এতকিছু ... ওই সিনেমার জন্যই... এই মানুষটার গান আমাকে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে যেত বরাবরই। মনের ভেতর বাংলা গানের বীজ উনিই পুঁতে দিয়েছিলেন। তার সাথে আমার একবারই মাত্র দেখা হয়েছিলো। খুবই তিক্ত একটা পরিবেশে। ২০০৫ সালে একটা পত্রিকায় লেখা নিয়ে গিয়েছি।
তখন আমি খুব চেষ্টা করছি পত্রিকার সাহিত্য পাতায় লিখতে। চাইছিলাম যে মেইনস্ট্রিমে লিখতে পারলে লিখব না হলে লেখাই ছেড়ে দেব। আমি একজন অর্বাচীন না লিখলে বাংলা সাহিত্য মরে যাবে না। অথবা খুব আন্তরিকভাবেই চাইছিলাম কেউ বলুক তুমি যা লেখ তা অখাদ্য কবিতা হয় না হচ্ছে না। লেখাটা ছেড়ে দেই।
সরাসরি লেখা নিয়ে পত্রিকা অফিসে চলে গিয়েছি। অনেক বসে থাকার পর সাহিত্য সম্পাদক মহোদয় ঈশ্বরের মতো উদয় হলেন। বললাম, আপনার সাহিত্য পাতার জন্য একটা লেখা এনেছি।
: কী লেখা?
: কবিতা।
: কবিতা তো আমরা এখন ছাপছি না।
: তাহলে কী ছাপছেন?
: একশো বছরের পুরনো গল্প।
তিনি ঠিত কি না জানি না। তবে মেজাজটা কেন জানি সপ্তমে চড়ে গেল। মাথার ভেতর সাতটা অগ্নিগিরি একত্রে জ্বলে উঠলো।
বললাম, একশো বছরের বাংলা গল্প কী আমি লিখে দেব???
ভদ্রলোক চরম অপমান বোধ করলেন।
কিন্ত একজন কবিতাপ্রেমী তরুনের বিষাদও তাকে বুঝতে পারতে হবে। মাহবুব সাদিকের একটা কবিতার লাইন অনেকটা এরকম। : সাহিত্য সম্পাদক সাহেব আপনি কী জানেন কতটা মগ্নতায় বিভোর হলে কবিতার পাখি শীষ দিয়ে ওঠে?
সাহিত্য সম্পাদকের সাথে আমার কথোপকথনের পুরোটাই শুনেছিলেন কবি ও সঙগীতকার সন্জীব চৌধুরী। উনি তখন ওই পত্রিকার উপ-সম্পাদক। উনি উঠে আসেন ও আমাকে তার রুমে বসান।
আমার লেখাটা পড়তে চাইলেন। দিলাম। এইবার তিনি আমাকে চা খাওয়ালেন। উনার বক্তব্য ছিলো খূবই স্পষ্ট। তোমার লেখা খুবই ভালো।
কিন্ত পত্রিকায় যেরকম লেখা ছাপা হয় ঠিক পুরোপুরি সেরকম না। তবে তুমি পারবে। তোমার হবে। একথা তোমার চোখের মধ্যে লেখা আছে। লেখা চালিয়ে যাও।
আমি লেখা চালিয়ে গেছি। ওই কাগজে আমি কোনদিন লিখিনি। কোনদিনও লিখবো না। কিন্ত তারচেয়ে অনেক ভাল কাগজে ব্যক্তিগত যোগাযোগ পরিচয় খাতির ছাড়াই আমি লিখতে পেরেছি। এই পারাটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন।
চরম হতাশার মুহুর্তে যার বীজ পূঁতে সন্জীব চৌধুরী দ্য গ্রেট!!! দাদা তোমাকে স্যালূট!!! ক্ষমা করো। তোমার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। আর কোনদিন দেখা হবে না। কিন্ত তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার। দেখা হোক বা না হোক আমার হৃদয়ের গোপন মাদুলীতে লেখা থাকবে তোমার নাম ঘামের অক্ষরে।
কিছু নিঃসঙ্গ মানুষ অভিমানে চলে গিয়ে হাজারটা মানুষকে একা করে দিয়ে যায়। সন্জীব চৌধুরী ছিলেন আছেন থাকবেন।
দুই.
সন্জীব চৌধুরীকে নিয়ে প্রিয়কবি টোকন ঠাকুরের একটি লেখা। আমি জানি ও বিশ্বাস করি যে সন্জীব চৌধুরীকে নিয়ে এর চাইতে ভালো লেখা আর কোনদিন তৈরী হবে না। কোন লেখা কিংবদন্তী হয়ে যাবার পর নতুন লেখা তৈরী না হওয়াটা কোন পাপ না।
কিংবদন্তী একদিন বড় হয়ে যাবে । কিংবদন্তী একদিন বুঝতে শিখবে, কিংবদন্তী কাকে বলে? কেন মানুষ কিংবদন্তী হয়ে যায়? কেন মানুষ মুখে মুখে ফেরা জনশ্রুতির তাৎপর্য গ্রহণ করে?... কফিন বাকশের দিকে তাকানো ভাবলেশহীন শিশু,শিশুটি কি জানে কফিনের মধ্যে যে ঘুমিয়ে আছে, সে কে? সে কেন বাসায় না-ফিরে ঐ বাকশের মধ্যে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে? শুয়ে থাকা মানুষটি বাবা, না সঞ্জীব চৌধুরী? সঞ্জীব চৌধুরী কে ছিলেন? কি ছিল তার অন্তরের কথা, স্বপ্নের কথা? কী ছিল তার দাহ? কেনো এতো অগ্নিময় জলের বুদবুদ হয়ে ফেটে যাওয়া? কোন ভুবনে ছিল তার স্বপ্নের পাখি?
কিংবদন্তী একদিন জানতে পারবে,এখানে অন্ধকার ছিল,পরম্পরার । তার বাবা সেই অন্ধকারে জোনাকি হয়ে গেছে । সে একদিন বুঝতে পারবে, এখানে অনেক পাথর ছিল ,তার বাবা যৌবনের সমস্ত শক্তি ঢেলে পাথর সরাতে চেয়েছে, প্রেমতীব্র পথ তৈরি করতে চেয়েছে । কিংবদন্তী একদিন শুনতে পাবে, বাতাসে রঙ্গীন সুর ছড়িয়ে আছে, কারণ সঞ্জীব চৌধুরী গান গাইত ।
ভয়াল নৈঃশব্দে শব্দ ছড়িয়ে সঞ্জীব চৌধুরী চলে গেছে । শাদা শূন্যতায় মধুবনের রঙ ছড়িয়ে গেছে, আলাপের মধ্যে কবিতা পুঁতে রেখে গেছে । এখানে অনেক বিচ্ছিন্নতা ছড়ানো বলে, তার বাবা অনেক গল্প রেখে গেছে ।
রাত্রি গভীর হলেও, যে- রাতে কিংবদন্তীর ঘুম আসবেনা, যখন সে খুলে খুলে দেখবে অ্যালবাম-ভর্তি এক মুখ, হাওড়-প্রদেশের সেই মুখই সঞ্জীব চৌধুরীর মুখ। কিংবদন্তী নিশ্চয়ই টের পাবে,বহুদিন আগে তার বাবাই কিংবদন্তী হয়ে গেছে ।
এমনকি তার জন্মের আগেই কিংবদন্তী হয়ে যায় মিছিলের ,কবিতার, গানের দলছুট সঞ্জীব চৌধুরী । এই ঠাঠা-মরার দেশে সঞ্জীব চৌধুরী বড় বেশি অপরাধী, কারণ তার ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল । কারণ, সে ভালোবাসত । কারণ এই পোশাকি সিস্টেমের দেশে সঞ্জীব চৌধুরী আপন অস্তিত্বের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে । এই ফাঁকা-ফাঁকা মন্দির-মসজিদ-গির্জার দেশে , সঞ্জীব চৌধুরী ছিন্নমুল মানুষের বাসস্থানের ভাবনা মাথায় রেখেছে ।
নিরন্নের, অন্ন ও পানীয়ের অধিকারের কথা বলার জন্য, সাহসে, বুক টানটান করে রাজপথে দাঁড়িয়ে থেকেছে । কিংবদন্তী একদিন জানবে, মেডিকেল কলেজের গবেষণায় তার বাবার শরীর কাজে লেগেছিল । সেখানেই রয়ে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীর কংকাল... হয়তো আগন্তুকের সঙ্গে আড্ডা দিতে চায়ও, নতুন একটি কবিতা নিয়ে, গান নিয়ে মেতে উঠতে চায় । মা বকা দিলে, হয়তো একদিন খুব মনখারাপ হলে আমাদের কিংবদন্তী কাউকে না বলে একা একাই চলে যাবে মেডিকেল কলেজের দিকে । সে কি বাবার কংকালের সঙ্গে কথা বলবে_'বাবা আমার মন ভালো নেই, তুমি একটা গান গাও তো '
আমরা কিংবদন্তীর পেছনে পেছনে যাব এবং লক্ষ রাখব, দেখব, বাবার কংকাল মেয়ের আবদার রাখে কিনা? কংকাল কি কথা রাখবে...?
আমরা জানি সঞ্জীব চৌধুরী কিংবদন্তী ছিলেন...
..................................................................................................
[বি.দ্র. এই লেখাটা সন্জীব দা'র মৃত্যুর ৩ দিন পর লেখা।
কিংবদন্তী সন্জীব চৌধুরী ও শিল্পী (তার স্ত্রী)'র একমাত্র কন্যা। সন্জীব দা'র কঙ্কালটা এখনো ঢাকা মেডিকেলে দান করা আছে। ১৯ নবেম্বর তার চলে যাওয়ার দিন, ৪র্থ তম। ২০০৭-এ যখন সন্জীব দা চলে যান, তখন কিংবদন্তীর বয়স ছিল ৪]
উইকি থেকে:
সঞ্জীব চৌধুরী (২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ – ১৯ নভেম্বর ২০০৭) ছিলেন একজন বাংলাদেশী সংগীতশিল্পী ও সাংবাদিক। তিনি জনপ্রিয় বাংলা ব্যাণ্ডদল দলছুটের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন।
সঞ্জীব দলছুটের চারটি অ্যালবামে গান গাওয়ার পাশাপাশি অনেক গান রচনা ও সুরারোপও করেন। তিনি একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকও ছিলেন এবং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনএ কাজ করেন। তিনি ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে আকস্মিক অসুস্থতার পর ১৮ নভেম্বর ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিভাগে মারা যান। তিনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন। ১৯৭৮ সালের মাধ্যমিক এবং ১৯৮০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান করে নেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী এবং চার বছরের কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।