লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনের বাকি আর দুই দিন। আজ শনিবার সারা দিন সেখানে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে অস্ত্র প্রদর্শন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হামলা-মামলা আর মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।
এখানকার নির্বাচনে ছেলে এ কে এম সালাহউদ্দিন টিপুকে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী করে আনতে সব ধরনের কৌশলই কাজে লাগাচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের কথিত গডফাদার, পৌর মেয়র আবু তাহের।
সবকিছুই চলছে তাঁর ইশারায়। যেখানে যা প্রয়োজন, তার সবই করছেন তিনি। অনুরোধ, জোর খাটানো, হুমকি-ধমকি, অর্থ ব্যয়, তদবির থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই, যা তিনি করছেন না। অনুরোধে কাজ না হলে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করছেন। তাতে কাজ না হলে জোর খাটাচ্ছেন, হুমকি দিচ্ছেন।
২০১১ সালে পৌর মেয়র হওয়ার পর লক্ষ্মীপুরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা আবু তাহের তা নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। লক্ষ্মীপুরের রাজনীতিতে পরিবারের নিয়ন্ত্রণকে একচ্ছত্র করতে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে কাজ করেন তাহের। গত সংসদ নির্বাচনে ছেলে সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রার্থী করেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনে। কিন্তু মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পরে স্ত্রী নাজমা তাহেরকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সাংসদ নির্বাচিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন মেয়র।
কিন্তু সে চেষ্টায়ও বিফল হন তিনি। তাই এবারের উপজেলা নির্বাচন তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছেলের একাধিক নির্বাচনী সভায় তিনি বলেছেন, টিপু বিজয়ী না হলে তিনি বাঁচবেন না।
লক্ষ্মীপুরের ভোটাররা মনে করেন, মেয়র উপজেলা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে জেলায় তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় হবে।
আর সে লক্ষ্যে মেয়রের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে।
আবু তাহের প্রতিদিনই নির্বাচনী প্রচারণায় বের হচ্ছেন। পৌর মেয়রের গাড়িতে চড়ে চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন এলাকা। তাঁর স্ত্রীও ওই গাড়ি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে যান প্রতিদিনই। মেয়রের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও কেউ এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকার সাবেক সাংসদ বিএনপির নেতা শহীদউদ্দিন চৌধুরী।
নির্বাচন কমিশনও একরকম চুপ।
চলছে শো-ডাউন
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তাহের বাহিনীর শো-ডাউন অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে আজ শনিবারও উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন ও পৌর সদরের প্রতিটি ওয়ার্ডেই মোটরসাইকেলের মহড়া দিয়েছেন তাহের বাহিনীর সদস্যরা। অনেক জায়গায় সশস্ত্র মহড়ায় অংশ নিতে দেখা গেছে তাঁদের। এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে শাসিয়ে গেছেন।
বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে গেলেও যেসব সমর্থক এলাকায় আছেন, তাদের ভোটের দিন কেন্দ্রে না যেতে বলা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন আজও প্রচারে থাকতে পারেননি বিএনপির সমর্থক প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন বকুল বলেন, মেয়রের ছোট ছেলে শিবলুর নেতৃত্বে শাকচর ইউনিয়নে এবং হালিম মাস্টারের নেতৃত্বে ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নে তাঁর নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে পোস্টার ও এজেন্ট কার্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মারধর করে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
একই এলাকায় ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সহ-সভাপতি আবুল কাশেমকে সন্ধ্যায় মারধর করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় সন্ত্রাসীরা।
সন্ধ্যায় বশিকপুর ইউনিয়নে মহড়া দিয়েছে সশস্ত্র ক্যাডাররা। র্যাবের টহল দলের সামনেই এ ঘটনা ঘটনা ঘটলেও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পুলিশি অভিযান-মামলা অব্যাহত
গত কয়েক দিনের মতো পুলিশি অভিযান ও মামলা অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মাহমুদুল হক দীপুর ইউনিয়ন মান্দারি এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। রাতভর তারা সেখানে টহল দিয়েছে।
বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে নেতা-কর্মীদের বাড়িতে না পেয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, তাঁদের কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া আর আতঙ্ক তৈরি করতে এ ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে।
বিএনপির জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমান জানান, গতকাল দত্তপাড়া ইউনিয়নে বিএনপির ৬৭ জন নেতা-কর্মীসহ ৩০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে পুলিশ। উত্তর জয়পুরে ৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ওই ইউনিয়নের বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীই এলাকায় থাকতে পারবেন না।
নির্বাচনে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্ট দেওয়াও তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে জানতে লক্ষ্মীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার শেখ শরীফুল ইসলামের মোবাইলে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
দিনভর গুজব আর গুজব
শনিবার দিনভর নানা গুজবে মুখরিত ছিল লক্ষ্মীপুর। সকাল থেকেই পুরো শহরে কানাঘুষা শুরু হয়, বিএনপির নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলাসহ কয়েকটি মামলায় সাজা পাওয়া আবু তাহেরের বড় ছেলে এ এইচ এম বিপ্লব ছাড়া পেয়েছেন। দিনভর নানা সূত্রে খবর নিয়েও এ বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রাজনৈতিক কর্মী বলেন, আতঙ্ক তৈরির জন্য মেয়রের পক্ষের লোকজন ইচ্ছে করেই এ গুজব ছড়িয়েছে। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন বকুল বলেন, বিপ্লব লক্ষ্মীপুর জেলে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হুমকি-ধমকি দেন সবাইকে। তাঁর ভাই টিপুর পক্ষে ভোটে কাজ করার জন্য সবাইকে নির্দেশনা দেন জেলখানায় বসেই। তাঁর বের হয়ে আসার বিষয়টিকে গুজব হিসেব চিহ্নিত করেন লক্ষ্মীপুরের জেল সুপার।
আরেকটি গুজব ছিল প্রার্থিতা নিয়ে। শনিবার বিকেলে শহরে প্রচার হয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান পদে তাদের সমর্থন পরিবর্তন করেছে। সালাহউদ্দিন টিপুর পরিবর্তে মহিউদ্দিন বকুলকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশে এ পরিবর্তন হয় বলে শহরবাসীর মুখে মুখে শোনা যায়। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ বিষয়টি ঠিক নয় বলে জানান।
পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীরা নির্বাচনী দায়িত্বে
নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রার্থীদের কাছ থেকে। তাঁরা বলছেন, পৌরসভার অনেক কর্মচারীকে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পৌর মেয়রের প্রভাবে এসব কর্মকর্তা নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এ এলাকায় ১৫৯টি কেন্দ্র। পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়িত্ব না দিলে এত কর্মকর্তা কোথায় পাব।
’ তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, পৌরসভার ১৫/২০ জন কর্মকর্তাকে নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো গায়েব
আজ লক্ষ্মীপুরের পাঠকেরা প্রথম আলো পাননি। সকালেই গায়েব হয়ে যায় সব পত্রিকা। ‘লক্ষ্মীপুরে জান বাঁচানো ফরজ’ শিরোনামে গতকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
সরেজমিন এ প্রতিবেদনে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরে তাহের বাহিনীর নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। সকালে জেলায় পত্রিকা আসার পরপরই হকার ও এজেন্টদের কাছ থেকে সব পত্রিকা নিয়ে যান তাহের বাহিনীর সদস্যরা। লক্ষ্মীপুর-চন্দ্রগঞ্জের হকার ও এজেন্টরা জানান, সকালেই পত্রিকা আসার পর কয়েকজন লোক সব পত্রিকা কিনে নিয়ে যান।
এরপর অনলাইনে সংবাদটি পড়ে লক্ষ্মীপুরের অনেকেই আশেপাশের এলাকা থেকে পত্রিকা কিনে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময় ফটোকপি করে বিক্রি করেছেন অনেকেই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।