মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা।
আমি যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার প্রানপণ চেষ্টা করছি। শুধু স্বাভাবিক বললে হয়তো কম হয়ে যায়। আমি চেষ্টা করছি সবকিছুই সঠিক সুন্দর স্বাভাবিক এমন একটা ভাব ধরে থাকার। অন্য যে কোন স্বাভাবিক মানুষ হলে এতক্ষনে চিৎকার চেঁচামেচি করে একটা লঙ্কা কান্ড ঘটিয়ে ফেলত।
বলা যায়না হয়তো দু চারটা চড় চাপড়ও এতক্ষনে কপালে জুটে যেতো। তারপর অনির্দিষ্ট কালের জন্য গৃহবন্দিত্ব। কিন্তু আমার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি আমারই আব্বা। যে কোন পরিস্থিতিতে একদম স্বাভাবিক থাকার জন্য তাকে মনে হয় কখনো চেষ্টাও করতে হয়নি। মাথা ঠান্ডা রাখা তার জন্মগত দোষ।
"নুরজাহান!! তুমি ঘরে যাও!! আগামী দুইদিনের মধ্যেই আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো"!
আমি চুপ চাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আমাদের ঘরের মেঝে পরীক্ষা করতে লাগলাম।
"তুমি শুনতে পাইছো? যাও এখন। তোমার চেহারা দেখতে আমার রুচিতে বাঁধতেসে"।
"দুইদিনের মধ্যে তো আপনার আকাঙ্ক্ষিত মানের বর পাওয়া ঝামেলা"।
"না পাইলে দুইদিন পর তোমার দাফনের ব্যবস্থা করবো।
এখন যাও"।
আমি নিজের ঘরে চলে আসলাম। আমার হাতে সময় আছে মাত্র দুইদিন। দুই মাথায় হয় দাফন নাহয় বিবাহ। দুইটাই আমার জন্য একই কথা।
যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। কিন্তু কি করবো। আজ সকালেই আব্বা আমার মোবাইলটা এক আছাড়ে চার টুকরো করে ফেলেছেন। জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। বাহিরের গেটে দাড়োয়ান চাচার সাথে নতুন এক লোক জুটেছে।
হবে আব্বার বিশাল বিশ্বস্ত লোকের পালের কোন একজন। ইচ্ছা না থাকলেও মনে মনে নিজের বাপের প্রশংসা না করে পারলাম না। উনি যদি বাংলাদেশে না জন্মে অন্য কোন উন্নত দেশে জন্মাতেন এতদিনে বিশ্বে দ্বিতীয় হিটলারের অভাব পূরণ হয়ে যেতো। আমি খাটের উপর চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুই কি করার নেই? কোনভাবেই কি আসিফকে একটা খবর দেয়া যায়না।
কিভাবে জানাই ওকে আমার কত বড় বিপদ। কি করছে এখন সে। নিশ্চয়ই এই শীতের মধ্যেও একটা পাতলা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মনের সুখে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে আর কবিতা লিখে যাচ্ছে। ওকি একবারও বোঝার চেষ্টা করবেনা আমি কিসের মধ্যে আছি, ওকে আমার এখন কি ভীষণ রকমের দরকার। আচ্ছা এখন ওর কবিতার মডেল কি? আসিফের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে জানতাম শুধু ছবি আঁকিয়েদেরই মডেল থাকে।
মডেল দেখে দেখে তাদের ছবি আঁকতে হয়। কিন্তু এখন জানি কবিদেরও মডেল থাকতে হয়। এই যেমন আসিফ। তার যদি হঠাৎ ইচ্ছে হয় সে পাখি নিয়ে কবিতা লিখবে, তাহলে পরদিন থেকে দেখা যাবে তার টেবিলের উপর একটা পাখির খাঁচা। একবার মনে হল ভিক্ষুকদের নিয়ে একটা কবিতা লেখা দরকার।
কথা নাই বার্তা নাই কোত্থেকে একটা ভিক্ষুক যোগাড় করে মেসে এনে হাজির করলো। ঘন্টা প্রতি ১০০ টাকা রেট। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি, কোন দুঃখে এই রকম একটা পাগল ছাগলের প্রেমে পড়েছিলাম।
গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মতো এমন কিছু আহামরি কবিতা আসিফ লিখেনা। খুব বিখ্যাত কোন কবিও সে নয়।
আর আমি খুব ভালো করেই জানি সেটা সে কোনদিনই হতে পারবেনা। সবচেয়ে মজার কথা হল, তার জীবনের লক্ষ্যই হল খুব সাধারন একজন মানুষ হওয়া। আমি নিজেও বহুবার তার কবিতার মডেল হয়েছিলাম। সামনে বসে থেকে থেকে দেখেছি কিভাবে তার কবিতার প্রতিটি পংক্তির সাথে সে মিশে যেত। তার চোখে মুখে ফুটে উঠতো কবিতাগুলো।
আমি বিস্মিত হতাম। নিজেই জানতাম না কখন এই বিস্ময়, শুধুমাত্র বিস্ময়ের গন্ডি পার হয়ে ভালোবাসার নিষিদ্ধ জগতে ঢুকে পড়েছিলো। না! আসিফকে আমি দোষ দেইনা, দোষ আমার। আমি জানতাম একটি ভুল সময়ে ভুল মানুষের জন্য জন্ম নেয়া এই অনুভূতিগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া তো দূরে থাক, বাঁচতেই দেয়া হবেনা। কিন্তু আমি নিজেকে থামাইনি।
আমার এই আগস্ত্যযাত্রাকে স্টপ সাইন দেখানোর জন্য মাঠে নেমে পড়লেন আমার আব্বাজান।
আমার আব্বা বনেদী খানদানের লোক। যে ব্যবসাতেই হাত দিয়েছেন লালে লাল হয়ে ফিরেছেন। চিবিয়ে ছিবড়ে করে ফেলা মাংসের হাড় বেঁচে লাখটাকা কামানোর কায়দাও তার জানা আছে। টাট্টিখানায় যাওয়ার জুতোজোড়াও যিনি বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নেন, তার মেয়ে খুব সাধারন একজনকে নিজে নিজে বিয়ের জন্য পছন্দ করে ফেলবে, এটা ভাবা তার জন্য কেবল অসম্ভবই নয়, অনেকখানি পাপও বটে।
আমার জানা ছিলো এই পাপ তিনি করবেন না। এবং তিনি তা করেননি। দেড়দিনের মাথায় আমার জন্য তার মাপকাঠি মোতাবেক সুপাত্র যোগাড় করে আনলেন। বিয়ের দিন সকাল বেলা আব্বা আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন। আমার আব্বা মানুষটা এক কথার মানুষ।
তিনি যদি দুইদিনের মধ্যে তার পছন্দের পাত্র খুঁজে না পেতেন তাহলে সত্যি সত্যি আমার দাফনের যোগাড় যন্ত্র করে ফেলতেন এ ব্যপারে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু দ্বিতীয়টি ঘটার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও এমন তলব কেন পড়লো বুঝলাম না। যাই হোক, ওসব চিন্তা করা এখন আমার কম্ম নয়। দুইদিন আগে থেকেই আমি সবধরনের চিন্তা ভাবনা করা বন্ধ করে দিয়েছি।
এ জীবনে চিন্তার মেশিনে দ্বিতীয়বার তেল দেয়ার কোন ইচ্ছা নাই। কিন্তু এখন সকল ধরণের পরিস্থিতি আমার সম্পুর্ন প্রতিকূলে। তাই আমি যতটা স্বাভাবিক ভঙ্গীতে আব্বার ঘরে ঢুকলাম, ততটাই অস্বাভাবিক একটা ধাক্কা খেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। কারণ আব্বার বসার চেয়ারে আর কেউ নয় স্বয়ং আসিফ বসে আছে। আমি স্থবিরের মতো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমার আব্বাই প্রথমে শুরু করলেন।
"নুরজাহান! মেহমান আসছে। মেহমানকে সালাম দেও"।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি এখন প্রানপনে কিছু একটা ভাবতে চাচ্ছি।
কিন্তু গত দুইদিনের চর্চাহীনতায় মাথার গিঁটে গিঁটে জং পড়ে গিয়েছে। আমি একবার আসিফ একবার আব্বার দিকে তাকাতে লাগলাম।
"আসিফ সাহেব তোমারে কিছু বলতে আসছে। শুরু করেন আসিফ সাহেব"।
আসিফ খুব মনোযোগ দিয়ে পরনের ফতুয়ার কোনা দিয়ে চশমার কাঁচ পরিস্কার করতে করতে বলতে লাগলো, "নুরি, আমার বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
ছেলে তোমার বাবার অফিসেই কাজ করে। অনেক ভালো পোস্ট। সামনের মাসেই বিয়ে। তোমার বাবাকে দাওয়াত করতে আসলাম"।
আসিফ কথাগুলো বলার সময় একবারও আমার দিকে তাকালনা।
আমিও একবারের জন্যও ওর উপর থেকে চোখ সরালাম না। নিরবতাটা আব্বাই ভাঙলেন।
"আসিফ সাহেব আপনার বোনের বিয়েতে আমি অবশ্যই আসবো। সম্বন্ধ যখন আমি ঠিক করেছি। বিয়াও আমি নিজেই পড়াবো।
সব খরচপাতিও আমার। আপনি তো নুরজাহানকে আরো কিছু বলতে আসছিলেন। বিনা সংকোচে বলে ফেলেন"।
আসিফ শোনা যায় না এমন স্বরে বললো। " নুরী, যা হয়েছে ভুলে যাও।
স্বামীর সাথে নতুন সংসার করো। সুখে থাকো"।
আমার আব্বা মুখে একটা বিজয়ের হাসি টেনে আমার দিকে তাকালেন। হাসতে হাসতেই বললেন, "খানাপিনা করে যাবেন আসিফ সাহেব। আজ আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে"।
আমি চোখ বড় বড় করে দেখলাম আসিফ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। আসিফ সফল হয়েছে। খুব সাধারন একজন মানুষ হতে পেরেছে। একজন অতি সাধারন মানুষের পক্ষেই এতোটা কাপুরুষ হওয়া সম্ভব।
আমি এখন যে ঘরটিতে বসে আছি এটাকে একটা ফুটবল মাঠের সাথে তুলনা না করলে অবিচার করা হয়।
ইচ্ছা না থাকলেও মনে মনে বাবাকে বাহ বাহ দিতেই হবে। মাত্র দেড়দিনের মাথায় এমন পাত্র বের করা যার তার কম্ম নয়। আমি খুব সুন্দর করে সাজানো খাটের উপর পড়ে থাকা গোলাপের পাপড়িগুলোকে ভর্তা বানাতে থাকি। কিছু কিছু ব্যপার থাকে যেগুলো যত সহজে বুঝে ফেলা যায়, তত সহজে মেনে নেয়া যায় না। আমিও মানতে পারছিনা।
আমার ভেতরে অন্ধ একটা ক্রোধ ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনভাবেই এটাকে ভেতর থেকে টেনে বের করতে পারছিনা। আমি আড় চোখে দেখলাম আমার আইনসিদ্ধ স্বামী ঘরে ঢুকলেন।
জানিনা কেন আমার সমস্ত রাগ গিয়ে মাত্র দেখা এই মানুষটার উপর পড়লো। কি দরকার ছিলো দুই দিনের মধ্যেই আমার বাবার নাগালে চলে আসার।
দুই দিনের প্রিপারেশনে তো মানুষ ঘরের ফার্নিচারও কিনতে চায়না। আর সে বৌয়ের মতো জ্বলজ্যান্ত ফার্নিচার ঘরে নিয়ে এলো। আমি ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলাম। আড় চোখে দেখলাম লোকটা পকেট থেকে মোবাইল সেট আর রুমাল বের করে সাইড টেবিলের উপর রাখলো। আমি মোবাইল সেটটা দেখে মুচকি হাসলাম।
মারাত্মক দামী সেট। উপযুক্ত শ্বশুরের উপযুক্ত জামাই।
"আপনার মোবাইলটা দেখতে পারি"।
লোকটা মনে হয় আমার কথা শুনে পুরাই ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। হয়তো ভাবতে পারেনি নতুন বিয়ে করা বৌ অমন বেহায়ার মতো কথা বলে বসবে।
মুখে কিন্তু কিছুই বললোনা। চুপচাপ মোবাইলটা এগিয়ে দিলো। আমি কিছুক্ষণ মোবাইলটা উল্টে পাল্টে দেখলাম তারপর সোজা এক আছাড়ে পুরো পাঁচ টুকরা। আমার মোবাইলটার চার টুকরো হয়েছিলো। এইটার একটা বেশী।
লোকটার চেহারা দেখে মনে হল তার মাথায় আকাশের একটা ছোটখাটো অংশ ভেঙে পড়েছে। আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে সবকিছুই সঠিক সুন্দর স্বভাবিক এমন একটা ভাব ধরে শুয়ে পড়লাম। গত দুইদিনের মধ্যে আজ প্রথম একটু শান্তি শান্তি লাগছে। প্রতিশোধ জিনিসটা আসলেও অনেক মজার একটা ব্যপার। আমি প্রায় হিসেব করেই ফেলেছিলাম কতদিন নাগাদ এ ঘর থেকে বিদেয় হয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ শুনি আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী বলছেন,
"আপনি এমন কেন করছেন আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু কথা খোলাখুলি বলে নেয়া ভালো। যা হয়ে গিয়েছে, তা তো বদলানো যাবেনা। কিন্তু শুধু রাগ পুষে রেখে সামনের দিনগুলো তো নষ্ট করার মানে হয়না"।
আমি বিছানায় উঠে বসে চোখ পিট পিট করে তাকালাম।
আক্রমনের আগে শত্রুর গতিবিধি বুঝে নেয়া ভালো। আমার বাবার বাড়ি প্রত্যাবর্তনের প্ল্যানটা তবে আরো নিখুঁতভাবে বানানো যায়।
"আপনি আমার নাম জানেন কিনা জানিনা। আমার নামও আসিফ"।
আমি কিছুক্ষন লোকটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম সে কি বলতে চায়।
আমার নামও আসিফ বলতে সে কি বোঝাতে চাচ্ছে। সে কি আসিফের ব্যপারে সবকিছুই জানে? কিন্তু এইটা কি করে হয়। আমার বাবা কাস্টমারকে না জানিয়েই খুঁত ওয়ালা জিনিস দ্বিগুন দামে বেঁচে দেন। আর মেয়ের এতো বড় খুঁত হবু জামাইয়ের কাছে বলে দিবেন। এতো ভালো মানুষ আমার আব্বা হতেই পারেননা।
এই লোক হয় ভয়ানক রকমের বোকা না হয় আমার আব্বার চেয়েও ডাবল ঝানু। আমি ভীষন একটা সন্দেহের দৃষ্টিতে এই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
জানিনা আমার চোখের মধ্যে কি ছিলো লোকটা হঠাৎ হেসে ফেললো। আমি খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম হাসলে এই মানুষটাকে সত্যি খুব ভালো মানুষ মনে হয়। আমার এক আসিফের সাথে সম্পর্কের শুরু হয়েছিলো বিস্ময় দিয়ে।
আজ আরেক আসিফের সামনে বসে আছি তার চেয়েও বেশী বিস্ময় নিয়ে। এই বিস্ময় আমাকে কোথায় যে নিয়ে যাবে আমি সত্যি জানিনা।
দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন (শেষ পর্ব) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।