ধূর..ভাল্লাগেনা। পিটারের সাথে আমার পরিচয় আমাদের ইউনিভার্সিটর আয়োজিত একটি সিম্পোজিয়ামে। ভদ্রলোক পেশায় লণ্ডনের সেন্টজর্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর। অডিয়েন্সের একমাত্র বাদামী চামড়া বলেই কি না প্রেজেন্টেশনের সময় বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমিও মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছিলাম তার কথা সেটা শুধু তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছিলেন সেজন্য না, বরং তার বক্তব্যে আমার উৎসাহের মাত্রা ছিল তীব্র।
আমাদের সবার প্রেজেন্টেশন যেখানে ছিলো অতিমাত্রায় আংকিক জার্গন, একমাত্র পিটারই যেন হাজির হয়েছিলেন একমাত্র গল্পকার হিসেবে। তার পুরো গল্পটি আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমাদের শিশুদের। অনেকদিন ভেবেছি ব্লগে শেয়ার করবো, কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। আর তাছাড়া ব্লগের নির্বাচিত পাতায় স্থান পাওয়া না পাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনের প্রবল ক্ষমতাধর-নিষ্ক্রিয়-অচিন্তাশীল-অদৃশ্য ব্যক্তিটির ওপর আমার আস্থা ভয়াবহ রকমের তলানীর দিকে। সামুতে না লিখার পেছনে এটিও একটি কারন।
সমস্যা হচ্ছে আমার আর কোন সামু নাই । যাই হোক পিটারের গল্পে আসি।
পিটার আর তার রিসার্চ টীম চেজ ষ্টাডি নামের একটি গবেষণা করছেন। গবেষণার মূল বিষয় ব্রিটেনে অবস্থানরত সাদা (হোয়াইট ইউরোপিয়ান), কালো (আফ্রিকান+ক্যারেবিয়ান) এবং দক্ষিণ এশিয়ান (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ৯-১০ বছর বয়সী শিশুদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি কতটুকু এবং ভিন্ন বংশদ্ভূত হবার কারনে সে ঝুঁকি কতটুকু বাড়ে বা কমে তা পরিমাপ করা। স্যাম্পল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লণ্ডন, বার্মিংহাম ও লিষ্টারশায়ারের ১০০ স্কুল ও তার প্রায় ৫০০০ ছাত্র ছাত্রী।
দৈবচয়নের পুরো প্রক্রিয়াটিই পাওয়া যাবে তাদের লিংকে। তাই সেসব ব্যখ্যায় যাচ্ছিনা।
এখানে বলে রাখা ভালো পেশাগত কারনে আমাকে লণ্ডন ও বার্মিংহামে থাকতে হয়েছে, ওখানকার বাঙ্গালী, ভারতীয়, পাকিস্তানী কমিউনিটি আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ভারতীয়-পাকিস্তানী-বাংলাদেশীদের জীবন-যাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভাস প্রায় একই রকম। আর বাংলাদেশে শিশুরা যা খায়, লণ্ডনের মাছ-বাজার আর বার্মিংহামের সোনালী সুপার মাকের্টের বদৌলতে ইউকেতে বসবাসকারী বাঙ্গালী শিশুরাও তাই খায় ।
আর কেএফসি, পিজাহাট এইসব জাঙ্ক ফুডেরতো সবখানেই একই রূপ। তাই এই গবেষণার ফলাফল শুধু ইউকের বাংলাদেশী শিশুরা নয়, বাংলাদেশের শিশুদের জন্যও সমান ভাবে প্রোযোজ্য। আফসোস বাংলাদেশে এরকম স্টাডি হয়না, হলে হয়তো আরো ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাবে, আমার অনুমান। লাঞ্চ বিরতিতে পিটারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো, তখনই ওকে বলেছিলাম প্রেজেণ্টেশনটা আমাকে পাঠিয়ে দিতে। নিপাট ভদ্রলোক পিটার দেরী করেনি।
প্লিমাউথ থেকে লণ্ডন ফিরে গিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছে পুরো প্রেজেন্টেশনটি। সেই প্রেজেন্টেশনের কিছু বাছাইকৃত অংশ দেখি আসুন। এক ঘণ্টার ওপরের প্রেজেন্টেশনটিকে প্রাসঙ্গিক করার জন্য চেজ ষ্টাডি ছাড়াও ওদের অন্যান্য ষ্টাডির ফলাফলেরও কয়েকটি স্লাইড ছিলো। আমি চুম্বকাংশ শেয়ার করছি। সাথে স্লাইড গুলোকে কিছুটা সরলীকরণ করার চেষ্টা করেছি সবার কাছে বোধগম্য করার উদ্দেশ্যে।
আগে ছোট্ট করে দেখে নেই টাইপ-২ ডায়াবেটসি কি? (টাইপ ওয়ান নিয়ে আমরা এখন কথা বলবোনা)।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস: ইনসুলিন শরীরের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। প্যাণক্রিজ বা অগ্নাশয়ের বেটা সেল/বেটা কোষ থেকে নি:সৃত এই হরমোন পরিপাকতন্ত্র প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। খাবার পর আপনার শরীরে যখন গ্লুকোজ/শকর্রা এর পরিমান বেড়ে যায় অগ্নাশয় তখন ইনসুলিন নি:স্বরণ করে, আর ইনস্যুলিন সাহায্য করে শকর্রাটাকে এনার্জী হিসেবে লিভার এবং ফ্যাট সেলে জমিয়ে রাখতে। দীর্ঘক্ষণ রোযা রাখার পরও আমরা যে চলা ফেরা করতে পারি তা এই জমে থাকা এনার্জীর কারনে।
শরীরে যখন শকর্রা বেশী হয়ে যায়, বেটাসেলও পাল্লা দিয়ে বেশী পরিমানে ইনসুলিন নি:স্বরন করে। কিন্তু এদিকে লীভার ও ফ্যাট সেলগুলো বেশী পরিমানে শকর্রা স্টোর করে ভর্তি হয়ে যাবার কারনে শর্করাগুলোর আর যাবার জায়গা থাকেনা। ফলে আপনার শরীরের রক্তে ভেসে বেড়ায় শকর্রা ও ইনসুলিন। এই কণ্ডিশনকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আর এটাই টাইপ টু ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস নিজে যতনা অসুখ তার চেয়ে একে বলা ভালো এটি অনেক রোগের পূর্ববর্তী একটি শারিরীক কণ্ডিশন।
রক্তে উচ্চ হারের গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের উপস্থিতিতে রক্তের নালী গুলো সংকীর্ণ হয়ে যায়, যার ফলে উচ্চ রক্ত চাপ, হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক ওবেসিটি সহ নানান জটিল উপসর্গ দেখা দেয়।
চিত্র-১
করোনারী হার্ট ডিজিজ এবং ষ্ট্রোক: উপরেই বলেছি এ-দুটো রোগের পেছনের কারিগর হলো ইনসুলিন রেজিষ্ট্যান্স। চিত্র-১ এ দেখা যাচ্ছে সাউথ এশিয়ানদের করোনারী হার্ট ডিজিজ এবং ষ্ট্রোক উভয়ই সাদাদের/ইউরোপীয়ানদের থেকে অনেক বেশী (ষ্ট্যাণ্ডার্ডাইজড মর্টালিটি রেশিও)।
চিত্র-২
টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর হার: চিত্র-২ এ দেখা যাচ্ছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হার প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং মহিলা সাউথ এশিয়ানদের মাঝে অনেক বেশী।
চিত্র-৩
আর চিত্র-৩ এ দেখা যাচ্ছে, ১৬ বছর বয়সের নীচের দেশী শিশু সন্তানদের মাঝে ডায়াবেটিস হবার হার সাদাদের থেকে প্রায় ১৪ টাইমস (দুই রেট এর রেশিও) বেশী।
চিত্র-৪
খাদ্যদ্রব্যে ফ্যাট এর পরিমান: এখন আমরা যা দেখব তার সব কিছুই চেজ ষ্টাডির ফলাফল। অর্থ্যাৎ যা কিছু দেখছি সব ৯-১০ বছর বয়সী শিশুদের উপর অবজার্ভেশন। আপনার সন্তান কি পরিমান ফ্যাট খাবারের সাথে গ্রহণ করছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য। অতি মাত্রায় ফ্যাট=অতি মাত্রায় কোলেষ্টেরল। উপরের চিত্র-৪ এ দেখা যাচ্ছে আমাদের সন্তানদের ফ্যাট গ্রহনের মাত্রা ইউরোপীয়ান, আফ্রিকান এমনকি ক্যারেবিয়ান শিশুদের থেকে অনেক বেশী (লাল বৃত্ত)।
(পিজা/কেএফসি, খাওয়ান বেশী কইরা)। মজার ব্যাপার এখানে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকান ছেলেমেয়েদের ফ্যাট ইনটেক অনেক কম যা আমার ধারণার উল্টো।
চিত্র-৫
ফ্যাট ম্যাস এবং স্কীন ফোল্ড: শরীরে ফ্যাট জমলে ফ্যাট সেল গুলো ভর্তি হয়ে যায় ফ্যাট স্টোর করতে করতে। একপর্যায়ে ফ্যাট গুলোর আর যাবার জায়গা থাকেনা, তারা যেখানে সেখানে জমা হয়। তর প্রভাব পরে চামড়ার নীচেও।
তাই দেখবেন মোটা হওয়া শুর করলে বাহুর চামড়া, কোমড়ের চামড়া এগুলো সবার আগে পুরু হতে শুরু করে। শরীরের পাঁচ জায়গার চামড়ার পূরুত্ব পরিমাপ করা হয় স্কীনফোল্ড মাপার জন্য। যার শরীরে চর্বি বেশী তার স্কীনফোল্ড এর পুরুত্ত তত বেশী। আর ডেক্সা নামের একটা মেশিন আছে, যা আপনার শরীরের চর্বি ছাড়া মাংস (লীন ম্যাস), হাড় (বোন) আর চর্বির (ফ্যাট ম্যাস) একটা প্রপোরশন হিসেব করে দেবে। চিত্র-৫ এ দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশী সন্তানদের স্কীনফোল্ড আর ফ্যাট ম্যাস দুটোই যথারীতি ইউরোপীয়ানদের থেকে অনেক বেশী।
চিত্র-৬
এইচবিএওয়ানসি: আগেই বলেছি অতি মাত্রায় গ্লুকোজ শরীরে থাকলে তার আর যাবার জায়গা থাকেনা। তাই তারা রক্তের সাথে মিশে থাকে। এখন রক্তে যে হিমোগ্লোবিন আছে, তার সাথে গ্লুকোজ মিশে হয় গ্লাইকোস্লেটেড হিমোগ্লোবিন। এটাই এইচবিএওয়ানসি। এটা ডায়াবেটিস পরিমাপ করার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া।
রক্তে এর আধিক্যে আমরা বুঝতে পারি যে শরীরে মহাসয় ঝুঁকিতে আছেন। চিত্র-৬ এ দেখা যাচ্ছে আমাদের সন্তানেরা বরাবরের মতোই মাশাল্লা আগায়া আছে সবার থিকা।
চিত্র-৭
পোষ্ট অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করবো। রক্তে কোলেষ্টেরল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এর মধ্যে এলডিএলটা (লোডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) খারাপ, ওটার ছবি দিলামনা, কিন্তু ওটার পরিমানও আমাদের সন্তানদের বেশী। চিত্র-৭ এ দেখা যাচ্ছে আমাদের সন্তানের রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড, যা হাই ব্লাড প্রেসার পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি, তা অনেক বেশী, আর যে কোলেষ্টেরলটা ভালো, এইচডিএল (হাইডেনসিটি লিপোপ্রোটিন), তার পরিমান সবার থেকে কম। বাঙালী উল্টা পথে হাঁটে।
চিত্র-৮
ইনসুলিন: এইবার দেখি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটা। ইনসুলিন।
এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা। আপনারাই বুঝে নিন আমাদের সন্তানদের অবস্থানটা কোথায় (লাল বৃত্ত)? (চিত্র-৮)
চিত্র-৯
ফিজিক্যাল এক্টিভিটি: এ্যাক্টিগ্রাফ নামের একটি ছোট্ট যন্ত্র আছে যা কোমরে বেল্টের মতো করে পড়িয়ে রাখলে সে বিভিন্ন স্কেলে আপনার মুভমেন্ট পরিমাপ করবে। সেভাবেই মাপা হয়েছিলো এই শিশুদের শারিরিক এক্টিভিটি। আমাদের ছেলেরা ও মেয়েরা উভয়েই এই ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে (চিত্র-৯)। লাঞ্চের সময় পিটার আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে, আমরা বাঙলাদেশীরা সন্তানদের স্কুলের দূরুত্ব সামান্য হলেও কেন হেঁটে না গিয়ে তাদের গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি? আমার মুখে যে উত্তরটা রেডী ছিলো সেটা আমি ওকে দিতে পারিনাই।
ওদের আরেকটা স্টাডি দেখতে পারেন, যেখানে দেখাচ্ছে, ব্রিটশরা যেখানে স্কুলে যাচ্ছে পায়ে হেঁটে, ক্যারিবীয়রা বাসে আর আমাদের সন্তানেরা গাড়িতে ।
চিত্র-১০
বাংলাদেশ: শেষ করবো দুটি স্লাইড দিয়ে। এতক্ষন দেখলাম শুধুই সাউথ এশিয়ান। এবার দেখি এই ত্রিরত্নের আভ্যন্তরীন অবস্থা। চিত্র-১০ এ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশী পুরুষ ও মহিলা উভয়েই টাইপ-টু ডায়াবেটিসের হার ভারত /পাকিস্তান এর থেকে বেশী।
বাংলেদেশী পুরুষদের আক্রান্ত হবার হার আবার মহিলাদের থেকে বেশী।
আর ইনসুলিন এর গুরুত্ব বুঝেই ১১ নং চিত্রে দেখুন আমাদের বাংলাদেশীদের সন্তানদের ইনসুলিন লেভেল কত বেশী।
চিত্র-১১
সবশেষে, পিটার ও তার টীমের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিত্র-১২।
চিত্র-১২
আশাকরি সবাই বুঝতে পারছেন আমরা আমাদের সন্তানদের কোথায় ঠেলে দিচ্ছি। কয়েকটি ছোট সহজ উপদেশ:
- সন্তানদরে জাঙ্ক ফুড দেয়া বন্ধ করুন।
অল দে গেট দেয়ার ইজ শীট।
-সন্তানের বিএমআই (বডি-ম্যাস-ইনডেক্স) মাপুন। খুব সহজ (ওজন কেজিতে/উচ্চতা মিটারে)। বিএমআই যদি ২৫ এর উপরে যায় আপনার চিন্তিত হবার কারন আছে।
-কোমড়ের বেড় মাপুন।
নাভীর বরাবর রাউণ্ড করে টেপ ধরে দেখুন কোমড় কত সেণ্টিমিটার। এরপর হিপ (পাছা) এর মাঝ বরাবর বেড় মাপুন। দেখুন কত সেণ্টিমিটার। কোমড়ের মাপকে হিপের মাপ দিয়ে ভাগ দিন (কোমড়/হিপ)। যদি ফল ১ এর উপরে হয়, পোলার/মেয়রে খাওয়া কমায় দেন।
- অতি মাত্রায় ফেসবুক তথা কম্পিউটার, গেমস আর টিভি ওদের ফার্মের মুর্গী বানিয়ে ফেলছে। রক্ষা করুন ওদের। আমাদের ভবষ্যিৎদের। আমরা একটা পঙ্গু ভবষ্যিৎ চাইনা।
সবাইকে নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।