মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করে বলেন, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা ও নির্যাতনের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে।
এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে সোহাগপুরের গণহত্যা এবং গোলাম মোস্তফা তালুকদার নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় ফাঁসির আদেশ দিয়ে বিচারক বলেন, “সে যেভাবে এসব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে সুবিচার হবে না। ”
এছাড়া ১ ও ৭ নম্বর অভিযোগে বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে কামারুজ্জামানকে।
আর ২ নম্বর অভিযোগে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় তাকে দেয়া হয়েছে দশ বছরের কারাদণ্ড।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাই আল বদর, আল শামস নামের বিভিন্ন সশস্ত্র দলে যোগ দিয়ে সারা দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায় বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের এজলাসে হাজির করার পর বিচারকরা এজলাসে বসেন।
ট্রাইব্যুনাল প্রধান ওবায়দুল হাসান দুই পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ দিয়ে মামলার ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে তুল ধরার পর ১১টা ২১ মিনিটে ২১৫ পৃষ্ঠার রায়ের ৬২ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যনালের সদস্য বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ার পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান চূড়ান্ত আদেশ ঘোষণা করেন।
আদেশ শুনে উঠে দাঁড়িয়ে কামারুজ্জামান বলেন, “রং জাজমেন্ট।
সবাইকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ”
তার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক আদেশের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আপিল করব। ”
তবে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
রায়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে ট্রাইব্যুনালের বিচারে সন্তোষ প্রকাশ করে।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, যার বিরোধিতা করে সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করে কামারুজ্জামানের দল জামায়াতে ইসলামী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোর পর্যবেক্ষণেও জামায়াতের সাংগঠনিকভাবে যুদ্ধপরাধের বিষয়গুলো উঠে আসে।
কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশের মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায় হলো।
প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি এ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেয়। একই ট্রাইব্যুনালে ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন আনে।
এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়।
তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
সেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সহিংস রূপ নেয় রাজনীতি। বিচারের পরোক্ষ বিরোধিতাকারী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ ও মিত্র দলগুলো।
কামারুজ্জামানের রায় উপলক্ষ্যে আগের দিন থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের নিয়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়।
ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের বাইরে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ দিতে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের। জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতেও স্লোগান দেন তারা।
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়।
ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেপ্তারের পর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন গত বছর ১৫ জানুয়ারি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়।
পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
গত বছর ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৬ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন।
এই বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহে (ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল) গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।
স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।
১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।