আতাউর রহমান কাবুল আতাউর রহমান কাবুল
ইমেইল :
আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে
ডায়াবেটিস রোগের ওপর এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বে ১৯৮০ সাল থেকে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বের মোট ৩৫ কোটি লোক এই অসুখে ভুগছে। বিশ্বে ডায়াবেটিসের কারণে প্রতি ৮ সেকেন্ডে মারা যাচ্ছে ১ জন। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এখনই এ রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ২০ বছর পর তা দাঁড়াবে প্রায় ৫৫ কোটিতে।
বাংলাদেশের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির মধ্যে আছে বলা হচ্ছে।
ডায়াবেটিস কী?
আমাদের প্রধান খাদ্য উপাদান হলো শর্করা। শর্করা ভেঙে হয় গ্লুকোজ। আবার আমিষ বা চর্বিজাতীয় খাবার ভেঙেও বিশেষ অবস্থায় গ্লুকোজে পরিণত হয়। গ্লুকোজ আমাদের শরীরের প্রধান জ্বালানি।
এসব গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে একটি হরমোন, তার নাম ইনসুলিন। ইনসুলিন আসে অগ্ন্যাশয় থেকে। এটি রক্ত থেকে গ্লুকোজকে কোষে সরিয়ে নেয়। কিন্তু যদি কোনো কারণে অগ্ন্যাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হয় অথবা শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি যথেষ্ট সাড়া না দেয় তাহলে রক্তে গ্লুকোজের এই মাত্রা বাড়তে থাকে। এই অবস্থাকেই আমরা বলি ডায়াবেটিস, যাকে বাংলায় বহুমূত্র রোগও বলা হয়।
ডায়াবেটিসের কারণ ও প্রকারভেদ
প্রধানত দুটি কারণে এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। শরীরে অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) গ্রন্থিতে ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণকারী বিটা সেলের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়া এবং বিটা সেল থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন যদি কোষের ওপর সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিতে বিটা সেলের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় পৌঁছলে তখন ইনসুলিন বাইরে থেকে নেয়া (ইনজেকশনের মাধ্যমে) ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস বলে। অপরদিকে শরীর যখন ইনসুলিন তৈরি করতে পারে, অর্থাত্ সামান্য পরিমাণ বিটা সেল উপস্থিত থাকে কিন্তু শর্করার বিপাকের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়, এ ধরনের ডায়াবেটিসকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বলে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সঙ্গে স্থূলতার একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বাচ্চাদেরও এ রোগ হতে পারে। তবে চল্লিশোর্ধ্বদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি—শতকরা ৭০ ভাগ।
আরেক ধরনের ডায়াবেটিস আছে। একে বলে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
যখন কোনো মায়ের গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখন তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। এ ধরনের ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রোগী পরবর্তী সময়ে স্থায়ীভাবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুরুতে রোগীরা বুঝতেই পারে না যে তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘন ঘন পিপাসা লাগা, দুর্বল লাগা, ঠোঁট ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া এসব লক্ষণ দেখা যায়। কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে আসেন পায়ে, নখে, চামড়ায় বা যৌনাঙ্গে বিভিন্ন রকম ইনফেকশন নিয়ে।
ডায়াবেটিস হলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে কারও কারও, মুড ওঠা-নামা করে। হাত-পা জ্বালাপোড়া করাও ডায়াবেটিসের লক্ষণ। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অথচ উপসর্গহীনতা বা অসচেতনতার কারণে ৫০ শতাংশ রোগীই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে।
কিছু জরুরি পরীক্ষা
ডায়াবেটিস রোগী ছাড়াও যাদের নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন বেশি, ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন করেন না, তারা নিম্নে উল্লিখিত রক্তের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে পারেন।
খালি পেটে বা খাবারের আগে (Fasting Blood Glucose) : এ পরীক্ষাটি সকালে নাস্তার আগে খালি পেটে করতে হয়।
এর স্বাভাবিক মাত্রা ৬.১ মিলিমল/লিটার বা তার কম।
খাবারের দুই ঘণ্টা পরে (2 Hour After Breakfast) : এ পরীক্ষাটি নাস্তা খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে করতে হয়। এর স্বাভাবিক মাত্রা ১০ মিলিমল/লিটার বা তার কম।
যে কোন সময় (Random) : এ পরীক্ষাটি দিনের যে কোনো সময় করা যেতে পারে। এর স্বাভাবিক মাত্রা ৫.৫ থেকে ১১.১ মিলিমল/লিটার।
Oral Glucose Tolerance Test (OGTT) : যাদের খালি পেটে ঋইএ ৬.১ এর বেশি কিন্তু ৭.০ মিলিমল/লিটারের কম কিংবা দিনে যে কোনো সময় ৫.৫-এর বেশি কিন্তু ১১.১ মিলিমল/লিটারের কম, তাদের এ পরীক্ষাটি করা খুবই জরুরি। কারণ এ পরীক্ষাটির মাধ্যমে কারও ডায়াবেটিস আছে কি নেই, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ পরীক্ষাটির জন্য রোগীকে প্রথমে খালি পেটে রক্ত দিতে হবে। এরপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে এবং ঠিক দুই ঘণ্টা পর রোগীকে আবার রক্ত দিতে হবে। এই দুই ঘণ্টা রোগী অন্য কোনো খাবার খেতে পারবেন না।
কোনো ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজও করতে পারবেন না। ধূমপান করা যাবে না। এ পরীক্ষায় যে রোগীর খালি পেটে ৭.০ মিলিমল/লিটারের চেয়ে বেশি এবং দুই ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমল/লিটারের চেয়ে বেশি হবে তাকে নিশ্চিত ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।
গ্লাইকোলাইলেটেড হিমোগ্লোবিন : এ পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে গত ৪ মাসের গ্লুকোজের মাত্রার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এ পরীক্ষাটি খালি পেটে অথবা খাওয়ার পর যে কোনো অবস্থায় করা যায়।
এর স্বাভাবিক মাত্রা ৭% নিচে থাকা বাঞ্ছনীয়।
ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা
ডায়াবেটিসকে তাই বলা হয় সব রোগের মা। ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলোই আসলে এই রোগের মূল সমস্যা। শরীরে এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে ডায়াবেটিস তার ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে না। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিসে সাধারণত যেসব সমস্যা হতে পারে তা হলো—
—- কিডনির অক্ষমতা বা কিডনি বৈকল্য। বিশ্বের অনেক মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির সমস্যায় ভোগে।
—- বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি করে পা কাটা যাচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত কারণে। আবার যত পা কেটে ফেলতে হচ্ছে, এর ৮৫ শতাংশের প্রধান কারণ রোগীদের অসচেতনতা।
—- ডায়াবেটিসে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
চোখে রেটিনোপ্যাথি হয়ে চোখে কম দেখা, ঝাপসা দেখা, চোখের ছানিপড়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। অন্ধত্ব ও দৃষ্টিবিচ্যুতির নানা কারণ ডায়াবেটিস।
—- ডায়াবেটিস হলে হৃদরোগের ঝুঁকি এবং হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা বাড়ে।
—- ডায়াবেটিসে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রকম ইনফেকশন।
আবার পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হলে হাত-পা জ্বালাপোড়া করাসহ বোধশক্তি কমে যায়। শরীরের মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়
সচেতনতা এবং সুশৃঙ্খল জীবনাচরণই ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিত্সা। অনেক দিন ধরে বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস বহুলাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
—- প্রথমেই খাবার-দাবারে নিয়ম মেনে চলতে হবে।
তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। চিনি, মিষ্টিযুক্ত খাবার (সফট ড্রিঙ্ক, চকলেট, কেক, পেস্ট্রি, কুকি ইত্যাদি) কম খেতে হবে। শাক-সবজি এবং আঁশজাতীয় খাবার খেতে হবে।
—- ক্যালরিবহুল খাবার যেমন—তেল-চর্বিযুক্ত খাবার (তেল, ঘি, মাখন, ডালডা, চর্বি, ডিমের কুসুম, মগজ ইত্যাদি) কম খেতে হবে। ফাস্টফুড এড়িয়ে চললে ভালো।
শর্করাবহুল খাবারগুলো (চাল, আটা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি খাবার) কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে। দৈনিক ক্যালরি হিসাব করে খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
—- ফাস্ট-ফুড এবং কোল্ড-ড্রিঙ্কস পরিহার করতে হবে।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করুন। বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করুন।
—- ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক বর্জন করতে হবে। অ্যালকোহল মোটেই নয়।
—- একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম।
তবে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুততায় হাঁটুন। সাইকেল চালান, সাঁতার কাটুন কিংবা সিঁড়ি ভাঙুন। মনে রাখবেন, রক্তের গ্লুকোজগুলোকে পোড়াতে হবে কাজের মাধ্যমেই।
- বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করুন। কারণ সব ব্যায়াম সবার জন্য উপযুক্ত নয়।
ব্যায়াম করছেন এ ধারণা মাথায় রেখে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন না।
— - একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পায়চারি করুন।
—- উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
একই সঙ্গে মেদভুঁড়ি যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
—- বিষণ্নতা ডায়াবেটিস বাড়ায়, তাই মনকে প্রফুল্ল বা মানসিক চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
—- খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন যাই হোক চিকিত্সা নিয়মিত চালাবেন। রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকলে শরীরের সব অঙ্গই ঠিক থাকবে।
- শিশু-কিশোরদের মধ্যে আজকাল টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে।
তাই এরা যেন অপুষ্টিতে না ভোগে আবার অতিপুষ্টিতে ওজন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে শিশুরা যেন শ্রমবিমুখ না হয়, তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
—- গর্ভকালীন মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে যেন গর্ভস্থ শিশু অপুষ্টিতে না ভোগে।
—একান্তই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শমত চিকিত্সা গ্রহণ করুন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন সংক্রান্ত তার সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা (যা শুধু আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
কারও ডায়াবেটিস রোগ হলে সে যদি নিয়ম মেনে চলে তবে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও সে ভালো থাকবে। ডায়াবেটিসে কেউ মারা যায় না যতক্ষণ না অন্য সমস্যাগুলো জটিল আকার ধারণ করে। ডায়াবেটিস নিরাময়যোগ্য নয় তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়ম মানলে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পরিমিত খাদ্য, নিয়মিত ওষুধ ও সুশৃঙ্খল জীবন—এই তিনটি নীতি ডায়াবেটিসের রোগীরা সঠিকভাবে পালন করলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন।
লেখক : বিভাগীয় সম্পাদক, আমার স্বাস্থ্য
দৈনিক আমার দেশ
সূত্র : Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।