কিছুটা আমার কিছুটা তোমার.. মেলেনা তো কিছু এখন আর!
কিছু সময় থাকে যখন মন খারাপ করে থাকতে থাকতে নিজের প্রতি নিজেরই অসহ্য লাগে,কিন্তু তারপরেও মন ভালো হয় না,সুপ্তি ভেবে পায় না,কেন এমন হয়?একটু কিছু না হয় হল,তা নিয়ে এত সময় কেন মন খারাপ থাকে?!এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল,বাসায় আজকে বলতে গেলে সুপ্তি একাই আছে,ওর শ্বাশুড়ী গেছেন বড় ননদের বাসায়,আর দেবর কি এক এসাইমেন্টের কাজে বন্ধুর বাসায় থাকবে,আসিফ এর আসার কোন ঠিক নেই,১২টা বা ১টাও বাজতে পারে। এখন বাজে ৯টা,সুপ্তির ইচ্ছে হল আসিফকে ফোন করে বলতে,ওর একা একা খুব ভয় লাগছে আজকে যেন সে তাড়াতাড়ি চলে আসে...ভাবতে ভাবতে মোবাইলে আসিফের নাম্বারে ট্রাই ও করল,মোবাইল বন্ধ। নিশ্চয়ই মিটিং এ আছে। এবার শ্বাশুড়ীর মোবাইলে ট্রাই করে,
সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার পর শ্বাশুড়ীই জিজ্ঞেস করলেন,
--কি ব্যাপার?আসিফ বাসায় আসেনি এখনো?
কিছুক্ষন চুপ থেকে সুপ্তি বলে,
--না আম্মা,আসেনি
--একা একা খারাপ লাগছে না?
সুপ্তি কিছু বলেনা,কেন জানি খুব কান্না পায়...
--মন খারাপ করোনা,চলে আসবে আসিফ,এই ছেলেটা যে কবে বুঝবে...এত করে বলে আসলাম,আমি বাসায় নেই যেন দেরি করে বাসায় না আসে...তুমি এক কাজ করো,বেশি একা লাগলে পাশের ফ্ল্যাটের মিলির সাথে কিছুক্ষন গল্প করে আসো,সেও তো একা থাকে,দু'জনেরই ভালো লাগবে।
সুপ্তি হু,হ্যা কিছু একটা বলে ফোন রেখে দেয়।
একবার ভাবে বাসায় আম্মু কে ফোন দিবে পরে কি ভেবে আর দিল না,থাক শুধু শুধু আম্মুকে চিন্তায় ফেলে লাভ নেই,সবাই বুঝবে ওর একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে,খারাপ লাগছে শুধু আসিফ ছাড়া। অভিমানে আবারো কান্না চলে আসে সুপ্তির।
আজ এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে ওদের,কিন্তু বিয়ের পর থেকে আসিফের ব্যাস্ততা ওকে নিয়ে না হয়ে তার অফিসকে নিয়েই বেড়ে গেছে। সুপ্তি খুব কাছ থেকে ওকে দেখার চেষ্টা করে,কেমন দূরে সরে গেছে আসিফ,বিয়ের আগের মানুষ আর পরের মানুষের মধ্যে রাত দিনের পার্থক্য এখন। সুপ্তি ভেবে পায় না আসিফ কি ইচ্ছে করেই এমন করছে নাকি অনিচ্ছাকৃ্ত!বিয়ের আগেও তো আসিফ এই চাকুরীটাই করতো,কই তখনতো এত ব্যাস্ত ছিল না ও,ঠিকই নিয়ম করে দেখা করতো ওর সাথে,ওর খবর নিতো সব সময়,কল দিতে না পারলেও এসএমএস দিতো,আর এখন?...সুপ্তি মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে কিন্তু আসিফের ওকে কল দেবার বা ওর এসএমএস এর উত্তর দেবার সময় হয় না।
নাহ,এসব ভাবতে আর ভালো লাগছেনা সুপ্তির,এভাবে না পাওয়ার হিসেব করতে ভালো লাগেনা,এক সময় আসিফ কে ছাড়া নিজের জীবন কে মূল্যহীন ভাবতো,আজ জীবনে আসিফ এসেছে,সাজানো সংসার হয়েছে,আসিফ ছাড়াও এ বাড়িতে এসে আরো অনেক মানুষ পেয়েছে যারা ওকে অনেক ভালোবাসে...এই বা কম কিসে?
কিন্তু তারপরেও...কোথায় যেন কি নেই নেই মনে হয়...
আজকে আকাশে তারার মেলা বসেছে,কিন্তু চাঁদ নেই,কিছুটা ঝিরিঝিরি বাতাস ও আছে,ছাদে এসে মনটা বেশ ভালো হয়ে যায় সুপ্তির। আশে পাশের ছাদেও তেমন কেউ নেই,আর অন্ধকারে এত কিছু ভালো করে দেখাও যাচ্ছেনা,সুপ্তি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নেয়...
এক জোনাকি দুই জোনাকি তিন জোনাকি ওরে
তোমার লাগি বন্ধু আমার মন যে কেমন করে...
সুপ্তি চোখ খোলে না,একটু অবাক হয়ে আবার খেয়াল করে, কে গাইছে গানটা?এত দরদ দিয়ে,আবার কানে আসে...মনে হচ্ছে আশে পাশেই কোথাও কেউ গাইছে। চোখ বন্ধ করেই সুপ্তি গানটা শুনতে থাকে,আস্তে আস্তে মনটা অনেক ভালো হয়ে যায় ওর।
এক বাঁশিয়া দুই বাঁশিয়া তিন বাঁশিয়া ওরে
বাঁশি কান্দে বন্ধু আমার রইলা কোন দূরে
কে গাইছে গানটা?!সুপ্তি চোখ খুলে চারপাশে তাকায়,নাহ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না,কিন্তু মনে হচ্ছে খুব পাশেই কেউ গাইছে,হাঁটতে হাঁটতে ছাদের ওপাশে চলে আসে,আরে একি?!!!মিলি ভাবি?!!গান তাহলে মিলি ভাবিই গাইছে?এত দিন হয়ে গেল,মিলি ভাবি এত সুন্দর গান গাইতে জানে সেটা তো সুপ্তি জানতো না!আস্তে আস্তে মিলির কাছে যেয়ে দাঁড়ায় সুপ্তি,মিলি ভাবি চোখ বন্ধ করে খুব দরদ দিয়ে গান গাইছে,অন্ধকারে ভালোভাবে দেখা না গেলেও সুপ্তির মনে হল মিলি ভাবির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সুপ্তি চেয়ারে বসা মিলি ভাবির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।
অবাক হয়ে দেখতে লাগল মিলি ভাবি কে...কন্ঠে দরদ আর চোখে জল...মানুষ কিভাবে পারে?!!কার কথা ভেবে এভাবে কাঁদছে মিলি ভাবি? খুব জানতে ইচ্ছে করে সুপ্তির,যদি সেটা জামান ভাই হয় তাহলে তো বলতে হবে অনেক ভাগ্যবান জামান ভাই,কতটা ভালোবাসা মনে থাকলে পরে তার কথা মনে করে গান গাইতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে...সত্যিই ভাগ্যবান জামান ভাই। নিজের কথা মনে পরে যায়,সে নিজেও তো এমন কত রাত একা একা জেগে আসিফের কথা ভেবে কাটিয়েছে,কত দিন ওর ফোনের অপেক্ষা করতে করতে কেঁদে ফেলেছে...মানুষের মন আসলেই অদ্ভুদ!কিভাবে পেরেছিল তখন এতটা আবেগ ঝরাতে সুপ্তি নিজেও জানেনা,আর আজ...?কার জন্য করবে?সে তো এসব বুঝবেও না...আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে। মিলি ভাবি চোখ খুললেন,ওকে এভাবে সামনে দেখে কিছুটা অবাক ও হলেন,
--তুমি কখন এসেছ?!
--অনেকক্ষন,তোমার গান শুনছিলাম,ভাবি তুমি এত সুন্দর গান কর জানতাম না তো...
আস্তে করে হাসলেন ভাবি। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--কখনো সেভাবে চর্চা করিনি,মাঝে মাঝে গেয়েছি,সে কথা বাদ দাও,তুমি এখানে কেন?আসিফ ভাই ফিরেনি এখনো?
--নাহ,একা একা ভালো লাগছিল না,তার উপর কারেন্ট ও নেই তাই ছাদে আসলাম,তুমি?
--আমার ও একই অবস্থা,আজ তোমার ভাই ব্যাবসার কাজে রাজশাহী গেছেন।
সুপ্তি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
--আচ্ছা,ভাবি তুমি জামান ভাইকে কখনো অভিযোগ করো না?এই যে সে তোমাকে সময় দেয় না,তোমার ফ্যামিলি থাকে এক জায়গায়,শ্বশুড় বাড়ি এক জায়গায় আর তুমি পড়ে আছ এক জায়গায়,সে সকালে বেরিয়ে যায়,রাতে ফেরে আবার সপ্তাহে কয়েকদিন ঢাকার বাইরে থাকে,তোমার তো অনেক কষ্ট হয়,কিছু বলো না তুমি ভাইকে এটা নিয়ে?
ভাবি কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন,তারপর ওর হাতে হাত রেখে বললেন,
--দেখো সুপ্তি,আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর হলো,আর ওকে আমি জানি সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে,তোমাদের ভাইয়ের বাবা নেই,মা,ছোট দুই ভাই এক বোন সবার দায়িত্ব ওর উপর,তেমন কোন সহায় সম্পত্তি ও নেই,সাহায্য করার মতো আত্বীয়-স্বজন ও নেই,জীবনে ও যা কিছু অর্জন করেছে সব নিজের চেষ্টায়,এই যে ও এখন ব্যাবসাটা করছে তাও ওর একার চেষ্টায়,ব্যাংক লোন নিয়েছে,নতুন ব্যাবসা,সব মিলিয়ে ওর মাথায় হাজারো টেনশন থাকে সারাক্ষন।
ভাবতে পারো কত চিন্তা?তারপরেও ও আমাকে ওর পাশে রেখেছে,আমাকে ছাড়া ও থাকতে চায় না,যত কষ্টই হোক। ও আশা করে আর কিছু না হোক ওর পাশে থেকে ওর কষ্টের কিছু ভাগ আমি নিব,এগুলো কি আমার প্রতি ওর ভালোবাসা না?দেখো সুপ্তি,কি পেলাম আর পেলাম না,কি ছিল আগে আর এখন নেই সে হিসেব করে কি লাভ?কষ্টের পরেই তো সুখ আসে,যত কিছুই হোক ভালোবাসার মানুষটির সাথে থাকতে পারছি এই বা কম কিসে বল?ওর চিন্তার ভাগ নিতে পারছি ওকে সান্তনা দিতে পারছি এই তো অনেক তাই না?''
সুপ্তি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিলি ভাবির দিকে,মিলি আবার বলতে থাকে,
--আমি স্বার্থপরের মতো নিজের সুখের চিন্তা করতে চাই না,হোক না অল্প তবুও ভাগ করে নিতে চাই,সুপ্তি,সংসার একেই বলে,কত টা দিতে পারলে তার হিসেব করো,পাওয়ার না। ''
সুপ্তি ধীরে ধীরে উঠে দাড়ায়,কয়েক মাস আগে আসিফ বলেছিল, ওর কোম্পানির সাথে আরেকটা কোম্পানির আইনগত লড়াই চলছে,খুব সম্ভবত ওর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে,অনেক চিন্তায় আছে সে এ নিয়ে,অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে ওকে তাই,চাকরী পাওয়া তো এত সোজা না। আসিফের সেই চিন্তাক্লিষ্ট মুখটা আজ এতদিন পর ওর চোখে ভেসে উঠল,কিন্তু সেদিন ভাবে দেখতে পারেনি সুপ্তি...নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল সুপ্তির,খুব স্বার্থপর কেউ...চারপাশে আলো জ্বলে উঠল,কারেন্ট এসেছে,মিলি ভাবি ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,
--নিচে চল কারেন্ট চলে এসেছে
সুপ্তি চোখে পানি রেখেই হাসার চেষ্টা করল একটু সেটা দেখে মিলি ভাবি হেসে বলল,
--এই মুহুর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি হলে তুমি,যার চোখে পানি আর ঠোঁটে হাসি...হাহাহাহা,চল নিচে যাই,তুমি আসো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।