আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রজন্মের সৃজনশীল বিবর্তনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব

প্রজন্মের সৃজনশীল বিবর্তনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ফকির ইলিয়াস ============================== একটি রাষ্ট্রের শাসকগোষ্টী যা বলেন, তা ই যে রাষ্ট্রের আশা আকাঙ্খার নিয়ামক হবে তেমন কোনো কথা নেই। যারা ভোট পেয়ে জনপ্রতিনিধি হন, তারা মানুষের কল্যাণ চাইবেন এটাই নিয়ম। সে নিয়ম তৃতীয় বিশ্বে কী মানা হয় ? না, হয় না। হয়না বলেই গণতন্ত্র বিপন্ন হয়। হতে বাধ্য হয়।

জাতীয় সংসদ চালু থাকে সকলের অংশগ্রহনে। বাংলাদেশে বার বারই তা ব্যাহত হয়। অথচ সবাই বলেন, সংসদই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। গণতান্ত্রিক সভ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে ঐক্য। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে কোন জাতিই মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না।

প্রশ্ন এটাও আছে, ঐক্য হবে কার সাথে? কোনো খুনীচক্রের সাথে ? তাদের দোসরদের সাথে ? কোন দেশে দুর্নীতি দমনের জন্য যদি একটি বিশেষ দফতর থাকে আর সে দফতর পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তবে সাধারণ মানুষের আর কোন আশ্রয় থাকে না। দুর্নীতি দমনের নামে যদি প্রতিপক্ষকে পীড়নই মূল লক্ষ্য হয় তবে তা নিয়ে আর কি-ই বলার থাকতে পারে। গণতন্ত্র শুধুই মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে না, রাজনীতিরও একটি পরিশুদ্ধ সিঁড়ি নির্মাণ করে। আর সেই সিঁড়িটি হচ্ছে পারস্পরিক সম্মানবোধ। মার্কিন মুল্লুকে ডেমোক্রেট কিংবা রিপাবলিকান দলের সিনেটর কিংবা কংগ্রেসম্যানরা যে একে অন্যের সমালোচনা করেন না, তা নয়।

তারাও হাউজে বসে একে অন্যের নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনে তারা সবাই এক এবং অভিন্ন। তখন তাদের শ্লোগান হয়ে পড়ে ‘উই আর আমেরিকানস’। কিন্তু এই যে আমরা সবাই আমেরিকানস, তারপরও কোন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকের পক্ষে কেউই দাঁড়ান না। কিংবা দাঁড়াতে চান না।

কারণ যে জন রাষ্ট্রের সম্পদ চুরি করেছে, সে তো রাষ্ট্রের শত্রু। কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাদের পক্ষ নেবেন কেন? একটি কথা আমরা সবাই জানি, দুর্নীতিবাজরাও এক ধরনের কট্টরপন্থি। কারণ তারা অবৈধভাবে নিজেদের মুনাফা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। মনে রাখা দরকার, যারা ধর্মের নামে কট্টরপন্থি নীতি অনুসরণ করে, তাদের পরোক্ষ মদত দেয় রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজরা। কারণ ধর্মের নামে কট্টরতাবাদ কায়েমকারীরা তখন মানুষকে বলে, ‘দেখ দুর্নীতিবাজরা কীভাবে রাজনীতিকে কলুষিত করে তোলেছে।

এস আমরা তোমাদের শান্তির পরশ দেব। ’ ভারতে কট্টরপন্থি বিজেপির রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের ঘটনাটি ছিল ক’বছর আগে তেমনি একটি সংকেত। কট্টরবাদিতার অন্যতম মিত্র হচ্ছে একনায়করা। যারা মোটেই গণতন্ত্র অনুসরণ করে ক্ষমতায় আসার তোয়াক্কা করে না। তবে তারা ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে পরে ‘নামকাওয়াস্তে’ (হাঁ-না এর মতো) ভোট অনুষ্ঠান করে ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে নেয়।

মানুষ আস্থা রেখেছে কি-না, তার তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতা এরা কেবলই দীর্ঘায়িত করে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক, জে. পারভেজ মোশাররফের শাসন আমাদের সেই সত্য জানান দিয়ে যায়। বিষয়টি কারোরই অজানা থাকার কথা নয়, বুর্জোয়া শক্তি এবং সামন্তবাদী নেতৃত্ব বিশ্বে সবসময়ই শীতল যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার সবসময়ই অত্যন্ত পছন্দ করে। ইউনাইটেড স্টেটস অফ সোভিয়েত রাশিয়া (ইউএসএসআর) সেই শীতল যুদ্ধে অনেকটা শক্তি সঞ্চয় করে আরেকটি পরাশক্তি ইউএসএ'র সফল প্রতিপক্ষ হতে চেয়েছিল। আর চেয়েছিল বলেই ‘ইউএসএসআর’ ভেঙে দেয়ার জন্য অপর পরাশক্তিটি ছিল অত্যন্ত তৎপর।

তারা সফলও হয়েছে বেশ দ্রুতই। বর্তমান সময়ে ভেনিজুয়েলার একজন হুগো শ্যাভেজ কিংবা কিউবার একজন ফিদেল অথবা রাউল ক্যাস্ট্রো তাই কোন মতেই বৃহৎ পরাশক্তির কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং এদের ব্যবহার করা হচ্ছে মাঝে মধ্যে ক্রীড়নক হিসেবেই। গণতান্ত্রিক সভ্যতার শীর্ষ ধ্বজাধারীরা বিশ্বকে বলছে, দেখ আমরা বিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলেও ক্ষুদ্র সমাজবাদী দেশগুলো আমাদের সমর্থন দিচ্ছে না। প্রকারান্তরে তারা বুঝতে চাইছে সমাজতন্ত্রী ক্ষুদ্র কিছু রাষ্ট্র মৌলবাদ, কট্টরবাদেরই দোসর।

অথচ ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে এই, সোভিয়েত সৈন্য তাড়াবার নামে আফগানি তালেবানদের হাতে ভারী অস্ত্র তুলে দিয়েছিল আজকের ‘বিশ্ব সন্ত্রাস’ দমনকারীরা। তারাই নিজেদের প্রয়োজনে ভাড়া খাটিয়েছিল কিছু কট্টরবাদী নেতাকে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, এরা কী সৌদি, কুয়েত, কাতার, ওমান, দুবাইয়ের কট্টরবাদী শাসককুলকে এখনো পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে না? হ্যাঁ, আমি তাদেরই কট্টরবাদী বলি, যারা জনগণের ভোট, মতের পরোয়া না করে বংশ পরম্পরায় রাষ্ট্র শাসন করে। অনুকূল সম্পর্ক না থাকায় লিবিয়ার শাসক কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি, কিংবা ইরাকের সাদ্ডাম হোসেন কে চিরতরে সরাতে তারা তৎপর হলেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রবাদীদের এরা শীর্ষ মিত্র বলেই বিবেচনা করছে। শঙ্কার কথা বিশ্বে যুদ্ধ, রক্তপাতের মিত্রসংখ্যা একেবারে কম নয়।

আমরা মারাত্মকভাবে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারি না, যখন দেখি মার্কিন মুল্লুকের কোনো কোনো ধনবাদী কোম্পানী অস্ত্র বিক্রীর মহড়ার জন্য রাজনীতিকদের ভোট ফান্ডে মোটা অংকের ডোনেশন দিচ্ছে। রক্তের বিনিময়ে তেল চাই, এমন মানসিকতা যারা পোষণ করে তারাই বিশ্বে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা। অথচ ‘জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার এবং জনগণই সরকার’- এটাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হওয়ার কথা ছিল। গণতন্ত্রের আলো বিতরণকারীদের চারপাশে এখন ধনতন্ত্র এবং লুটেরা শ্রেণীর বাহকদের ছড়াছড়ি। যারা বড় ডোনেটর তারাই বড় অস্ত্র কারখানার মালিক।

তেল কোম্পানিগুলোর তেল ব্যবসার ওপর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের একটা বদনজর সব সময়ই থাকে। কারণ তারা মনে করে একটি মিসাইল ফুটলেই সেই মরুসুড়ঙ্গ দিয়ে তেলের নহর বের হয়। আর প্রাণহানি তা তো মামুলি বিষয়। এটা খুবই পরিতাপের কথা, পশ্চিমা বুর্জোয়াগোষ্ঠীর কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক শাসকই ভালো দিকগুলো শিখছে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কিংবা উপমহাদেশের অবস্থা আরও করুণ।

কিছুসংখ্যক ‘প্রিয়ভাজন’ ব্যবসায়ী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হবে, এ সুযোগটা রাজনীতিকরাই তৈরি করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে কিছু লুটেরা ব্যবসায়ীর মুখোশ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিকে ঘিরে যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তা সেই ঘটনাগুলোরই ধারাবাহিকতা মাত্র। এটা খুব নিশ্চিত করে বলা যায়, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ধারে কাছে যাদের অবস্থান তাদের হাতের রশি ধরে কিছু বিরোধী শিবিরের লুটেরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। এদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। এ মহড়াটি মূলত আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার।

আর তা করতে গিয়ে ‘কত প্রাণ হবে বলিদান’ সে হিসাব কেউই রাখবে না। তাই তেলের জন্য যারা রক্তপাত ঘটাচ্ছে কিংবা শেয়ারবাজার লুট করতে যারা সহায়তা করছে, এরা মূলত একই শ্রেণী। পার্থক্য এই, কারও শক্তি বেশি, কারও শক্তি কম। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে চাই। নবনিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা ঢাকা পৌঁছেছেন।

২৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবেন বলে জানা যাচ্ছে। ঢাকা পৌঁছে এই কার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেছেন,গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সম্প্রতি যা হয়েছে তাতে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছেন, দশ বছর আগে যখন আমি এখানে ছিলাম, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করা নারীরা অনেক বিষয়েই আমাকে উজ্জীবিত করেছিল। আমি বিশ্বাস করি, এদেশের সরকার, সুশীল সমাজ ও গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, গ্রামীণ ব্যাংককে কার্যকরভাবে চলতে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, একটি শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে আমি কাজ করব।

১০ বছর পর এদেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসতে পেরে আমার একটি স্বপ্ন পূরণ হল। কৌশলগতকারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে বলেও মন্তব্য করেন মজিনা। তিনি বলেন, দশ বছর পর আবার বাংলাদেশে ফিরতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের ও সৌভাগ্যের। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন সহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করার আশ্বাস ও দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

আমরা জানি, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের প্রজন্মও সৃজনশীল বিবর্তন চাইছে। মুক্তিদিশা চাইছে। কিন্তু বুর্জোয়াবাদীরা একটা শিকল পরিয়েই এই মুক্তি দেবার মহড়া দেখাচ্ছে সর্বত্র। তাই প্রশ্ন আসবেই, এর থেকে মুক্তির পথ কী? এই কূটনৈতিক নিষ্পেষণ কীভাবে বন্ধ করা যাবে? এর উত্তরটি খুবই সোজা। মানুষকে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে।

প্রজন্মকে সত্যের পক্ষে কথা বলতে শিখতে হবে। মনে রাখা দরকার, সামন্তবাদ সবসময়ই ‘প্রভু এবং দাস’ প্রথায় বিশ্বাস করে। এ প্রথার আগল ভাঙতে না পারলে মানুষের সত্যিকার উন্নয়ন মুক্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশে অবৈধ টাকার মালিকরা টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নেয়ার যে আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে তা সমাজের জন্য চরম বিষফোঁড়া তো বটেই। খুবই শংকার কথা, এই কালো টাকার মালিকরাই দু কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনকে খুন করিয়েছে।

যে সংবাদ গেল কদিন ধরেই আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখছি। ক্ষমতবানরা যদি রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় অবৈধভাবে পায়, তখন আর সাধারণ মানুষের দাঁড়াবার পথ থাকে না। অকোপাই ওয়াল ষ্ট্রীট কিংবা অকোপাই শাপলা চত্বর এর মত কথাবার্তা - মানুষের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। রাষ্ট্রকে দাঁড়াতেই হয় সকল অসত্যের বিরুদ্ধে। রাষ্টশাসকরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে রাষ্ট্র ক্রমশঃই খোঁড়া হয়ে যায়।

আর তখনই সংঘবদ্ধ জঙ্গীবাদীর মত অপশক্তি রাষ্ট্রে হাত চালাবার সাহস পেতে থাকে। নিউইয়র্ক / ২০ নভেম্বর ২০১১ ======================================== দৈনিক যুগান্তর/ ঢাকা । ২২ নভেম্বর ২০১১ মঙ্গলবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.