চলচ্চিত্রের পর্দায় তিনি ছিলেন মন্দলোক। দেবানন্দ, রাজকাপুর, দীলিপকুমার, রাজেশ খান্নাকে বিপদে ফেলতে তার জুড়ি ছিল না। পর্দায় তাকে দেখামাত্র দর্শকের মনে জাগত আশংকা-- এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটল। ফিল্ম ম্যাগাজিন স্টার ডাস্ট তাকে আখ্যা দিয়েছিল-- ‘ভিলেইন অফ দি মিলেনিয়াম’। পুরো নাম প্রাণ কৃষাণ সিকান্দ।
তবে প্রাণ বা প্রাণ সাহেব নামেই তিনি চলচ্চিত্রজগতে সুপরিচিত ছিলেন। ১২ জুলাই হিন্দি সিনেমার এই কিংবদন্তি খলনায়ক ও চরিত্রাভিনেতা প্রাণ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
হিন্দি সিনেমায় প্রাণ অভিনয় শুরু করেছিলেন নায়ক চরিত্রে, খানদান সিনেমায় ১৯৪২ সালে। কিন্তু নায়ক চরিত্র নয়, তাকে জনপ্রিয়তা এনে দেয় খলনায়ক চরিত্র। দেবানন্দের সঙ্গে জিদ্দি (১৯৪৮) তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
একই বছর মুক্তি পাওয়া ‘বারসাত কি এক রাত’ এবং পরের বছর ‘বাড়ি বাহেন’-এর সাফল্য তাকে প্রতিষ্ঠিত করে খলনায়ক হিসেবে।
বিশেষ ধরনের কণ্ঠস্বর আর সংলাপে ‘বারখুদার’ শব্দটি তাকে দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীতে প্রাণ খলনায়ক চরিত্রে হাস্যরস নিয়ে আসেন। সত্তর ও আশির দশকে তিনি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন।
প্রাণ কেন ইতিবাচক চরিত্রে অভিনয় শুরু করলেন সে সম্পর্কে সিনেসাংবাদিক ও লেখক শচীন ভৌমিক তার স্মৃতি কথায় লেখেন এক মজার গল্প।
প্রাণ একবার তার এক বন্ধুর বাড়িতে গেছেন। কলিংবেল বাজার পর দরজা খুলে বন্ধুর টিনএজ মেয়ে প্রাণকে দেখেই ভয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে বাবাকে বলে, “বাবা সেই খারাপ লোকটা এসেছে। ”
তারপর থেকেই নাকি প্রাণ সিদ্ধান্ত নেন পর্দায় কিছুটা ভালো মানুষ সাজার। শচীন ভৌমিক আরও লিখেছেন প্রাণ একবার তাকে বলেছিলেন নাতি-নাতনিদের মন রাখার জন্যই তাকে ভালো মানুষের ভূমিকা বেছে নিতে হয়েছে।
ভালো হোক কিংবা খারাপ হোক, অবিস্মরণীয় অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রাণ।
উপকার সিনেমার চাচা, জাঞ্জিরের শেরখান ভোলার মতো নয়। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রাণ। সবগুলো খলচরিত্র নয়। এসব সিনেমায় তার ভালোমানুষ রূপটি দর্শকরা গ্রহণ করেছিলেন সাদরে। শরাবিতে ভিকির (অমিতাভ) বাবা, ডন এ বিজয়ের (অমিতাভ) বন্ধু, শাহেনশাতে অমিতাভের চাচার চরিত্রে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি।
কসৌটি সিনেমায় কিশোর কুমারের গাওয়া একটি গানে পর্দায় লিপ সিং করে দারুণ জনপ্রিয়তা পান তিনি। ‘হাম বোলেগা তো বোলোগি কি বোলতা হায়’ গানে প্রাণের অভিব্যক্তি অবিস্মরণীয়।
প্রাণ কৃষাণের জন্ম ১৯২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির কোটগড় এলাকায়। বেশ ধনশালী পাঞ্জাবি পরিবারে জন্ম হয় তার। বাবা কেওয়াল কৃষাণ সিকান্দ ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে।
ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। বিশেষ করে ভালো ছিলেন গণিতে। আলোকচিত্রি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। লাহোরে ঘটনাক্রমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় লেখক ওয়ালি মোহাম্মদ ওয়ালির।
এই পরিচয়ের সূত্রেই চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয়। লাহোরে তখন চলচ্চিত্রশিল্পের রমরমা অবস্থা। পাঞ্জাবি সিনেমা ‘ইয়ামলা জট’ (১৯৪০) দিয়ে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। পরপর বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।
১৯৪২-এ হিন্দি সিনেমা ‘খানদান’-এ নূরজাহানের বিপরীতে রোমান্টিক নায়ক হন।
লাহোরে প্রাণ প্রায় ২২টি সিনেমায় অভিনয় করেন। নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠাও পান।
১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর লাহোর ছেড়ে প্রাণ চলে আসেন মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে)। সিনেমায় অভিনয়ের কোনো সুযোগ না পেলেও চেষ্টা চালিয়ে যান আর পাশাপাশি কাজ করতে থাকেন মেরিন ড্রাইভে অবস্থিত দেলমার হোটেলে। সে সময় পরিচয় হয় লেখক সাদাত হাসান মান্টোর সঙ্গে।
সেই দিনগুলোতে অভিনয়ের সুযোগ না পেয়ে প্রাণ বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন বলে সাদাত হোসেন মান্টো তার ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ বইতে উল্লেখ করেছেন।
বন্ধু শ্যাম আর মান্টোর সহায়তায় প্রাণ সুযোগ পেলেন বম্বে টকিজের সিনেমা জিদ্দিতে। নায়ক নয়, খলনায়ক। প্রাণ কিন্তু প্রথমে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজি হননি। পরে শ্যাম আর মান্টোর পরামর্শেই সুযোগটি গ্রহণ করেন।
জিদ্দিতে নায়ক ছিলেন দেবানন্দ আর নায়িকা কামিনি কৌশল। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
দীর্ঘ ষাট বছরের অভিনয় জীবনে পুরস্কার সম্মাননা কম পাননি তিনি। চলতি বছরই পেয়েছেন দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত হন প্রাণ।
চারবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন প্রাণ। ১৯৬৭ সালে উপকার, ১৯৬৯ সালে আঁসু বান গায়া ফুল, ১৯৭২-এ বেইমান সিনেমায় অভিনয়ের জন্য পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। আর ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন তাকে তিনবার পুরস্কৃত করেছে।
১৯৬১ সালে জিস দেশমে গঙ্গা বেহতি হায়, ১৯৬৬ সালে শাহিদ এবং ১৯৭৩-এ জাঞ্জির সিনেমায় অভিনয়ের জন্য পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান প্রাণ।
তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে মধুমতী, রাম আউর শ্যাম, দিল দিয়া দর্দ লিয়া, বাহার, বিরাজ বৌ, দেবদাস, কাশ্মীর কি কলি, হাফ টিকেট, গুমনাম, সফর, জানোয়ার, ববি, জনি মেরা নাম, ডন, দেশ-পরদেশ, অমর আকবর এ্যান্টোনি, নসিব, শাহেনশা, সনফ বেওয়াফা, ১৯৪২ : এ লাভ স্টোরির মতো অসংখ্য ব্যবসা সফল সিনেমা রয়েছে। অমিতাভ বচ্চনের অনুরোধে সর্বশেষ মৃত্যুদাতা সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। চারশ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রাণ। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্ব›দ্বী।
পর্দায় মন্দলোক হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা পেলেও ব্যক্তিজীবনে সহকর্মীদের কাছে সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘ভালোমানুষ প্রাণ সাহেব’। বন্ধু হিসেবেও বিশ্বস্ত ও নিবেদিত।
বলিউডে যে দীর্ঘজীবন তিনি অতিবাহিত করলেন তা সাফল্যে, শ্রদ্ধায় উজ্জ্বল। হিন্দি সিনেমার দর্শকদের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন প্রাণ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।