দেয়ালে দেয়ালে ছায়া দিয়ে লেখা মিথ্যা স্লোগান সত্যি হয়ে উঠুক একদিন
সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সদস্যদের মধ্যে যাঁরা পাকিস্তান অংশে স্থানু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কেবল একটি বামপন্থী রাজনৈতিক ধারা সারাদেশে প্রবহমান ছিল। ১৯৪৮-এর ২য় কলকাতা কংগ্রেসে পাকিস্তানের জন্য পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিপি) গঠন করে সাজ্জদ জহির (সর্বভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক) কে মহাসচিব নিযুক্ত করে মতাদর্শিকভাবে বিপ্লবের হিংসাত্বক রণদিপ লাইন গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী কয়েক বছর পূর্ব-পাকিস্তান বা পূর্ব-বাংলার বামপন্থীগণ রণদিপের এ হিট এন্ড হিট কৌশল অনুসরণ করেন। এ পদ্ধতিকে অন্যতম পন্থা হিসেবে অবলম্বন করে এ সময় রেলওয়ে ধর্মঘট, ময়মনসিংহের হাজং বিদ্রোহ, নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রভৃতি শোষণ-বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত করার প্রয়াস চলে। এতে সংগ্রামরত কৃষককুল স্থানীয় ও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ইতিবাচক ফল পেলেও যখন পাক-সরকার বামপন্থীদের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তখন মেহনতী জনতা ও বামপন্থীদের নেতৃত্বের উত্থান অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
ইতোপূর্বে ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের দায়েরকৃত রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় পার্টি-মহাসচিব সাজ্জাদ জহির এবং প্রখ্যাত উর্দূকবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজসহ বেশকিছু নেতৃবৃন্দের বিচার সম্পন্ন হওয়ায় ক্রমশ পার্টির দূর্বল ক্ষমতা প্রকাশ পায়। এ সময় সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) রণদিপ কৌশল বা চরমপন্থা পরিত্যাগ করলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি)ও তাদের চলমান পন্থা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এরপর যখন ’৫৪ সালের জুলাই মাসে সরকার সিপিপি (কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান)-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন এপার বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আন্ডার গ্রাউন্ড বা গোপনে চলে যাওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। অন্যদিকে রাজশাহী জেল থিসিস-এ প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনার আহ্বান এবং আওয়ামীলীগের কিছু কর্মকান্ডের জন্য কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো-র প্রশংসার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের বামপন্থীরা এখানকার জনপ্রিয় সংগঠনগলোর মাধ্যমে প্রকাশ্যে কাজ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পূর্ব থেকেই এ নবতর কৌশল অনুসরনে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন অধিকাংশ নেতাকর্মী।
এরই অংশ হিসেবে ১৯৫১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম অঙ্গ-সংগঠন যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে এ সংগঠনের কর্মচেষ্টা সা¤প্রদায়িক বাতাবরণে সরকার কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের বিরোধীতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে সরকার-বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে এ সংগঠনের নেতাকর্মীগণ নিজেদের প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের অ্যাকশন কমিটিতে জোড়ালো ভূমিকা রাখার মধ্যদিয়ে এ আন্দোলনের নেতৃত্বে দান করে। আর তাই ফেব্রয়ারিতে এ আন্দোলন সম্পন্ন হতে না হতেই মার্চের মধ্যে যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের তিন-চতুর্থাংশকে গ্রেফতার করে পাক-সরকার।
১৯৫২ সালের এপ্রিলে কারাগারের বাইরে থাকা যুবলীগের বাকি নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপিএমইউ) নামক ছাত্র সংগঠনের জন্ম দেন।
প্রধান আদর্শ- অসা¤প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা। অন্যদিকে মূল দল ইপিসিপি-র একাংশ ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগের মাধ্যমে কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং আরেকাংশ এ দলটির সঙ্গে মুসলিম থাকায় তথা সা¤প্রদায়িক আদর্শের আশঙ্কায় ১৯৫৩ সালে হাজী মোহাম্মদ দানেশের সভাপতিত্বে আরেকটি দল গঠন করেন। একই বছরে আওয়ামী মুসলীম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী তাঁর দলে নবাগত বামদের প্রভাবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন এবং দলের নির্বাহী কমিটিতে ৯ জন বামপন্থী নেতাকে অন্তভুর্ক্ত করেন। এতে দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বামপন্থীদের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৫৪ সালে পাক-সরকারের বিতর্কিত প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে ভাসানীর সঙ্গে বামপন্থীগণ যুগপৎ আন্দোলন- সংগ্রাম পরিচালনা করেন এবং মুসলীম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর (আওয়ামীলীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও গণতন্ত্রী দল) সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন।
এ যুক্তফ্রন্ট ’৫৪-র নির্বাচনে মুসলীম লীগকে ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত করে। বামপন্থীরা আলাদাভাবে ৪ টি এবং যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ১৮টি আসন লাভ করেন। এরপর নির্বাচনের কয়েকমাস পরে যুক্তফ্রন্ট বাতিল করা হলে সকল কমিউনিস্ট সংসদ সদস্য আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।
১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের আহবায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কিছু বাস্তবায়নমুখী কর্মসূচীর সঙ্গে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ এবং মওলানা ভাসানীর বিরোধ ঘটে। ৫৪’র নির্বাচনী ২১ দফার মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ক্ষমতায় আরোহনের পর সোহরাওয়ার্দী এটা মেনে নিতে আপত্তি করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের মৈত্রীবন্ধন রক্ষা করতে প্রচেষ্টা চালান।
অতপর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এ ইস্যু সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে সমর্থিত হলে ভাসানী দলের নির্বাহী কমিটির ৯ জন বামপন্থী সদস্যকে নিয়ে আওয়ামীলীগ থেকে পদত্যাগ করেন। পরের বছর ১৯৫৭ সালে ভাসানী আহুত উভয় পাকিস্তানের সকল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক দল ও ব্যক্তিবর্গের এক সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (ন্যাপ) নামক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফ্রন্ট গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী এ নতুন দলের জাতীয় ও পূর্ব-পাকিস্তান অংশের সভাপতি।
এ দলটিই পরবর্তীতে পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় ফ্রন্টে পরিণত হয় এবং শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন বামপন্থী নেতা এ দলের নির্বাহী কমিটিতে স্থান লাভ করেন। একই বছরের ডিসেম্বর মাস্ েউত্তরবঙ্গে অনুষ্ঠিত এক কৃষক সমাবেশে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং আবদুল হককে সেক্রেটারি করে পূর্ব-পাকিস্তান কৃষক সমিতি গঠিত হয়।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাবেক যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহাকে সভাপতি করে গঠিত হয় পূর্ব-পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন। এ বছরের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারি হলে আবার বামপন্থীদের ধরপাকড় শুরু হয়। মওলানা ভাসানীসহ বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ এ সময় গ্রেফতার হন, বাকীরা আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৬২ তে নতুন সংবিধান চালুর পর ভাসানী ছাড়া পেলেও বামপন্থীদের আতঙ্ক থেকে যায় ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বন্ধের প্রভাব এসে আঘাত করে এখানকার বামপন্থীদের।
১৯৬৩-৬৪ সালে এ দ্বন্ধ সামনে চলে আসে; রাশিয়া-চীন, মস্কো-পিকিং। প্রচেষ্টা ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু হলেও অবশেষে ১৯৬৬ সালে চীনপন্থি কমিউনিস্টগণ ইপিসিপি ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদ- লেনিনবাদ) গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অচিরেই ইপিসিপির ছাত্র সংগঠন এবং ইপিএনএপি দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পিকিং বা চিনপন্থীদের ভিত্তি- লেনিনের সাম্রাজ্যবাদতত্ত্ব এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাওবাদী কৌশল। তাঁরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পাকিস্তানের জনগণের এক নম্বর শত্রু বিবেচনা করেন।
(চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।