আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহেরের জবানবন্দি

জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ আপনাদের সামনে দণ্ডায়মান এই মানুষটি, যে মানুষটি আদালতে অভিযুক্ত- সেই একই মানুষ এ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পণ করেছিল। এটা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। একদিন সেই মানুষটির কর্মকাণ্ড আর কীর্তির মূল্যায়ন ইতিহাস অতি অবশ্যই করবে। আমার সকল কর্মে, সমস্ত চিন্তায় আর স্বপ্নে এই দেশের কথা যেভাবে অনুভব করেছি তা এখন বোঝানো সম্ভব নয়।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এই দেশের সঙ্গে আমি রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। আর এরা কিভাবে অস্বীকার করে এই দেশের অস্তিত্বে আমি মিশে নেই। যে সরকারকে আমিই ক্ষমতায় বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই নতুন জীবন দান করেছি, তারাই আজ এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদের ধৃষ্টটা এতো বড়ো যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মতো আরো অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে।

আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সবই বিদ্বেষপ্রসূত, ভিত্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক, সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ। এই ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডকৃত দলিলপত্রে দেখা যায় যে উনিশ শ' পঁচাত্তর-এর ৬ ও ৭ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে সিপাহি অভ্যুত্থান হয়। সেদিন এভাবেই একদল বিভ্রান্তকারীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নির্মূল করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আর দেশের সার্বভৌমত্বও থাকে অটুট।

এই যদি হয় দেশদ্রোহিতার অর্থ তাহলে হ্যাঁ, আমি দোষী। আমার দোষ আমি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছি। সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি।

সেই দোষে আমি দোষী। এর জন্য সেই ছিয়াত্তরের একুশে জুন থেকে আমাকে এভাবে ভয় দেখানো ও কষ্ট দেয়ার কোন দরকার ছিল না। পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর বিচারপতি সায়েমের যে সরকারকে আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি তারা এসব ভালভাবেই জানে। কতগুলো নীতির প্রশ্নে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম। সব রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়ার কথা ছিল।

রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করতে দেয়ার কথা ছিল, আর একটা সরকার গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমার দেশবাসী এর সবই জানে। তারা তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে রেখেছে। আমাকে এভাবে জেলের মধ্যে এমন এক নিম্ন আদালতের সামনে বিচার করার জন্য হাজির করা হয়েছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য চরম অপমানজনক।

আপনাদের কোন অধিকার নেই আমার বিচার করবার। আমার বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগগুলো খণ্ডন করার আগে আপনারদের সামনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই, যা এখানে উল্লেখ করা হবে খুবই প্রাসঙ্গিক। পঁচিশ মার্চের সেই কালরাত্রির কথা আমার মনে পড়ছে। পাকিস্তানি সেনারা বর্বর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের দেশবাসীর ওপর। সেদিন চাপিয়ে দেয়া এক যুদ্ধে জয়ী হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না।

হেরে গেলে আমাদের ওপর চেপে বসতো এক জঘন্যতম দাসত্ব। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের পত্রপত্রিকায় তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিল, বাঙালির উচ্চশিক্ষার যোগ্য নয়। তাদের দৌড় থাকবে মাদ্রাসা পর্যন্তই। বাঙালিরা এমনকি দেশপ্রেমিকও নয়, তাদের সংস্কৃতি নীচু মানের। এদেরকে শুধুমাত্র উর্দু ভাষাতেই কথা বলতে বাধ্য করা উচিত।

যখন থেকে আমার দেশের মানুষের অবস্থা সম্বন্ধে ভালভাবে বুঝতে শুরু করি, তখন থেকেই আমি পাকিস্তানের ধারণাটার সঙ্গেই কখনো একমত হতে পারিনি। জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে বাঙালিরা নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে পারে না- এ ধারণাটাই আমি কখনো মেনে নিতে পারি নি। তখন থেকেই আমি সবসময় চেয়েছি আমার দেশের জনগণের মুক্তি ও বাঙালি জনসাধারণের জন্য একটা ন্যায় ভিত্তিক আবাসভূমি। আমি জানি না, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমার মতো আর কতজন বাঙালি অফিসার এভাবে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের কথা চিন্তা করেছিলেন। নিজের বেলায় এতটুকু বলতে পারি.স্বাধীনতার এই স্বপ্ন এক ধ্রুবতারার মতো আমার সব কাজে পথ দেখিয়েছে।

আমার এখনও মনে পড়ে পাকিস্তানিরা আমাদের কি পরিমাণ ঘৃণা করতো। তাদের অবজ্ঞা ও উপহাস ছিল অসহ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হতো বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকের জাতি। তাদের জন্ম হয়েছে গোলামী করার জন্য। বাঙালিদের 'পাক্কা মুসলমান' ও দেশপ্রেমিক নাগরিক বানানো পাকিস্তানিদের পবিত্র দায়িত্ব।

আমরা যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম তাদের জন্য সেই দিনগুলো ছিল চরম পরীক্ষার মতো। সেদিন আমি দেশ ও জাতির ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করি নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টার থেকে যখন নির্দেশ গেল- 'সবকিছু পুড়িয়ে দাও, যাকে সামনে পাও তাকেই মেরে ফেল'; তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত কারুরই আর জানতে বাকি ছিল না সামরিক জান্তার বর্বর চক্রান্ত। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি নি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জানেন আমি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পেছনের সারির অফিসার ছিলাম না।

আমি ঐতিহ্যবাহী বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পাই, পরে পাকবাহিনীর অভিজাত প্যারা কম্যান্ডো গ্রুপ 'স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ'-এ আমি যোগ দেই। দীর্ঘ ছয় বছর আমি সেই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একজন সৈনিক ও অফিসার হিসাবে সামনাসামনি শত্রুকে মোকাবেলা করতে আমি কখনো ভয় পাইনি। পাক-ভারত যুদ্ধে আমি কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। সেই যুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন এখনো আমার শরীরে বর্তমান।

বাঙালি অফিসারদের মধ্যে একমাত্র আমিই 'মেরুন প্যারাসুট উইং' পাই। আমি একসঙ্গে একশত পঁয়ত্রিশটি স্ট্যাটিক লাইন জাম্প করার কৃতিত্বের অধিকারী। আমার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। জর্জিয়া প্রদেশের ফোর্ট বেনিং.এ অবস্থিত রেঞ্জার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট আমাকে রেঞ্জার পুরস্কার ভূষিত করে। আমি নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্যাগ.এ অবস্থিত স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে সম্মান স্নাতক ডিগ্রী লাভ করি।

উল্লেখ্য, তখনো পর্যন্ত আর কোন বাঙালি অফিসার এই কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হননি। এখন সামরিক জান্তার বর্বরতম ফ্যাসিস্ট আক্রমণের দিনগুলো ফিরে আসা যাক। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলাম। দেশে ফিরে দেখি নির্বাচন হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছে।

দেশে ফিরে অনেকের সঙ্গে আলাপ করার পর আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হবে না। সামরিক জান্তা আর তার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টা, এই লোকটা পাকিস্তানি রাজনীতির অধ্যায়ে একটা জ্বলন্ত অভিশাপ, এরা কোনদিনই রাষ্ট্রক্ষমতার আইনানুগ দাবীদার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল যে তারা কখনো পাকিস্তানে কোন বাঙালিকে ক্ষমতাসীন হতে দেবে না, শেখ মুজিবকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে বা সহ্য করতে পারছিল না। আমি অঘটনের আভাষ পেলাম। তাই আমার স্ত্রী ও পরিবারকে ময়মনসিংহে আমার গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেই।

সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের প্রকোপ তখনো যায়নি। আমি জানতাম বাঙালিরা কোন অন্যায়কেই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে না, তারা প্রতিরোধ করবেই। আমার মনে হচ্ছিলো দেশের মানুষকে স্বাধীন করার দিন এগিয়ে আসছে। জানি না কয়জন এভাবে ভাবতেন।

যতই দিন যাচ্ছিলো, আমাদের মন মানসিকতারও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিলো। আস্তে আস্তে আমরা অনিবার্য ঘটনাবলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলাম। পঁচিশে মার্চ আমি কোয়েটায় স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস এ উচ্চতর কারিগরি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলাম। সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারলাম সেদিন রাতে বাংলাদেশে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে। সারা রাত আমি কোয়েটার খালি রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম।

কি হচ্ছে তা আঁচ করবার চেষ্টা করছিলাম। সেই রাতে আমার জাতির ওপর কি সীমাহীন দুর্যোগ নেমে এসেছিল তা আমি এখনো কল্পনা করতে পারি না। বাংলাদেশের বুকে যেন এক নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। পরদিন ২৬শে মার্চ ভোরেই রেডিওতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরে ভাষণ শুনলাম। সে এক ভয়ংকর মুহূর্ত।

এক নতুন দেশের জন্ম যন্ত্রণা যেন আমি অনুভব করছিলাম। বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি আমার বিদ্বেষ কোন গোপনীয় ব্যাপার ছিল না। তাই অচিরেই আমি উপরওয়ালাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করে আটাশে মার্চ স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসের কোর্স বন্ধ করে দেয়া হলো, আমাদের সবাইকে যার যার ইউনিটে যোগ দিতে আদেশ দেয়া হলো। সে সময় অনেক বাঙালি জুনিয়র অফিসার আমার কাছে এসে পরামর্শ চায়।

আমি তাদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দেই মাতৃভূমির প্রতিই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য। তাদের একমাত্র চিন্তা হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যেয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়া। এরা আমাকে আরো জানায় যে তারা কোয়েটায় অবস্থানরত অন্য আরো সিনিয়র অফিসারদের কাছে গেয়ে তারা এদের উপদেশ দেয়া তো দূরের কথা সৌজন্য করে আপ্যায়ন কিংবা কথাটা পর্যন্ত বলে নি; শেষে আবার পাকিস্তানি প্রভুরা তাদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ করে। আমার মনোভাব জানার পরে এ সমস্ত সিনিয়র অফিসাররা আমাকে শুধু এড়িয়েই চলে নি, এমনকি কথা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। আজকে সেই একই অফিসারদের অনেকেই এদেশের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে বেশ উচ্চপদে রয়েছেন।

আর তাদের কয়েকজন আবার আমার বিচার করার জন্য এখানে উপস্থিত রয়েছেন। পঁচিশে মার্চের আগে এই অফিসাররা শেখ মুজিবের সঙ্গে তাদের পরিচয় ও সম্পর্কের কথা জাহির করতে বেশ উৎসাহ পেতেন, পঁচিশে মার্চের পর এরাই আবার তাঁকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেন। (ভাষণের এই পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাহেরকে বাধা দেন। এখানে এই ধরনের কথা বলা যাবে না বলে তাঁকে জানানো হয়। কোর্টের মধ্যে প্রচণ্ড বাক বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়।

তাহের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে বলেন-'আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিলে আমি বরং চুপ থাকাটাই ভালো মনে করব। এমন নিম্ন মানের ট্রাইব্যুনালের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করছি। নিজের ওপরই ঘৃণা লাগে। ' আরো বাকবিতণ্ডার পরে তাহেরের আইনজীবীদের হস্তক্ষেপের ফলে শেষে তাহেরকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দেয়া হয়। ) পরে আমি জেনে খুব খুশী হই যে যাদের আমি পালিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নূর ও সেকেন্ডে লেফটেন্যান্ট এনাম পালিয়ে যেতে পেরেছে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।

কয়দিন পরই পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করার অভিযোগে আমাকে কোয়েটায় নজরবন্দি করা হয়। স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস এর কমান্ডাণ্ট বি. এম. মোস্তফার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন পর তাঁর হস্তক্ষেপে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো তুলে নেয়া হয়। খারিয়া সেনানিবাসে একটা মাঝারি রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করা হয়। আমাকে আমার আগের কমান্ডে ইউনিটে ফিরে যেতে দেয়া হয়নি।

এই ইউনিটকে ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল আমার ভাইদের হত্যা করার জন্য। এরাই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। খারিয়া সেনানিবাসে আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ারকে আমার সঙ্গে পালিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মিরপুর শহরে কর্মরত এক বাঙালি প্রকৌশলীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার আর সীমান্ত পর্যন্ত যাবার ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

কিন্তু নির্ধারিত দিনে মিরপুর পৌঁছে দেখি, অবাক কাণ্ড, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাসায় তালা মেরে পরিজন সহ সটকে পড়েছেন। এই প্রথম দেখলাম বাঙালি অভিজাত শ্রেণীর দেশপ্রেমের নমুনা। বিকেলটা আমরা তার লনে বসেই কাটিয়ে দিলাম। রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পাহাড়ি পথে রওয়ানা দিলাম। আমার দুই সহযাত্রী ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের পাহাড়ি পথে হেটে অভ্যাস নেই।

কয়েক ঘণ্টা পর তারা আর এগোতে পারলো না। আমাদের আবার ফিরে আসতে হলো খারিয়াতে। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় এক হাজার বাঙালি অফিসার ছিলেন। তাদের অনেককেই বললাম পালিয়ে যেয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে। বোঝাতে চেষ্টা করলাম।

কিন্তু আসলে এদের দেশপ্রেম ড্রইং রুমের তর্কবিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এর বেশী না। পরে যখন আমি এবোটাবাদে বালুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি হয়ে যাই সেখানেও আমি বাঙালি অফিসারদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতাম। সৌভাগ্যবশত এদের মধ্যে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে কর্মরত মেজর জিয়াউদ্দিন আমার সঙ্গে পালাতে রাজী হয়ে যান। আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেরী হলো না। আমার যা সঞ্চয় হল তার দিয়ে একটা পুরানো গাড়ী কিনলাম।

গাড়ী দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। পিণ্ডি থেকে আমরা দু'জন রওয়ানা দিলাম। পথে ঝিলাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে সঙ্গে নিলাম। দিনের আলো তখনো কিছু বাকী ছিল। তাই শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে মেজর মঞ্জুরের বাসায় উঠলাম।

আমার পরিকল্পনা শুনে মঞ্জুর চুপ হয়ে গেলেন। তার মধ্যে কোন উৎসাহ দেখলাম না। কিন্তু তার স্ত্রী জেদ ধরলে বাঙালি ব্যাটম্যানসহ মেজর মঞ্জুর সপরিবারে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সন্ধ্যার পর গাড়ী করে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছলাম। তারপর গাড়ী ফেলে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমরা ভারতে পৌঁছি।

আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম এই ভেবে যে এবারে সব শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি ঘটবে। কিন্তু যুদ্ধের পর দেশের কি দশা হলো? যে যুদ্ধের বেশীর ভাগই হয়েছিল স্বদেশের মাটির বাইরে, সে যুদ্ধ আমাদের জনগণকে কি সুফল উপহার দিতে পারে। নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয়, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল আশ্রয় আর খাবারের খোঁজে। বেঁচে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে বেশীরভাগই তাই- করেছিল। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য নেতৃত্বদানকারী গণ সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর ছিল ঐ একই উদ্দেশ্যে।

কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট লাভকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ছিল এক বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুর্ভাগ্যবশত সম্পূর্ণ অস্ত্র বলহীন একটি নিরস্ত্র জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনরকম চিন্তাই করেনি। সম্ভাব্য ভয়াবহতা মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকে তারা জনগণকে কোনভাবেই প্রস্তুত করেনি। একটা আধুনিক সেনাবাহিনীর সশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে বেসামরিক জনসাধারণের সংঘাতে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা চরম বোকামি। আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছিল, আর সে জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হয়েছে চড়া ভাবে।

দেশের অজস্র মানুষের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে আওয়ামী নেতৃত্ব যদি আন্তরিক ও সাহসী ভূমিকা নিত তাহলে ঘটনা প্রবাহ অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের সৈন্যদের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা খাটে। অত্যাসন্ন জাতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। পরিণামে বিশ্বের এক অন্যতম প্রধান আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিভাবে অনিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে তার কোন পরিকল্পনাই ছিল না।

ভারত খুব খুশী মনেই আমাদের শিশুদের, সাধারণ মানুষকে আর সেনাদের প্রতি খাবার আর আশ্রয়ের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত ছিল। কারণ ভারত জানতো এতে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর কূটনীতির অঙ্গনে তাদের সম্মান ও ভাবমূর্তি বেড়ে যাবে। আর উপমহাদেশে তার আধিপত্য বিস্তারের নীতি ও আরও সুদৃঢ় হবে। আসলে বাংলাদেশের ঘটনায় ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থ ও সম্পদের দিক থেকে সবচাইতে বেশী লাভবান হয়েছিল ভারত। যুদ্ধের ব্যাপারে এতটুকু বলতে পারি- আমাদের অফিসার ও সৈনিকরা মূলত ভারতীয়দের ইচ্ছামাফিক তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছিল।

আমি যখন যুদ্ধে যোগ দেই তখন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী আমাকে বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের খুঁতগুলো চিহ্নিত করে আরও সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার উপায় খুঁজে বের করা। প্রথমেই আমি এগারো নং সেক্টরে যাই। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে বিস্তৃত এই সেক্টরের সীমানা। বর্তমানে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এই এলাকায় প্রচলিত সামরিক কায়দায় একটা ব্রিগেড গঠনের চেষ্টা করছিলেন।

তখন এই সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং। আমি দেখে অবাক হয়ে গেলাম, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এজন্য ভারতীয় অফিসারকে। রণ কৌশলগত দিক দিয়ে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য এই সেক্টরের গুরুত্ব অপরিসীম। আমি ঘুরে ঘুরে সেক্টরের পর সেক্টর পরিদর্শন করতে থাকলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমি মিশে গেলাম; তাদের সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করলাম।

আমার কাছে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে যাদের ওপর আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তাদের কেউই সেই দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। সোজা কথায় তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের জাতীয় যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রায় হেরে যাওয়া একটা ব্যাপার। অথচ আমরা যুদ্ধ করছিলাম একটা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমাদের শত্রুরা সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত সুশিক্ষিত।

তারা কঠোরভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। অন্যদিকে আমাদের এমন কোন সুসংহত নেতৃত্বই ছিল না যা এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতাশাগ্রস্ত সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সুযোগ সুবিধা কিংবা অস্ত্রশস্ত্রের কিছুই ছিল না। অথচ আমাদের নেতৃত্ব তখন বিদেশের মাটিতে একটি প্রচলিত ধরনের সেনাবাহিনী গঠনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন।

আমাদের ছেলেদের কখনও সাহস কিংবা দেশপ্রেমের অভাব ছিল না। কিন্তু তারা ছিল অসংগঠিত, বিভিন্ন দলে বিভক্ত স্বাধীনতা পাগল দামাল ছেলে; যারা কখনও পাক বাহিনীর সামরিক আক্রমণের কথা চিন্তাও করেনি। অসতর্কাবস্থায় এরা তাই পাকিস্তানিদের জঘন্য গণহত্যার শিকার হয়। আমাদের যুদ্ধকৌশলের দুর্বলতাগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল। প্রথমত আমরা সমস্ত জাতি এক যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম।

অথচ আমাদের সামনে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ কখনো বিকাশ পেতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত গেরিলা যুদ্ধের তাত্ত্বিক কাঠামো সম্বন্ধে নেতৃত্বের কোন ধারণাই ছিল না। কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর খালেদ ও মেজর শফিউল্লাহর মতো অন্যান্য যারা নিয়মিত সামরিক কাঠামোর লোক তাঁদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই চিলেন যারা গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংগঠন করতে হয় সে সম্বন্ধে কোন ধারণা রাখতেন।

গেরিলা যুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বড় বাধা ছিল এসব অফিসার আর তাদের প্রচলিত কায়দার সামরিক চিন্তাভাবনা। তৃতীয়ত স্বাধীনতা যুদ্ধের সামরিক নেতাদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য ও অফিসারদের কতগুলো নিয়মিত ব্রিগেডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। সাধারণভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাই প্রয়োজনীয় সামরিক নেতৃত্ব ও কলাকৌশল অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এর আসল কারণ হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর নেতাদের মুক্তি সংগ্রাম সম্বন্ধে ধারনার অভাব।

তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে একটা নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলে নিজেদের ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করা যায়। তখন বলা হচ্ছিল যথা সময়ে বিশ ডিভিশন সৈন্যের এক বাহিনী গড়ে তোলা হবে। আর ঠিক এভাবেই তখন বিকাশমান একটি জাতীয় গণযুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশের গতি রুদ্ধ করা হচ্ছিল। দেশের ভেতর মুক্তিসেনারা বীরের মতো যুদ্ধ করে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো কেউই ছিল না। বাইরে থেকে বাধা না আসলে হয়তো দেশের ভিতরেই স্বাভাবিকভাবে যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারত।

আগরতলা আর মেঘালয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ আর জিয়ার নেতৃত্বে যে দুই ব্রিগেড সুশিক্ষিত সৈন্য গড়ে উঠেছিল তাদের যদি মুক্তিযুদ্ধে সঠিকভাবে নিয়োজিত করা হতো তাহলে সাত.আট মাসের মধ্যেই দেশের মাটিতে ক্ষেতমজুর-কৃষকদের নিয়ে বিশ ডিভিশনের এক বিশাল গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যেত। আমার কথা শুনে কর্নেল ওসমানী যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন। তখন তাঁর কাজকর্ম খুব সহজই ছিল। ঘুমানো জন্য তাঁর একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল। আর ঘুরে ঘুরে সেক্টর সদরগুলো দেখার জন্য তাঁর হাতে থাকতো অনেক সময়।

আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নামে এক প্রহসন। নেতৃত্ব ছিল পাগলামীর নামান্তর। একটা গেরিলা যুদ্ধ আর একটা নিয়মিত যুদ্ধের মধ্যে আসলে অনেক তফাৎ। কিন্তু কর্নেল ওসমানী কখনোই তা বুঝতে চাননি। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম দিকেই একটা নিয়মিত বাহিনী গঠনের চিন্তা করা একদম ঠিক নয়।

ঠিক সময় এলে একটা গেরিলা বাহিনী নিজেই নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত হয়। এগারো নং সেক্টরের কৌশলগত গুরুত্ব দেখে সেখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। বিভিন্ন সেক্টর ঘুরে বেড়ানোতে শুধু সময়ের অপচয় হতো মাত্র। ওসমানী অসন্তুষ্ট মনেই আমাকে সেক্টর প্রধান নিয়োগ করলেন। (এতটুকু বলার পর তাহেরকে আবার বাধা দেয়া হয়।

আবারো বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। তাহেরকে তাড়াতাড়ি শেষ করতে বলা হয়। কর্নেল তাহের তখন বলেন- এভাবে আমাকে বাধা দিতে থাকলে জবানবন্দি বলে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমার জীবনে অনেক নিচু লোকই চোখে পড়েছে, কিন্তু আপনার মতো নীচ মনের লোক আমি একজনও দেখিনি। ) চতুর্থত বাংলাদেশের মাটিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাদের সিদ্দিকী, মেজর আফসার, খলিল, বাতেন ও মারফতের মতো এরা অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক বিশাল দল গড়ে উঠেছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধরত শক্তিগুলোর এটাই ছিল স্বাভাবিক বিকাশ। দুর্ভাগ্যবশত কর্নেল ওসমানীর নিয়মিত সামরিক কমান্ড ও প্রবাসী সরকার এই স্বাভাবিক শক্তির বিকাশকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তার ফলে নিয়মিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়নি। পঞ্চমত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অশুভ প্রভাবে মুক্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক ছেলের মাথায় ব্যক্তিগত লোভ-লালসার চিন্তা ঢুকে যায়। এদের আদর্শগত ভিত্তি ছিল নিতান্তই দুর্বল।

এরাই অনেক লুট-পাটের ঘটনার নায়ক। এসব সমস্যা সমাধানের পথ ছিল একটাই। তা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তাঞ্চলে প্রবাসী সরকারকে নিয়ে আসা। আমি সামরিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেষ্টা করি যেন ভারতীয় এলাকা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। মেজর জিয়া আমার সঙ্গে একমত হলেন।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সব কমান্ড সীমান্তের এপারেই স্থানান্তর করা উচিত। আমাদের ইচ্ছা ছিল সব সেক্টরে সমন্বিত ভাবে একটা নির্ধারিত সময়ে এই কাজ হোক। তাই সেক্টর কমান্ডারদের একটা সভা ডাকা হলো। কর্নেল ওসমানী সহ মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর শফিউল্লাহ আমার প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। বাংলাদেশের মাটিতে সেক্টর সদর দপ্তর স্থানান্তর করা থেকে আমাদের বিরত করা হলো।

শুধু তাই না, মেজর জিয়ার ব্রিগেডকে আমর সেক্টর থেকে সরিয়ে নেয়া হলো। আমার সঙ্গে থেকে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ নামে একজন বিমান বাহিনীর অফিসার ও যুদ্ধাহত অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মান্নান। যাতায়াতের জন্য আমাকে শুধুমাত্র একটা জিপ দেয়া হয়েছিল। আমাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সিং ভাবলেন তিনি তাঁর ইচ্ছামতো আমাদের চালাতে পারবেন। ব্রিগেডিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে 'তুরা' নামে এক জায়গায় আমার সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করার পরামর্শ দিলেন।

উল্লেখ্য, আমাদের প্রায় সব সেক্টর সদরই ছিল ভারতের অনেক ভেতরে। আমাদের প্রায় সব সেক্টর অধিনায়কই তাদের তাবুতে কার্পেট ব্যবহার করতেন। আমি ব্রিগেডিয়ার সিং-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। কামালপুর শত্রু-ঘাটির আটশ' গজ দূরে অবস্থিত হলো এগারো নং সেক্টরের সদর দপ্তর। আমি ভালোভাবেই জানতাম আমাকে সেই পথের ওপর জোর দিতে হবে যা আমাদেরকে এনে দেবে চূড়ান্ত বিজয়।

আর এই পথ হবে কামালপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল হয়ে শেষে ঢাকা। কামালপুরই ছিল ঢাকার প্রবেশদ্বার। আমি এখন সুবেদার আফতাব নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি স্মরণে কিছু বলতে চাই। সে ছিল সুঃসাহসী এক নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা। সে কখনো দেশের মাটি ত্যাগ করে নি।

কিছু সংখ্যক যুবককে নিয়ে সে বীরত্বের সঙ্গে পাক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো; মওকা পেলেই সে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তো। এগারো নং সেক্টরে আসার পর আমি শুনতে পেলাম সুবেদার আফতাব এক বিদ্রোহী। সে কারো আদেশ-নির্দেশের তোয়াਆা করে না। রৌমারি থানার কোদালকাঠি নামে এক জায়গায় সে অবস্থান করছিলো। বারবার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও সে কখনোই মেজর জিয়া বা ব্রিগেডিয়ার সিং-র সঙ্গে দেখা করে নি।

আমি আফতাব সম্বন্ধে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে পড়লাম। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আঠারো মাইল হেঁটে আমি কোদালকাঠি পৌঁছাই। সে দারুণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। দেশের ভূখণ্ডে খোদ একজন অফিসারকে দেখবে তা সে কখনো আশাই করেনি।

যুদ্ধ কৌশল নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে দেখি আমাদের মত অভিন্ন। তারপর থেকেই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে যাই। (ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আবারো বাধা দিলেন। তাহের তখন বলেন- এই কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। আপনিতো (চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্যে করে) যুদ্ধে ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা থাকবে।

' এই বলে তিনি আবার শুরু করেন। সুবেদার আফতাব আমাকে জানালো, সে রৌমারি থানার এক বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। ষোলই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকাগুলো মুক্তাঞ্চল ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাই সে ভারতের অভ্যন্তরে ঘাঁটি স্থাপন করতে অস্বীকার করে আসছিল। সে রাত আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দিলাম।

দেখলাম সে খুব সহজেই মানুষের নেতৃত্বের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে পেরেছে। তার সামনে নিজেকে বড়ো ছোট লাগলো। সুবেদার বললো সে যে কোন কিছু করার জন্য প্রস্তুত আছে। ওদের অবস্থানের কিছু দূরে এক চরে পাকিস্তানিদের এক ঘাঁটি ছিল। আমি তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা আক্রমণের প্রস্তাব দিলাম।

দুই শিবিরের মধ্যে একটা নদী। পাকিস্তানিরা যে চরে অবস্থান নিয়েছিল তা একটা খালের মাধ্যমে দু ভাগে ভাগ হয়ে আছে। আমি আর সুবেদার একটা নৌকায় করে চরে পৌঁছলাম। দেখি পাকিস্তানিরা চরের অন্য প্রান্তে। এই চর ছিল ঘন কাশবনে ঢাকা।

আমি পরিকল্পনা করলাম একদল যোদ্ধা রাতে নদী পার হয়ে খালের পাশের কাশবনে অবস্থান নেবে। পরদিন ভোরে একটা ছোট দল বের হবে পাকিস্তানিদের হাতে তাড়া খাবার জন্য। চারদিনের মধ্যেই সুবেদার আফতাব পরিকল্পনা মাফিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। যা আশা করেছিলাম তাই হলো, পাকিস্তানিরা ভোরবেলার দলটাকে পিছু ধাওয়া করলো। এভাবে ওদের মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু ফাঁদের আওতার ভেতরে নিয়ে আসা হলো।

প্রথম দফা আক্রমণেই পাকিস্তানিদের বেশ বড়োসড়ো ক্ষতি হলো। ওরা দু'বার আক্রমণ করলো, দু'বারই আক্রমণ প্রতিহত হওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তারা পালিয়ে গেল। এভাবেই রৌমারি থানা সহ বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা আমাদের দখলে আসে। এরপর আমরা চিলমারীর ওপর নজর দেই। চিলমারী যুদ্ধ এক পরিচিত সংঘর্ষ।

আমি এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তখন মাঝ সেপ্টেম্বর। একরাতে বারো শ' মুক্তিযোদ্ধা ব্রহ্মপুত্র নদী পাড়ি দিল। আমাদের লক্ষ্যস্থল পাহারায় ছিল দুই কোম্পানি পাকিস্তানি নিয়মিত সৈন্য। এছাড়া অজস্র রাজাকার তো ছিলই।

আমরা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত চিলমারী বন্দরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। আর প্রচুর গোলাবারুদ ও যুদ্ধবন্দি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। এটা ছিল এক দুঃসাহসিক আক্রমণ। এমন নজির যুদ্ধের ইতিহাসে কমই আছে। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই রেডিওতে প্রচারিত স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত সংবাদের বেশীর ভাগেই থাকতো আমাদের সেক্টরের খবর।

এমনকি বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসনও আমাদের এলাকার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এই বলে- কামালপুরের ঘাঁটি পতনের মানেই হচ্ছে পাকিস্তানিরা এই যুদ্ধে হেরে গেছে। কামালপুরে যুদ্ধ পরিচালনার সময় আমার একটা পা হারাই। আমার সেক্টরের ছেলেরাই সবার আগে ঢাকা পৌঁছেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে যেয়ে অবশ্যই আমাদের মুক্তিসেনাদের দেশপ্রেম, বীরত্ব ও আনুগত্যের উল্লেখ করতে হয়। এরাই জাতির সেরা সন্তান।

এছাড়াও গ্রামের সব গরীব গ্রামবাসীদের কথাও বলতে হয়। এরা আমাদের দিয়েছে খাদ্য ও আশ্রয়। শত্রু-সনার অবস্থান সম্পর্কে তারা আমাদের সব সময় খবর দিয়েছে। এরা ছিল আমাদের সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণার উৎস। আমার হাতে তো তাও একটা অস্ত্র ছিল।

এদের কাছে কিছুই ছিল না। আমাদের সাহায্য করতে যেয়ে এরা পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হয়েছে। তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের স্ত্রী-মা-বোনদের সম্মানহানি করা হয়েছে। এরাই ছিল আসলে সবচেয়ে বেশী সাহসী। এদের কথা আমি সব সময় মনে রাখবো।

ষোলই ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। এতে আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অসাবধানী, অযোগ্য ও দেউলিয়া আচরণের জন্যই প্রবাসী সরকার সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়েছিল। এর ফলে ভারতীয় হস্তক্ষেপের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঘাঁটিগুলো ভারতে থাকায় ও ভারতের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের নিয়মিত সৈন্যরা ছিল মানসিকভাবে দুর্বল ও হীনমন্য।

বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা দেয়া মাত্রই ভারতীয় সৈন্যরা বিজিত সম্পদের ওপর বিজয়ী বাহিনীর মতোই হাত বসালো। জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ, আমি এখানে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই একজনের কথা। ভারতীয় সৈন্যদের লুট-পাটে বাধা দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন এই কমান্ডিং অফিসার। তিনি মেজর এম. এ. জলিল; নয় নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক। তিনিও এই মামলায় একজন সহ-অভিযুক্ত।

জলিলকে এর জন্য যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছিল। দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তাঁকে দীর্ঘদিন করা প্রাচীরের অন্তরালে কাটাতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবার পর মেজর জলিল আরেকটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। তরুণ বিপ্লবীদের প্রতিনিধি আ.স.ম.আব্দুর রব (যিনি এ মামলায় একজন সহ-অভিযুক্ত)-এর সহযোগিতায় মেজর জলিল বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ গঠন করেন। এখানে উল্লেখ্য আ.স.ম.আব্দুর রব সেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.