঢাকা ক্লাবের মদের উৎস : যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অবাক হওয়ার মতো তথ্য। সম্প্রতি ঢাকা ক্লাবের নির্বাচন হয়ে গেছে।

এ সময় প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, মদ বিক্রি করে নাকি ক্লাবটি প্রায় ৩০ কোটি টাকা লাভ করেছে। গুলশান ক্লাবও কোটি টাকার বেশি লাভের দাবি করেছে। অথচ ২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্র“য়ারি মাত্র ৩টি চালানে ঢাকা ক্লাব ৫ হাজার ৭৪৮ লিটার মদ আমদানি করেছে। টাকার মূল্যে ১২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি ৩টি চালানে আমদানি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫৫ লিটার মদ ও বিয়ার।

টাকার অংকে যা ১০ লাখ ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই দু’বছরে ঢাকা ক্লাব মাত্র ৬ হাজার ৮০৩ লিটার মদ আমদানি করেছে। যার মূল্য মোট ২২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। অনুসন্ধানকালে অবাক হয়ে দেখা গেছে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই দু’বছরে কমপক্ষে ৯০ হাজার লিটার থেকে ১ লাখেরও বেশি লিটার মদ ও বিয়ার বিক্রি করেছে ঢাকা ক্লাব। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ক্লাবে সে াতের মতো মদ ও বিয়ার আসছে কোন উৎস থেকে।

নিশ্চয়ই তা বৈধ উৎস নয়। কারণ দু’বছরেই আমদানি মাত্র সাড়ে ৬ হাজার লিটার মদ! এছাড়া ২০১০-১১ অর্থবছরে শুল্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা ক্লাবের কোন মদ আমদানি নেই। অথচ এ বছরের অডিট রিপোর্টেই ৩০ কোটি টাকা মদ বিক্রির কথা বলা হয়েছে। ঢাকা ক্লাবের সর্বশেষ অডিট রিপোর্টে মদ বিক্রি থেকে এই বিশাল অংক লাভ হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে তারই বা রহস্য কি? দেশের নারকোটিক্স, শুল্ক কর্তৃপক্ষ, এনবিআর কেউ এ প্রশ্নের জবাব জানে না। নিয়ন্ত্রক হয়েও এসব প্রতিষ্ঠান অসহায় বলে সূত্র দাবি করেছে।

এ চিত্র দেশের প্রতিটি অভিজাত ক্লাবের জন্যও প্রযোজ্য। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ক্লাব ২৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকার মদ আমদানি করে শুল্ক পরিশোধ করেছে ১ কোটি ৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, বছরজুড়ে আরও যে কমপক্ষে ১০ গুণ পরিমাণ মদ বিক্রি হচ্ছে তাতে সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের পরিমাণ কত? এভাবে অভিজাত শ্রেণীর ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ প্রতিটি ক্লাবই পরিকল্পিতভাবে নামমাত্র আমদানি দেখিয়ে এর বহুগুণ বেশি মদ কালোবাজার থেকে সংগ্রহ করছে এবং বিপুল অংকের সরকারি রাস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অভিজাত ক্লাবের আমদানি আইওয়াশ : কাস্টম কমিশনারেটের আমদানি তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, লাইসেন্সধারী ক্লাবগুলোর শুল্ক পরিশোধ করে মদ আমদানি পুরোপুরি আইওয়াশ।

প্রকৃত চাহিদার এক শতাংশও আমদানি না থাকলেও নারকোটিক্স লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে এসব ক্লাবে চলছে বেআইনি কার্যকলাপ। চাহিদার সঙ্গে বৈধ আমদানির ফারাক আকাশ-পাতাল। মূলত কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে শুল্কমুক্ত মদ-বিয়ার কিনে ক্লাব সদস্যদের চাহিদা মেটাচ্ছে। একই সঙ্গে পানির দামে বাইরে পাচার হচ্ছে। বার লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী বিদেশ থেকে সাড়ে ৪শ’ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করা আমদানিকৃত মদ-বিয়ার ছাড়া অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করা মদ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

কিন্তু এসব ক্লাব কর্তৃপক্ষ প্রচলিত আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেদারসে বিক্রি করছে কালোবাজারের মদ। এভাবে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আÍসাতের সঙ্গেও অভিজাত এ ক্লাবগুলো জড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা ক্লাবে যে দামে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ-বিয়ার বিক্রি হচ্ছে শুল্ক দিয়ে আমদানি করা হলে তার দাম হওয়া উচিত দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু ঢাকা ক্লাবের বারের দর রাজধানীর যে কোন বারের তুলনায় অনেক কম। এত কম মূল্যে মদ-বিয়ার বিক্রির রহস্য কী? এ প্রশ্নে শুধু ক্লাব কর্তৃপক্ষই নয়, খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও মুখ খুলতে নারাজ।

বলেন, আমরা সবই জানি। কিন্তু সমাজের নামিদামিদের ঘাঁটানোর সাহস কারোরই নেই। বিশেষ করে ঢাকা ক্লাব এবং গুলশান ক্লাবের বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে নামমাত্র যে মদ ও বিয়ার শুল্ক পরিশোধ করে আমদানি করা হয় তা প্রতিদিনের বিক্রি হিসাব করলে মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের খোরাক। তাহলে বছরের বাকি ৩৫০ দিনের মদের জোগান কোন উৎস থেকে দেয়া হয় তা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্লাবের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, বৈধভাবে চাহিদার হাজার ভাগের এক ভাগ মদ ও বিয়ার আমদানি আইওয়াশ মাত্র।

শুল্কমুক্ত মদের অবৈধ কারবারকে বৈধতা দেয়ার জন্যই এমনটি করা হয়। কেউ পরীক্ষা করলে মজুদ রাখা আমদানি করা মদই দেখানো হবে। কিন্তু আমদানি ইনভয়েসের সঙ্গে ব্যাচ নম্বর মিলিয়ে দেখলেই সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাওয়ার কথা। সূত্র আরও জানিয়েছে, ঢাকা ক্লাবের বারে যে মদ-বিয়ার বিক্রি হয় তার কমপক্ষে ১০ গুণ ক্লাব সদস্যরা নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে বাইরে নিয়ে যান। একজন সদস্য যে কোন পরিমাণ মদ-বিয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন।

বাজার মূল্য থেকে প্রায় অর্ধেক মূল্যে কেনার সুযোগ থাকায় স্কচ হইস্কি, ভদকা, ব্র্যান্ডি, জিনসহ প্রচুর মদ-বিয়ার এভাবে ক্লাব থেকে বাইরে পাচার হচ্ছে। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শর্ত এবং লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী এ ধরনের বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ৪শ’ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে আমদানি হলে যে বিয়ারের মূল্য পড়ে প্রায় ৩৭০ টাকা তা বিক্রি হচ্ছে ১শ’ থেকে ১৩০ টাকায়। ডিলাক্স শ্রেণীর মদ বিক্রি হয় প্রতি পেগ মাত্র ১৬০ টাকায়। অন্যান্য বিদেশী হুস্কি, ভদকা, জিন বিক্রি হয় প্রতি পেগ ১২০ টাকায়।

জনিওয়াকার ব্যাক লেভেল এবং সিভার্স রিগ্যালের মতো ডিলাক্স শ্রেণীর যে হুইস্কির প্রতি বোতলের দাম কমপক্ষে সাড়ে ৪ হাজার টাকা হওয়ার কথা তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকায়। ডিলাক্স বাদে ১০০ পাইপারস, ভ্যাট ৬৯, পাসপোর্ট, হোয়াইট মেকির মতো হুইস্কি প্রতি পেগ মাত্র ৮৫ টাকা এবং প্রতি বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৫শ’ টাকায়। অথচ শুল্ক দিয়ে আমদানি হলে এ ধরনের হইস্কি ৩ হাজার টাকার কমে বিক্রি হওয়ার কোন সুযোগই নেই। অবৈধ সরবরাহ : নির্দিষ্ট কয়েকটি কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে সুকৌশলে এসব ক্লাবে অবৈধ মদ সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে সাবির ট্রেডার্স, ঢাকা ওয়্যারহাউস, ন্যাশনাল ওয়্যারহাউস, টস বন্ড প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রতি সপ্তাহে গভীর রাতে বা ভোররাতে একাধিক মাইক্রোবাসে করে শুল্কমুক্ত মদ-বিয়ার সরবরাহ হচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি অভিজাত ক্লাবের বৈধ-অবৈধ বার ও গেস্ট হাউসে প্রতি রাতে যে তরল মদ বিক্রি হয় তার শতকরা ৬০ শতাংশই বিয়ার। সূত্র মতে, এসব অভিজাত ক্লাব বার লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে যত্রতত্র মদ-বিয়ার বিক্রি করছে। লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী অনুমোদিত নির্দিষ্ট ফ্লোর ছাড়া অন্য কোন স্থানে মদ-বিয়ার বিক্রি করা নিষিদ্ধ। করলেও এজন্য নারকোটিক্সের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু কোন ক্লাবেই তা মানা হয় না।

ক্লাবের সর্বত্র প্রকাশ্যে মদ বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, দিনে রাতে শত শত সদস্য ও অতিথির কাছে বিক্রি করা মদ বাইরে বা অন্যত্র নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইস্যু করা বার লাইসেন্সের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার থেকে কোন অবস্থাতেই কোন প্রকার মদ বাইরে নিয়ে যাওয়া বা আনা যাবে না। একইভাবে একমাত্র সরকার অনুমোদিত বৈধ উৎস ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে বারে বিক্রয়ের জন্য মদ সংগ্রহ করা যাবে না। ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক পত্রে (স্মারক নং বাম/অবা-২/১৩(৩)/৯২/৩৫০ (১) তারিখ ১১/১১/২০০২) মদজাতীয় পানীয় আমদানির অনুমতিপত্রে শর্ত আরোপ করে যে, আমদানি করা মদ শুধু ক্লাবের বিদেশী সদস্য, বৈধ পারমিটধারী সদস্য এবং বিদেশী অতিথিদের পরিবেশন করা যাবে।

কোন অবস্থাতেই আমদানি করা মদ ক্লাবের বাইরে নেয়া যাবে না। ক্লাব কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে মদ আমদানির পরিমাণ ও ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চয়তাও প্রদান করে। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এসব শর্ত প্রতিনিয়ত লংঘিত হলেও দেখার কেউ নেই। যুগান্তরে হেলাল উদ্দিন এর আজকের রিপোর্ট  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.