আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ কেমন বিজয় আমাদের ও রাজাকাররা

আমি খুবি সাধারণ পেন্সিলে আঁকা সহজ স্বপ্ন আমার । স্বপ্ন দেখতে ভুল হলে ইরেজার দিয়ে সহজে মুছে ফেলা যায় । আমার স্বপ্ন । রক্ত, অশ্রু ও সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা প্রিয় স্বদেশকে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে পাই। বাঙালির অমিত বিক্রম, অযুত শহীদের আত্মত্যাগ আর জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের অসীম সাহসী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এবার স্বাধীনতার ৪০ বছরে পা দিল।

ইতিহাসের পথপরিক্রমায় চার দশক খুব বেশি সময় না হলেও একটি দেশের গঠন ও বিকাশে কম সময়ও নয়। আর একটি দশক পর আমরা পেঁৗছে যাব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। অনেকের মতো আমারও অহংকার এ কারণে যে, আমার জন্ম পরাধীন দেশে নয়, আমার জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। আমি প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করি।

একাত্তরের দামাল তরুণের অপারেশন, পাকিস্তানি হায়েনার ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষিতার ক্রোধ_ সবকিছুই আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। দেশের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মুহূর্তেই আমি হয়ে যাই দ্বিধাহীন এক মুক্তিযোদ্ধা। ' এ কথাগুলো শুনেছিলাম বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে এক টগবগে তরুণের কণ্ঠে, যার জন্ম স্বাধীনতা অর্জনের ১৫ বছর পর। এসব কথা একজন তরুণের কণ্ঠে উচ্চারিত হলেও, এ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর কোটি তরুণের সচেতন উপলব্ধির প্রকাশ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল অর্জন। অসামান্য আত্মত্যাগ ও বীরত্বের গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধ কেবল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছিল না, মুক্তিযুদ্ধ ছিল মুক্তিকামী জনতার দীর্ঘদিনের আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। সিপাহি বিদ্রোহ, আদিবাসী বিদ্রোহ, ধর্মীয় ঝাণ্ডার সশস্ত্র সংগ্রাম, অগি্নযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ব্রিটিশ রাজত্বের ভিতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, টংক-নানকার প্রভৃতি প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ নানা আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণ চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ জনগণের সামনে বিশাল সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছিল। জনগণ চেয়েছিল সামগ্রিক মুক্তি; চেয়েছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিপীড়নমুক্ত দেশ। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান_ এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্র পূরণ করবে_ এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বায়বীয় কোনো বিষয় নয়। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, অর্থনৈতিক নীতি-বৈশিষ্ট্যের সম্মিলিত সুস্পষ্ট রূপ, যেখানে জনগণের দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম আর আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। পাঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তিত হয়, গণতন্ত্র পায় নির্বাসনদণ্ড। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে সামরিক শাসন।

উল্টে যায় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, দর্শন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত নেমে আসে। আক্রান্ত হয় বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি। সংবিধানকে পাল্টে দেওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে ফেলে।

ধীরে ধীরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে শুরু করে। বাংলাদেশ এগিয়ে যায় পাকিস্তানিকরণের দিকে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র এভাবে বদলে গেছে। জাতীয় চেতনার বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে। গণতন্ত্র মানে বোঝানো হয়েছে নির্বাচন-নির্বাচন খেলা। সমাজতন্ত্রের বদলে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে লুটেরা পুঁজিবাদের পথে। শুধু পৃথক রাষ্ট্রের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল 'মুক্তি'র জন্য যুদ্ধ। পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রে মানুষের মুক্তি সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য যে আলাদা হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল।

আর সেই বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে নাকচ করে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু বাংলাদেশ যদি ধীরে ধীরে পাকিস্তানের ভাবাদর্শই গ্রহণ করে, তবে মুক্তিযুদ্ধের মানে কী দাঁড়ায়? পাকিস্তান রাষ্ট্রে পুরো জাতির অংশীদারিত্ব, মর্যাদা ছিল না। দুঃখজনক সত্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় জাতিগত নিপীড়ন চলছে।

জাতিগত নিপীড়ন আর গণতন্ত্র একসঙ্গে থাকতে পারে না। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এখন যদি সেই বাঙালি অন্য জাতির ওপর জুলুম করে, তবে মুক্তিযুদ্ধ কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না? যে বাঙালি ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল, সেই বাঙালির জন্যই যদি অন্য ভাষার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, তবে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? পাকিস্তান রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। অধিকাংশ মানুষকে শোষণ করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সম্পদশালী হয়েছিল।

বাংলাদেশেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। জাতীয় সংসদ এখন লুটেরাদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। সংবিধানে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছিল, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে অগ্রসর করার বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা দূর হবে এবং রাষ্ট্রের হারানো বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরে আসবে কীভাবে? বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ভিত্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা ছাড়া সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে চার নীতির কোনো নীতিকেই বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের ভাবাদর্শকে আঘাত না করে, কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই কি লক্ষ্য পূরণ হবে? পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনের যে দর্শন, সেই দর্শন তো আমাদের রাষ্ট্রবিরোধী। পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব? সাতচলি্লশের স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্তরের স্বাধীনতার মৌলিক গুণগত পার্থক্য রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যেমনি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে, তেমনি একই সঙ্গে ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বরুদ্ধেও।

কিন্তু স্বাধীনতার পর, অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক! মুক্তিযুদ্ধ কেবল অসম্পূর্ণ থেকে যায় তা-ই নয়, বাংলাদেশ চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের উল্টো স্রোতে। যে মার্কিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ জয়ী হয়েছিল, সেই মার্কিনের অনুগত হয়ে কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং দৃঢ়ভাবেই মার্কিন সাহায্য প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেছিলেন। তাজউদ্দীনের 'স্পর্ধা'র মূল্য দিতে হয়েছিল। স্বাধীনতার অন্যতম কারিগর তাজউদ্দীনের অপসারণ শুধু তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ছিল না। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের একটা পর্ব, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিকভাবে সপরিবারে জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক 'ভুলে'র মূল্য দিলেন। আর বাংলাদেশের 'উল্টোরথ যাত্রা' পাকাপোক্ত হয়ে গেল। স্বাধীন দেশে লুটপাট, সরকারগুলোর ব্যর্থতা, স্বৈরশাসন, সেনাবাহিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও তার ফলে ক্যু-পাল্টা ক্যু, মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহেরসহ নেতৃস্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড, মুক্তিযুুদ্ধকে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে ম্লান করে দেয়। একটা দেশের নিজের ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর জন্য ৪০ বছর কম সময় নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তারুণ্যের অপচয় ঘটছে।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্ম অবহেলা, অভিভাবকত্বহীনতার মধ্যেই গড়ে উঠেছে। নানা নেতিবাচক ঘটনা তারুণ্যের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব তারুণ্যের ভাবনাকে বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়নি। স্পর্ধিত তারুণ্যকে তারা বিকশিত হতে দেয়নি। ব্যর্থ নেতৃত্ব কখনোই তারুণ্যের স্পর্ধাকে সহ্য করতে পারে না।

তারুণ্যের উত্থান ছাড়া দেশের অগ্রসরতা সম্ভব নয়। আশা ছাড়া তো মানুষ বাঁচতে পারে না। আর তরুণরা আশার মধ্যেই বাস করে। হতাশা, অপ্রাপ্তিকে জয় করেই তারা এগিয়ে যায়। তারা স্বপ্ন দেখে সমাজ পরিবর্তনের।

তারা অসম্ভবকে জয় করতে চায়। এটাই তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে যদি স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই বলা চলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশে মুুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা রক্ষায় যোগ্য-সামর্থ্যবান প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজে গুরুত্ব দেননি। তরুণদের রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে গড়ে তোলা হয়নি। স্বাধীন দেশের তরুণরা সব বাধা পেরিয়ে নিজেদের গড়ে তুলেছে নিজস্ব তাগিদে, নিজস্ব প্রচেষ্টায়, নিজস্ব ঢঙে।

যেখানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতার শেষ, সেখানেই আমাদের তরুণদের সাফল্যের শুরু। বিশ্বায়নের বর্তমান কালে মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্যারিয়ারিজম, আকাশ সংস্কৃতির ধাক্কায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের একটা অংশ হয়ে উঠছে শেকড়বিহীন 'লুটেরা মানুষ' হিসেবে। এই 'লুটেরা মানুষে'র কোন কমিটমেন্ট নেই_ দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, এমনকি নিজের প্রতিও। ভোগবাদ, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এদের চেতনাকে পাথর করে দিচ্ছে।

এরা নিজেদের রাঙাতে চাইছে পশ্চিমা রঙে। তারুণ্য তো একক কোনো সত্তা নয়। শ্রমজীবী তরুণ যেমন আছে, তেমনি আছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ, আছে উচ্চবিত্ত তরুণও। সব তরুণের স্বপ্ন তো এক নয়, এক হতে পারে না। আত্মসর্বস্ব-প্রতিষ্ঠার পথের তরুণ যেমন আছে, তেমনি আছে দেশের জন্য আত্মনিবেদিত তরুণ।

দেশে গার্মেন্টে শ্রমজীবী তরুণ আর ঘর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে প্রবাসে শ্রমজীবী তরুণের লড়াই শুধু নিজের টিকে থাকার জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্যও। বিদ্রোহ করাই তারুণ্যের ধর্ম। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-লড়াই করেই তারা এগিয়ে চলে। তাই যে কোনো আন্দোলনেই তরুণরা থাকে সামনের কাতারে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে আন্দোলনে, কানসাট-ফুলবাড়ী-গার্মেন্ট-শনির আখড়ার বিস্টেম্ফারণে, তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনে আমরা দুর্বিনীত তারুণ্যকে ফিরে পাই।

বাংলার দামাল ছেলেরাই বিশ্ব ক্রিকেটে দেশকে মর্যাদার আসনে নিয়ে যায়। গবেষণা, সাহিত্য, মিডিয়া, থিয়েটার, তথ্য-প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রেই তরুণদের সরব পদচারণা দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করে, আশান্বিত করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করেছিল বলে, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক তরুণের ভোট পেতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও ততটা সোচ্চার নয়, যতটা তরুণরা। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তরুণরা যতটা আবেগপ্রবণ, শ্রদ্ধাশীল, কমিটেড, ততটা অনেক মুক্তিযোদ্ধাও নয়।

স্বাধীন দেশে অনেক কিছুর মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধার ক্ষয় হয়েছে। আদর্শিক বিচ্যুতি ঘটেছে অনেক মুক্তিযোদ্ধার। অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হলেও, তরুণরা ভীষণভাবে প্রত্যাশা করে ইতিবাচক বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধ বিস্মৃত হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ যে স্বপ্ন, যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করেছিল এবং যে চেতনার জন্ম দিয়েছিল, তাকে বাস্তবায়িত করতে হলে চাই আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ।

কিন্তু নতুন এই মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে হবে, কারা করবে? নীতিহীন রাজনীতির বিপরীতে আদর্শিক রাজনীতির উত্থান ঘটাতে হবে। তরুণরা চলতি নীতিহীন রাজনীতির বৃত্ত ভাঙতে পারছে না ঠিকই। কিন্তু তরুণরাই পারবে চলতি নীতিহীন রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে আদর্শিক ধারার রাজনীতির উত্থান ঘটাতে। তারুণ্যের উত্থান ঘটবেই। তরুণরা জয়ী হবে।

মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা দূর করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় অগ্রসর করতে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ হবেই। তারুণ্যের উত্থানে মুক্তিযুদ্ধ আবার জয়ী হবে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আমরা নির্বাচন করেছি সেসব প্রতিনিধিত্বশীল তরুণকে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। সম্ভাবনাময় তারুণ্যের চোখে আমরা বাংলাদেশের ৪০ বছরের একটি আদল সন্ধান করেছি। প্রত্যাশা করি, নির্মোহ ও স্পষ্ট চোখে দেখা এসব রচনা থেকে আমরা আধুনিক, যুক্তিনির্ভর, তথ্যভিত্তিক ও স্বপ্নসঞ্চারী একটি বাংলাদেশের ছবি খুঁজে পাব।

প্রিয় বাংলাদেশ যার সমৃদ্ধি আমাদের গৌরবান্বিত করে, যার ব্যর্থতা আমাদের বিদীর্ণ করে, সেই বাংলাদেশকে আরও বর্ণিল, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে আজকের তারুণ্যের অপার সম্ভাবনাই যে সবচেয়ে বড় শক্তি তা আমরা বিশ্বাস করি। পূর্ব প্রজন্মের গৌরব ও কীর্তি পরবর্তী প্রজন্মের স্পর্ধিত হাতে এগিয়ে যায় সামনে_ এটিই সমাজ প্রগতির শিক্ষা। আগামী দিনের বাংলাদেশ সব প্রজন্মের সম্মিলিত অংশগ্রহণে নিজের পায়ে সর্বময় মর্যাদায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই বিশ্বাস অতিশয়োক্তি নয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.