জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে আবারও ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। ১৪ দল ও তার সমর্থকরা জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। আদালতের রায়ের ফলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সরকারের পক্ষে এখন সহজ হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সরকারও বলছে, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। ফলে চতুর্থবারের মতো নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো বলছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় অনেকের প্রশ্ন- জামায়াত কি নিষিদ্ধ হচ্ছে?
বিশ্লেষকদের মতে, নিবন্ধন বাতিলের পরও জামায়াত তাদের দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে। তবে আদালতের রায়ের ফলে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। এ পরিস্থিতিতে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে প্রথম ধাপ।
এখন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বসে থাকবে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, রাজনীতি কলুষমুক্ত করতে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি। জামায়াত নিষিদ্ধ হলে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যাদের বয়স পঞ্চাশের নিচে তারা যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্ত হবেন। তবে দেশে নৈরাজ্য বা ধ্বংসাত্দক কর্মকাণ্ড চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং শান্তি রক্ষায় যা প্রয়োজন তা-ই করা হবে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেন। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন তরীকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। নিবন্ধন বাতিল হলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সরকার জামায়াত নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন বিশিষ্টজনেরা।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন গতকাল বলেন, সংবিধান ও রায়ের আলোকে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। আর এ দায়িত্ব সরকারের। তবে যারা রাজনীতি করে তাদের অনেক সমীকরণ থাকে। যদিও আমরা দাবি করছি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। তবে আমার মনে হয় সরকারের ইচ্ছা থাকলেও সাহস পাবে না নিষিদ্ধ করার।
জামায়াত নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব একা আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো ঠিক নয়। বিএনপি বলছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যাবে না। তাহলে বিএনপি কি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে অপরাজনীতি করতে চায়। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, নিবন্ধন বাতিলের পরও জামায়াত তাদের দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে। তবে এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হলো, জামায়াতকে নিষিদ্ধের যে দাবি জানিয়ে আসছিলাম তা ভিত্তিহীন নয়।
এখন দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। নিবন্ধন বাতিলের অর্থ দল নিষিদ্ধ নয়। আমাদের মূল দাবি হচ্ছে দল হিসেবে জামায়াতেকে নিষিদ্ধ করা। কারণ, এরা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেছেন, রায়ে নৈতিক বিজয় হয়েছে।
জামায়াতের কার্যক্রম নিষিদ্ধের ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক কোনো সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা ও সমাধান করা উচিত। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আমরা আপিল করেছি।
ফলে বিষয়টি এখন বিচারাধীন। আমি মনে করি, আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারব। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের সঙ্গে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সম্পর্ক নেই। তবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের ব্যাপার। প্রয়োজনে আবারও আদালতে যাব।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এ রায় দিয়ে হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন। ইসি জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি যে নিবন্ধন দিয়েছিল, এ রায়ের মধ্য দিয়ে ইসির অক্ষমতাই প্রকাশ পেয়েছে।
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠার সময় জামায়াতে ইসলামীর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। আর ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।
এর আগে ১৯৫৯ সালে প্রথম নিষিদ্ধ হয় জামায়াত ইসলামী। ১৯৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াতকে আবারও নিষিদ্ধ করে আইয়ুব খানের সরকার। '৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে জামায়াত। ধর্মকে ব্যবহার করে সংগঠনটি। '৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ইসলামী দল গঠন ও ইসলামী আন্দোলনের নামে অপতৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়।
তৃতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন (পিপিআর)-এর আওতায় রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। '৭৯ সালের ২৫ মে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে আবারও প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। তবে নিবন্ধনের আগে নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের দুই এমপির কী হবে : এদিকে, নিবন্ধন বাতিল হলেও দলটির নবম সংসদের দুই সদস্যের সদস্যপদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ যাবে না বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।
কারণ রায় হয়েছে দলটির নিবন্ধনের ওপর। ২০০৮ সালে দলের নিবন্ধন যখন আইনসঙ্গত ছিল, তখন তারা এমপি হয়েছেন। সুতরাং সদস্যপদ অটোমেটিক্যালি যাবে না, যদি না কোনো আইনসঙ্গত সংস্থা তাদের অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। দুই সদস্যের সংসদ সদস্যপদ অবৈধ কি না, তা নিয়েও কেউ আদালতে যাননি বলে উল্লেখ করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, সবকিছুই নির্ভর করছে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ওপর।
বাংলাদেশে 'হস্তক্ষেপ' চায় পাকিস্তান জামায়াত : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল এবং দলটির নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' আখ্যায়িত করে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান জামায়াত।
পাকিস্তান জামায়াতের আমির সৈয়দ মুনাওয়ার হাসান বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আক্রান্ত হচ্ছে। নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে এবং তাদেরকে যাবজ্জীবন সাজা, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
সৈয়দ মুনাওয়ারকে উদ্ধৃত করে পাকিস্তানের দি নিউজ লিখেছে, আদালতের এই রায়কে 'অসাংবিধানিক, আংশিক ও পক্ষপাতদুষ্ট' আখ্যায়িত করে বাংলাদেশের জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে 'ভারতপন্থি হাসিনা ওয়াজেদ সরকারের' প্রতিহিংসা রোধে বিশ্বের সব দেশ, গণতান্ত্রিক শক্তি ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে ভূমিকা রাখার আবেদন জানিয়েছেন পাকিস্তান জামায়াতের আমির। সূত্র বিডিনিউজ।
এক রিট আবেদনের রায়ে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে।
এই রায়ের ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছেন এবং একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দলটিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং এর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া ঢাকা হাইকোর্টের রায় গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারকে হত্যার শামিল।
অবিলম্বে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তরিকত ফেডারেশনের : সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন।
গতকাল সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিভিন্ন পেশার শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আয়োজিত ইফতার ও আলোচনা সভায় তরিকত ফেডারেশেননের মহাসচিব এম এ আওয়াল এ দাবি জানান। এম এ আওয়াল বলেন, তরিকত ফেডারেশন জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল করার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল। যতক্ষণ পর্যন্ত জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না হবে ততদিন আইনি এবং রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাব।
তিনি বলেন, জামায়াত বাংলাদেশের সংবিধানকে মানেও না ও বিশ্বাস করে না। দলটির রাজনীতি সরকার নিষিদ্ধ না করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।