আমি আবির "খা...খা...খা...... বখখিলারে খা...! কাঁচা ধইরা খা...!" গ্রাম-গঞ্জের মেঠো পথ ধরে ভেঁসে আসা চির চেনা সেই সুর রচয়িতা তারা "বেদে"। এই আধুনিক যুগেও জীবন যুদ্ধে জীবিকার সন্ধানে "এই...... সিঙ্গা... লাগাই......, দাঁতের পোক ফালাই..." বেদেনীর বেদনাময়ী জোরালো আবেদন এখন আর কারো মনে নাড়া দেয় না। আগের মতো কেউ আর চাল, ডাল, শাক-সব্জির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাঁটে যান না। বদল প্রথা নেই আর এ সংসারে। অর্থের প্রবল নেশায় স্থলের মানুষেরা ভাতের সাথে মাছ বস্তুটি আছে কিনা খবর রাখেনা।
আসহায় হয়ে পরেছে এসব মাছ ধরা লোকগুলো এরা সামাজের "মানতা"। বেদেরা স্থলে আর মানতাদের নদীতেই সংসার। কেমন আছেন ঠিকানা বিহীন জীবনে এই যাযাবর বেদে ও মানতা সম্প্রদায়রা। নিজ ভূখন্ডে বাস করেও যারা পরবাসী! সমাজ সভ্যতা গড়ার কাজে প্রতিনিয়ত নিবেদিত প্রানের লোকগুলো কেমন আছে?
বিষধর সাপ নিয়ে খেলা, বিষাক্ত জীবন নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌ-পথে চলাচল করতো এ সম্প্রদায়।
এখন নৌ-পথে বাধ, সস্নুইজগেট নিমর্ানের ফলে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। বেদেরা এখন সড়ক পথে এসে পথ থেকে প্রানত্দরে জনগুরম্নত্বপুর্ন হাট-বাজারের সংলগ্নে ছোট-ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠো পথে। তবে দিন দিন এ বেদে সম্প্রদায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানান পন্য এখন তাদের হাতে উঠেছে।
বেঁচে থাকর নিরনত্দর সংগ্রামেই আজ তাদের ভিন্ন পথে চলা বৈকি। তার পরও যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। তেমনি আশ্রয় নেয়া পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা সদর বাজারের নলখোলা বাস ষ্ট্যান্ড সংলগ্নে ঠাই নিয়েছে বিক্রমপুরের হলদে গ্রামের একটি বেদে বহর। এ বহরে ৬ টি পরিবার। মোট লোক সংখ্যা ৩৩ জন।
এ বহরের সর্দার সাগর। কথা হয় সর্দারের ছোট ভাই তাহের'র সাথে। তিনি বলেন, আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছেনা কোন ঠিকানা! আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবেই চলতে আমাদের।
প্রতিটি বেদে বহর এক একটি রাজ্যের মতো কল্পনা করে এরা। সর্দার এদের রাজা।
তার নিয়ন্ত্রনে চলতে হয় বহরের সবাইকে। বেদে বহরের মেয়েরাই আয় রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। পুরম্নষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশুনা করে।
সর্দাররা বংশক্রমেই সরদার হয়। সর্দারের দৃষ্টিতে অপরাধ করলে বেদে সমাজে জুতা পেটা, অর্থ দন্ডসহ নানা ধরনের শাসত্দির বিধান রয়েছে। বললেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁেচনা। পুরম্নষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরম্ন করেছে এই অভাব অনটনের ভবে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা রম্নপা তুলে দেয়ার কাজ করে।
কেউ দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। বিক্রি করছে শাড়ী, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতি খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে।
বেদে বহরের বয়স্করা জানালেন, বেদের মধ্যে রয়েছে অনেক উপ-সম্প্রদায়। যেমন, মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার, বান্দরওয়ালা, সওদাগার, কুড়িন্দা, হাতলেহেঙ্গা, মীশ্চিয়ারি, গাড়লী।
মালবৈদ্যরা প্রধানত সাপ খেলা দেখায় ও দাতেঁর পোকা তোলে। বাজিকরেরা ম্যাজিক দেখায় ও জাদুটোনা করে। শালদার মাছ ধরে, নদী থেকে ঝিনুক তুলে মুক্তা বের করে এবং চুড়ি বিক্রি করে। বান্দরওয়ালা বান্দরের খেলা দেখায়। সওদাগার চুড়ি, শাড়ি-কাপর বিক্রি করে।
কুড়িন্দা হাতগোনা ও হাত দেখে ভাগ্য বর্ননা করে। হাতলেহেঙ্গা পুকুর ডোবায় সোনা-রম্নপা হাড়িয়ে গেলে তুলে দেয়। মীশ্চিয়ারি সিঙ্গা ফুঁেক শরীর থেকে বিষ বের ও বাতের চিকিৎসা করে। গড়ালীদের একমাত্র পেশা সাপ ধরা, সাপের বিষ নামানো, সাপ বিক্রি ও চলচিত্রে সাপ সরবরাহ করা।
এ সম্প্রদায়ের সব চাইতে ব্যতিক্রম অনুষ্ঠান বিয়ের অনুষ্ঠান।
বিয়ের আসরে বরকে নির্ধারিত গাছের ডালে অথবা ঘরের চালে বসে মৃতু্য ঝুকি নেয়। কনে গাছের নিচে এসে বরকে নামানোর জন্য কাকতি-মিনতি করে। কনে বরকে আজীবন আয়-রোজগার করে খাওয়াবে বলে একের পর এক প্রতিশ্রম্নতি দেয়া হয়। তখন বর গাছ বা চাল থেকে নেমে আসে। তবে যৌতুক বিহীন বিয়েতে কোন কাজী রেজিষ্টার প্রয়োজন হয় না।
হবেই বা কি করে? এরা কোন অঞ্চলে ভোটার নয়। এদের রেজিষ্ট্রি করে কাজী বিপদ ডেকে আনতে চায়না। ওদের কোন ঠিকানা নেই, ওরা আমাদের মাঝে থেকেও আমাদের লোক নয়।
নদীর কলতানে যাদের ঘুম ভাঙ্গা আর ঘুমোতে যাওয়া তেমনি অপর একটি সভ্যতার নিগৃহীত সম্প্রদায় মানতারা। তেঁতুলিয়া-বুড়াগেীরাঙ্গ নদীর বাঁকে খালে ওদের দেখা মেলে।
জন্ম থেকে নদীর জলে খেলা করতে করতে ওরা বড় হয়। এরকম একজন বশার সর্দারের স্ত্রী মাকখুুম (২৭), ১৫ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণ ছিন্ন, রোগাক্রনত্দ শরীর পুষ্টিহীনতায় ভুগেও মাকখুম রেহাই পাচ্ছে না সংসার নামক যন্ত্রনা থেকে। ৯ সদস্যে পরিবারে ৭ সনত্দানের জননী আজ। উপজেলার বগীর একই খালের আদম আলী (৩০), ছদু (৩৫)সহ ১শ টির অধিক নৌকায় প্রায় ১২শ লোকের বাস।
এদের প্রত্যেকের গড়ে ৭-৮টি সনত্দান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন খালে রয়েছে এরকম প্রায় ৮হাজার লোক বসবাস করে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নেই কোন ধারনা। আর থাকবেইবা কি করে? ওরাতো নদীর জলে বসবাস করে, মাছ ধরে বিক্রি করে, চাল, ডাল কিনে খায়। পুঁজি যোগানোসহ এ সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্য-সহায়তায় নেই সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ।
এরা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এদের ভোটের রাজনীতি নেই। কে জিতল আর কে হাড়ল সে খবর তারা রাখে না ওরা। অথচ কায়েক'শ বছর ধরে মানতা সম্প্রদায়ের মানুষকে যাযাবর চরিত্র নিয়ে সমাজ-সভ্যতায় এদের অংশ গ্রহণ।
মানতা সম্প্রদায় মূলত বরশি ও ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরে।
পেটের ৰুধা মিটিয়ে সঞ্চিত অর্থের ওপর বরশি, জাল কেনা আর নৌকা মেরামত নির্ভর করে। শিৰা কি এরা জানেনা। ভোটাধিকার নেই এদের। এরকম সমাজ সভ্যতার অনেক কিছুই অজানা এই মানুষেরা নদীর কয়েক ফুট উচু ঢেউ কিংবা প্রকৃতিক দূর্যোগের মধ্যে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারে, নদী আর সাগর জলের আচর-আচরন এদের নখদর্পনে। জলের মতি-গতির সাথে সখ্যতা এদের জন্মাধিকার।
এরা দল বেঁধে বহর নিয়ে বঙ্গোপসাগরের গভীর থেকে শুরম্ন করে সুন্দরবন এবং হাতিয়া, সন্দ্বীপ, টেকনাফ পর্যনত্দ মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ায়। জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চল সোনারচর, রম্নপারচর, জাহাজমারা, শীলেরচর, চর পাতিলায় এদের অনেক সময় দেখা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ রৰায়ও এদের গুরম্নত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এরা প্রধানত পোয়া, রামছোস (তাপসী), ট্যাংরা, গলসা, পাঙ্গাশ, কাওন প্রভৃতি মাছ ধরে। মইয়া জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে।
এ সম্প্রদায় প্রতিটি নারী-পুরম্নষ, শিশু-কিশোর মাছ ধরায় পারদশর্ী। এতসব অবদানের পরেও মানতা সম্পদায় আমাদের সমাজের অনর্ত্দভূক্ত নয়। নানা সমস্যা-সংকট এদের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এরা ভূখন্ডের কয়েশ বছরের পুড়ানো বাসিন্দা হলেও এদের নেই কোন প্রকার নাগরিক অধিকার। নেহাত কঁচুড়িপানা কিংবা নদীর জলে ভেসে যওয়া খড়কুটোর মতোই মানতারা আজীবন নদীর পানিতে ভেঁসে বেড়ায়।
নাগরিক পরিচয় সংকট এদের প্রবল। এ সম্প্রদায়ের নাম স্বাৰর করতে পারে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় এবং ভূমি সমস্যায় এ সম্প্রদায়ের মানুষের মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য। এ সম্প্রদায়ের মানুষের মৃতু্য হলে আগেকার দিনে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হত।
আজকের দিনেও নদীর পাড়ে বা কোন ভূস্বামীর পরিত্যাক্ত ভিটের দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে যাযাবর লাশটির। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।