একটা নতুন প্রজন্ম তো এসেই গেছে, যাদের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর এবং যাদের সন্তানরাও বড় হচ্ছে একটু একটু করে। একটি একটি বছর যাবে কেটে, নতুন মানুষের আগমনে ঋদ্ধ হবে দেশ। তারপর এমনও একটা সময় আসবে, যখন দেশ স্বাধীন করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের কীর্তিই থাকবে কেবল, তাঁরা আর জীবিত থাকবেন না। তখন শুধু ইতিহাসের আলোয়ই দেখতে হবে সেই অসাধারণ অর্জনটিকে।
বলাই যায়, এটা এমন একসময়, যখন আমরা জীবিত বীরযোদ্ধাদের সঙ্গ পাচ্ছি।
মুগ্ধদৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে ভাবতে পারছি—এঁরাই তো আমাদের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এনে দিয়েছেন! তাঁদের মাধ্যমেই আমরা ছুঁতে পারছি মুক্তিযুদ্ধকে।
সময় আর শায়ানের মা সুমনা। মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম। সময়ের বয়স দশ। সুমনা নির্দ্বিধায় বললেন, মায়ের কাছ থেকেই তো শিশুরা পায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পাঠ।
কাদের মোল্লার রায়ের পর আমার ছেলে যখন জিজ্ঞেস করল, রাজাকার কী, মা? তখন সেই উত্তর দিতে গিয়ে ছেলের জন্য গর্ববোধ করেছি। এখন তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছোটদের জন্য বইও পাওয়া যায়। সেগুলোও বাচ্চারা পড়ে। তা ছাড়া বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের বিভিন্ন উৎ সবে সন্তানদের নিয়ে গেলে ওরা এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে শেখে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে তাঁদের সংগ্রামের ইতিহাস শোনা যায়।
এ সুযোগ তো এখনো আছে, তা কাজে লাগানো খুব দরকার।
ফেরদৌসী আবেদীনের ছেলে ঋভু’র বয়সও দশ। ঋভু যে স্কুলে পড়ে, সেখানে আলাদা করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা হয়। ছেলেটা সে গল্প শুনে বাড়ি এসে মা-বাবার সঙ্গে তা নিয়ে আলাপ করে। মা-বাবা সে গল্পের সঙ্গে নিজেদের জানা গল্প যোগ করেন।
ফেরদৌসী বললেন, অনেক দোকানেই বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে লেখা ছোটদের বই পাওয়া যায়। সেগুলো পড়লে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহ জাগে বাচ্চাদের। বাড়িতে গান শোনার সময় মুক্তিযুদ্ধের গান বাজানোর সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গল্পও বলে ফেলা যায়। গল্পের মতো করে সত্য বলা হলে, তা শিশুরা সহজে বুঝে নিতে পারে।
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর কাছে জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া মা-বাবা কী করে শিশুকে শোনাবেন মুক্তিযুদ্ধের কথা।
তিনি বললেন, বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা ও শোনার আবহ তৈরি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের কারণেই যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে শিশুদের। আমি এমন অনেক তরুণ-তরুণীকে চিনি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যাদের মুখস্থ। এরাই এখন মা-বাবা হয়েছে। অবধারিতভাবেই এদের সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে মা-বাবার কাছ থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই থাকতে হবে বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে সন্তানদের। বলতে হবে ইতিহাস। এ জন্য ক্লাস নিতে হবে না। পরোক্ষভাবেই এমন আবহ সৃষ্টি করা যায়, যেন সন্তান গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সঙ্গী করে।
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে কথা হয়। তারেক মাসুদ ও তিনি পরিচালনা করেছেন মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি। ‘আমরা সব সময় নিজেরাই শেখাতে চাই। মনে করি, পরের প্রজন্মের কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। কিন্তু সেটা ভুল।
তাদেরকেই এখন শুনতে হবে বেশি করে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওদের যে ভাবনা আছে, আশা আছে, সেটা অনুভব করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, তাতে তরুণদের কাছ থেকে তাদের ভাবনা শোনা জরুরি হয়ে উঠেছে। আমরা যদি পথ হারিয়ে ফেলে থাকি, তাহলে তরুণেরাই সে পথ আবার চিনিয়ে দেবে। ’ বললেন ক্যাথরিন।
মুক্তিযুদ্ধ তো বিশাল এক ক্যানভাস। সে ক্যানভাসে কত না হাজার ছবি ফুটে রয়েছে। সেই ছবিগুলো দেখে নেওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই জরুরি। ক্লাস নেওয়ার মতো করে মুক্তিযুদ্ধের মাহাত্ম্য বোঝানোর দরকার নেই। প্রসঙ্গক্রমেই নিজের শিশুকে বলে দেওয়া যায়, ‘ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কিংবা জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মারকগুলো দেখিয়ে বলা যেতে পারে, ‘পাকিস্তানিরা আর আলবদররা মিলে আমাদের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে। ’ কিংবা কাচের বাক্সে রাখা করোটিগুলো দেখিয়ে বলা যায়, ‘এ রকম ৩০ লাখ করোটি লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের মাটিতে। মাত্র নয় মাসে এই ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ’
আর হ্যাঁ, এখন মানুষ প্রযুক্তির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুত। তাই ইন্টারনেটের সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও থাকতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
অডিও-ভিডিও মাধ্যমে বেশি বেশি করে আনতে হবে মুক্তিযুদ্ধ। ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হলে তা আকৃষ্ট করবে নতুন দিনের মানুষকে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।