মানুষ আসে মানুষ যায় কিন্তু সময় যায় চিরতরে
কর্নেল তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা নিয়ে রিট আবেদনের শুনানিতে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদকেও আদালতে তলব করা যায় বলে মনে করেন মো. আনোয়ার হোসেন।
মওদুদের লেখা একটি বইয়ে ওই বিচারের প্রসঙ্গ আসায় তাহেরের ভাই আনোয়ারের মত, বিএনপি নেতাকে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে।
মওদুদের 'ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট' শিরোনামে বইয়ে 'দ্য ট্রায়াল অব তাহের' অধ্যায়ে ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচার এবং তাতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা উঠে এসেছে।
বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ তার বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থনে জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, যা দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক নিজেই স্বীকার করেছেন।
১৯৯৫ সালে মওদুদের বইটি যখন প্রকাশ হয়, তখন তিনি আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টিতে ছিলেন।
পরে যোগ দেন বিএনপিতে।
স্বাধীনতার আগে এবং অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন মওদুদ। এরপর জিয়ার সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এরশাদ সরকারের মন্ত্রিপরিষদেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।
তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা নিয়ে তার ভাই ও স্ত্রী উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করলে দুই যুগের বেশি সময় আগের বাংলাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
ওই রিট আবেদনের শুনানিতে সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি গোপন আদালতে কর্নেল তাহেরের বিচার চলার সময়কার ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এমএম শওকত আলীকে তলব করেছে।
এর একদিন আগেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে '৭৬ এর অগাস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কর্মরত মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশুসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নাম, ঠিকানা ও অবস্থান আগামী ১৮ জানুয়ারির মধ্যে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেয় আদালত।
কর্নেল তাহেরের ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আদালত মওদুদ আহমদকে তলব করলে ওই বিচার সম্পর্কে মওদুদের কাছে জিয়ার স্বীকারোক্তি সম্পর্কে জাতি আরো অনেক কিছু জানতে পারতো। "
তাহেরের সঙ্গে গোপন বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন আনোয়ার হোসেনও। তবে তার কারাদণ্ড হয়।
মওদুদ তার বইয়ে লিখেছেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী ক্ষুদিরাম ও সূর্যসেনের পর রাজনৈতিক মামলায় প্রথম মৃত্যুদণ্ডের শিকার হন কর্নেল আবু তাহের।
তাহেরের বিচারে গঠিত সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রত্যাগত সেনাকর্মকর্তা। এছাড়া তাহেরের দণ্ড দানের বিষয়ে ৪৬ জন সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে জিয়ার ডাকা একটি সভায় পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তারা মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সমর্থন জানান বলেও বইতে উল্লে¬খ করা হয়।
বইয়ের 'সিপাহী বিদ্রোহ : জিয়াউর রহমানের উত্থান' অধ্যায়ে বলা হয়, জাসদের গণবাহিনী ও সামরিক শাখা বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে।
মুক্ত হওয়ার পর জিয়া কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বলেও বইটিতে লেখা রয়েছে।
তাহেরের প্রসঙ্গে মওদুদ লিখেছেন, "তাহের ফাঁসির পূর্বে দেওয়া জবানবন্দিতে জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, এমন বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের দেশের ইতিহাসে ১৭৫৭ সালে একবারই হয়েছিলো। মীর জাফরের ওই বিশ্বাস ঘাতকতায় বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের জনগণ ২০০ বছরের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছিলো।
এরপর মামলা প্রস্তুত করতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। ১৯৭৬ সালের মে মাসে তাহেরকে রাজশাহী থেকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় এনে কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন কক্ষে রাখা হয়।
'নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে' কারাগারের অভ্যন্তরে ১৯৭৬ সালের ২১ জুন তাহেরসহ অন্য ৩২ বন্দির বিচার শুরু হয়।
যা চলে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। এরপর ২১ জুলাই তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মওদুদের মতে, বিচার প্রক্রিয়ায় কঠোর গোপনীয়তা, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, জাসদের প্রথম সারির নেতারা বন্দি থাকায় এ নিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি।
"যে ব্যক্তি তাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করালেন, যাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধত্ব ছিল, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোদ্ধা হিসাবে লড়েছিলেন- সেই তাহেরকে কেন জিয়া ফাঁসিতে ঝোলালেন?"
নিজ বইয়ে এমন প্রশ্ন করে এর উত্তরে মওদুদ লেখেন, "স্বাধীনতা অর্জনের পর কঠিন সময়ে জিয়া সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন।
"মুজিব হত্যাকাণ্ড ও মোশতাকের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা এ সব সেনা সদস্যরাও জিয়াকে সহযোগী হিসাবে পাশে পায়।
দেশের তখনকার সামরিক-বেসামরিক কাঠামোতে টিকে থাকার পারস্পরিক প্রয়োজনে তাদের একে অপরের প্রয়োজন হয়। "
"আর যখন জিয়া তাহেরকে দণ্ড দানের বিষয়ে ৪৬ জন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে সভা ডাকেন, তখন পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। "
বইয়ে লেখা এসব বিষয়ে এখনকার অবস্থান জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "যা লিখেছি, তা তো বইয়েই রয়েছে। "
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলে। এরই এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এমএ তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই সাজা দেওয়া হয়।
এরপর ২১ জুলাই ভোররাতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ওই বিচারের বৈধতা নিয়ে তাহেরের ভাই ও স্ত্রীর রিট আবেদনে গত ২৩ অগাস্ট হাইকোর্ট সামরিক আদালতে তার গোপন বিচারের নথি তলব করে।
সুত্রঃ-বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।