আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কারাগার থেকে কামারুজ্জামানের সেই চিঠি (কপি পেস্ট)

আমি ভব ঘুরেঈ হবো এটাই আমার এ্যম্বিশান.....
যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসা নেতাদের দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে কারাগার থেকে চিঠি লিখেছেন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। গত বছরের ১৩ জুলাই তিনি গ্রেপ্তার হন। সূত্রের দাবি, এমন চিঠির খবর শুনে কারাগারে চরম উৎকণ্ঠায় পড়েন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বিষয়টি যাতে জানাজানি না হয় সেজন্য তারা লোক মারফতে নেতাদের সতর্ক থাকতে বলেছেন। জানা গেছে, চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে দলের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে কামারুজ্জামান স্বনামে চিঠিটি লিখেন। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে চিঠিটি দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল নেতাদের হাতে পেঁৗছান। জামায়াতের ভেতরে এবং বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি করা সেই চিঠির একটি কপি শীর্ষ কাগজের হাতে পৌঁছেছে। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিষয়টি তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দলের অপর এক নেতা চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেন।

যদিও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, একজন স্পর্শকাতর মামলার আসামির কারাগার থেকে এ ধরনের চিঠি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বীকার করেন, ২৬ ডিসেম্বর কামারুজ্জামান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দলের নেতাদের কাছে চিঠি পেঁৗছানোর খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যোগাযোগ করলে কারাবন্দি জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহারও দাবি করেন এ ধরনের কোন চিঠি তাদের মাধ্যমে দেয়া হয়নি। 'পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি'- এ শিরোনামে লেখা ওই চিঠিতে কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ৬০ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের আত্মবিশ্লেষণ করে দলের জন্য বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রকাশ করেন।

এসব কর্মপন্থা গ্রহণ করতে নীতি-নির্ধারকদের কাছে তা প্রস্তাবনা আকারে পাঠান। চিঠিতে কামারুজ্জামান বর্তমান পরিস্থিতিকে 'খুব নাজুক' ও জামায়াতের জন্য 'কঠিন চ্যালেঞ্জ' উল্লেখ করে তা মোকাবেলায় তিনটি বিকল্প পথ বাতলে দেন। এক. যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকবো। (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে।

) দুই. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে। তিন. আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো। অর্থাৎ, একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি। বিকল্প তিন অবস্থান উল্লেখ শেষে তিনি লিখেন, 'আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব অাঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা।

একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না। ' চিঠির এক জায়গায় নিজেসহ কারাগারে আটক নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, 'নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না। ' কামারুজ্জামান দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন, 'এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। ' চিঠির শেষ প্রান্তে তিনি লিখেন, "...আমাদের অনেকের তো বয়সও হয়েছে।

সরাসরি আন্দোলনে থাকলেই বা আমরা আর কতটা অবদান রাখতে পারবো? সুতরাং সবাই মিলে দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাঙ্ক্ষিত এবং যুক্তিযুক্ত। ..." চিঠির সূত্রপাত যেভাবে কামারুজ্জামান তার দীর্ঘ চিঠির সূত্রপাত করেন এভাবে- (এক) বাংলাদেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ইতিহাসের একটি কঠিনতম সংকটকাল অতিক্রম করছে। ১৯৭১ সালে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর মাত্র দুই দশকের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার মাত্র নয় বছরের মাথায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্য কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।

অর্ধ শতাব্দীর বেশিকাল যাবত মিসরের ইসলামী আন্দোলন আল ইখওয়ানুল মুসলেমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুড এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধই রয়ে গেছে। তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন অনেকবার নাম পরিবর্তন করে অনেকটা সেক্যুলার আদলে কাজ করছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরও বাস্তব কারণেই এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছে। (দুই) এত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী স্বনামে আবির্ভূত হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হওয়ার পেছনের মূল কৃতিত্ব ওইসব তরুণদের যারা অকপটে ইসলামের জন্য জীবনদান করেছে এবং শাহাদাত বরণ করেছে। শতাধিক শাহাদাতের ঘটনা ইসলামী আন্দোলনকে আধ্যাত্মিক শক্তি যুগিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পর্যায়ে আসার জন্য দ্বিতীয় যে শক্তি তাহলো সারা দেশে জামায়াত ও শিবিরের নিবেদিতপ্রাণ সক্রিয় কর্মীগণ। শুধুমাত্র ইসলামের জন্যই তারা এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এতবড় মুখলেছ কর্মীবাহিনী পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে একটি বিপুল অংশ যাদের সংখ্যা কম করে হলেও ১০ থেকে ১৫% হবে- তারা ইসলামী আন্দোলনের প্রতি সমবেদনা পোষণ করেন। (তিন) কিন্তু বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী তথা বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন যে সংকটের মুখোমুখি তা খুবই ব্যতিক্রমধর্মী।

জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী এবং উপরন্তু দলের বর্তমান নেতৃত্বকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বিশেষ এক পরিস্থিতিতে একটি ইসলামী দল হিসাবে বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে খ-িত করার বিপক্ষে তথা পাকিস্তান নামক দেশটিকে একত্রে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল জামায়াত। তখনকার জামায়াত মনে করতো পাকিস্তান এক রেখে এখানে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব ও পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার অবসান হবে। জামায়াতের আরও আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ আলাদা হলে এখানে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু জামায়াতের এবং আরো যারা পাকিস্তানকে এক রাখার পক্ষে ছিলো তাদের ইচ্ছার বিপরীতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

পাকিস্তানের ৯৫ হাজার সৈন্য ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি জগজিত শিং অরোরার নিকট নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। জামায়াত যদিও বা পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে ছিল তথাপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়। এভাবে কামারুজ্জামান একুশটি প্যারায় জামায়াতের দীর্ঘ রাজনীতির মূল্যায়ন করেন। ১০ নম্বর প্যারায় তিনি লিখেন, "মিডিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে এতটাই সামনে এনেছে যে, আওয়ামী লীগের পক্ষে এই ইস্যুকে পেছনে ঠেলে দেয়ার কোন উপায় নেই। প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেই ফেলেছিলেন যে, বিচার তো জনগণই করে দিয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে।

কিন্তু ভারতীয় লবি, বামপন্থি ধর্মহীন গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুকে এমনভাবে হাইলাইট করেছে যে, সরকার এ ব্যাপারে শীর্ষ মহলের অনাগ্রহ সত্ত্বেও সংসদে প্রস্তাব পাস করা এবং ভারতীয় অর্থে লালিত বিভিন্ন সংস্থার প্রচারণার ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনটি সংশোধন করা, ট্রাইব্যুনালের বিচারক, তদন্ত টিম, প্রসিকিউটর ইত্যাদি নিয়োগ দান এবং সরকারের মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে এই ইস্যুকে এমন পর্যায়ে আনা হয়েছে- যাতে যে কোনভাবেই হোক যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সরকারের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। " এর পরের প্যারায় তিনি লিখেন, "জামায়াতের বর্তমান নেতারা ১৯৭১ সালে ২/৪ জন ছাড়া কেউই জামায়াতের সদস্য ছিলেন না, তারা সশস্ত্র বাহিনীতে ছিলেন না, সরকারে কোন পর্যায়ের দায়িত্বশীল লোক ছিলেন না বা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধেও অংশ নেন নি। এসব বিষয় আওয়ামী লীগ নেতারাও জানেন। কিন্তু রাজনীতি এমনই এক জিনিস ক্ষমতার স্বার্থে অনেক কিছুই করতে হয়। .." মুক্তিযুদ্ধ এখনো জ্বলন্ত ইস্যু কামারুজ্জামান লিখেছেন, জামায়াতের অনেকে মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়টি এক সময় মিটমাট হয়ে যাবে।

কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের দুশমনরা জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও কৌশলে আপাতত সফল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে মিটমাট করতে না পারার কারণে আজ বাস্তবেই মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে আমরা বিচারের কাঠগড়ায়। ' তিনি বলেন, "যেহেতু স্বাধীনতার বিরোধিতা ও যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে সম্ভাবনাময় একটি ইসলামী আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে এবং যেহেতু বিষয়টি আমরা মিটমাট করতে পারিনি অথবা এই রাজনৈতিক বিরোধটি নিরসন করতে পারিনি, যেহেতু আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম এটা এক সময় এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, যেহেতু আমাদের অনেকের চিন্তার গ-ি অতিক্রম করে এটা একটি জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেহেতু সরকারও এ বিষয়ে অবশ্যই একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর এবং যেহেতু কিছু না হলেও দল ও নেতৃত্বের ভাবমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে এবং জনমনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি। আমরা যদি নতুন কর্মকৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হই ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না এবং ইতিহাসের কাছে আমরা দায়ী হয়ে যাবো। " তিনি লিখেন, এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে আমরা আশাবাদ জাগিয়েছিলাম।

আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আমাদের ছাত্র-তরুণদের বিরাট এক কাফেলা জীবন দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, অনেকে তাদের জীবন ও যৌবন এই পথে নিঃশেষ করে দিয়েছে। সুতরাং এক নম্বর যে বিকল্প উল্লেখ করা হয়েছে, সেভাবে হাল ছেড়ে দিলে আমরা অথর্ব প্রমাণিত হবো। তখন সময় চলে যাবে। সুতরাং সময় থাকতেই আমাদের সতর্ক হতে হবে।

তিন নম্বর যে বিকল্পের কথা বলেছি সেটাও সমাধান নয়। শুধু স্থানীয় অধার্মিক শক্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক ধর্মহীন শক্তিও আমাদের জন্য বড় অন্তরায়। তারাও ওঁৎপেতে আছে কিভাবে আমাদের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া যায়। আর এ কারণেই এই বিকল্প পন্থা এখন আমাদের জন্য খুব সহায়ক হবে না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনের দিকটা সামনে রেখেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

নতুন সংগঠনের রূপরেখা উদ্ভূত পরিস্থিতির উল্লেখ করে কামারুজ্জামান জামায়াতকে পেছন থেকে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োজিত করে নতুন প্ল্যাটফরমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। সেই প্ল্যাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। তিনি লিখেন, '... আপাত দৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুঁকি গ্রহণ করা উচিত। ' এ ধরনের একটি সংগঠনের গঠনতন্ত্রের রূপরেখাও দেন তিনি।

এর প্রথমটি হচ্ছে- (এক) বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং সুশাসন কায়েমকে অবলম্বন করতে হবে। একে পার্টির গঠনতন্ত্র এবং মেনিফেস্টোর দৃষ্টান্ত সামনে রেখে দলের গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। তবে তাদের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টোতে অনেক কিছু পনরাবৃত্তি আছে এবং বেশ দীর্ঘও বটে। ওটাকে সংক্ষেপ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সামনে এনে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও চুম্বক বিষয়গুলো সনি্নবেশিত করতে হবে।

জনগণের অতিপ্রয়োজনীয় কিছু ইস্যুকে হাইলাইট করতে হবে। (দুই) ছায়া মন্ত্রিসভা কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। যতটা মন্ত্রণালয় আছে ততটা ডিপার্টমেন্ট করে প্রতি ডিপার্টমেন্টে কমপক্ষে দুইজন সদস্যকে দায়িত্ব দিতে হবে। একজন প্রধান দায়িত্বশীল হবেন এবং অপরজন হবেন তার সহকারী দায়িত্বশীল। এদেরকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি হতে হবে।

এক ব্যক্তিকে একাধিক দায়িত্ব দেয়া পরিহার করতে হবে। (তিন) একটি অভিভাবক পরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। সিনিয়র সিটিজেন, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও প-িত ব্যক্তিবর্গ এর সদস্য থাকবেন। (চার) একটি ওলামা কাউন্সিল বা শরীয়াহ বোর্ড থাকবে। নানা বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালাবে এবং নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হলে তা নিরসন করবেন।

যে কোন মূল্যে ইসলামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। (পাঁচ) তিন টার্মের বেশি কেউ একাধারে কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবে না। পদ পদবি বা দায়িত্বের ব্যাপারে বাংলা পরিভাষাই ব্যবহূত হবে। সংগঠনের সকল পর্যায়ে আইটির (তথ্যপ্রযুক্তি) সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। (ছয়) কেন্দ্রীয় কমিটিতে সকল পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে জনশক্তি পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিবছর কোন ক্ষেত্রে কি পরিমাণ প্রোডাক্ট চাই তা নির্ধারণ করতে হবে। (সাত) একটি সেক্রেটারিয়েট থাকবে- যারা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করবেন না। সমন্বয় করবেন, কিন্তু কোন কিছু চাপিয়ে দেবেন না।

(আট) সকল ডিপার্টমেন্টের কমিটি থাকবে এবং ওইসব কমিটি অনেকটা স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সকল ডিপার্টমেন্ট সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করবে। (নয়) লিগ্যাল এইড কমিটি থাকবে। আইনগত সহযোগিতা ছাড়াও সংগঠনের অভ্যন্তরে কোন সমস্যা দেখা দিলে বা ডিসপিউট হলে এই কমিটি দ্রুততার সঙ্গে তা নিরসন করবে এবং কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সালিশ হিসাবে কাজ করবে। (দশ) অগ্রাধিকার দিতে হবে:- ক) শিক্ষা, খ) সমাজসেবা, গ) স্বাস্থ্য, ঘ) মিডিয়া, ঙ) ব্যবসা-বাণিজ্য ও চ) ছাত্র আন্দোলন।

(এগার) নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য সম্ভাবনাময় লোকদের এখন থেকে তৎপরতা চালাতে হবে। (বার) জেলা পর্যায়ে স্বাধীন পেশা- ব্যবসা, ওকালতি, শিক্ষকতা ইত্যাদির ব্যাপারে লোকদের পরামর্শ দিতে হবে। দায়িত্বশীলদের সামাজিক পরিচিতি থাকতে হবে- শুধুমাত্র দলীয় পরিচিতি নয়। (তের) জামায়াত একটি অবকাঠামো করেই রেখেছে বিশেষ করে অনেকগুলো সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে।

এগুলোকেও যথাযথভাবে গতিশীল করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান ঝিমিয়ে আছে এবং পরিবর্তন অনিবার্য। হেলা পর্যায়েও অনেক ট্রাস্ট ও প্রতিষ্ঠান আছে যা কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। (চৌদ্দ) ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি টিম গঠন করতে হবে ইয়ুথ ডিপার্টমেন্টের অধীনে অথবা ছাত্রদের সহায়তায়। এ জন্য প্রয়োজনে ক্লাব স্থাপন করা যেতে পারে।

(পনের) একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট করা যেতে পারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। স্পোকেন ইংলিশ, আরবি, ফ্রেন্স, জার্মান, ম্যান্ডারিন, জাপানি, কোরিয়ান, বাহাসামালয়া ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করা যেতে পারে। (ষোল) সর্বাবস্থায় ইউনিভার্সিটি অব থাট-এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এটাকে সম্প্রসারিত ও গতিশীল করতে হবে। (সতের) সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।

একাধিক থিংক ট্যাংক গড়ে তুলতে হবে। (আঠার) শিশু কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বর্তমান কাঠামো রেখেই আরো গতিশীল ও সম্প্রসারিত করতে হবে। নারী সমাজের উন্নয়ন, মানবাধিকার সংরক্ষণ ও পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সুস্পষ্ট কার্যক্রম থাকতে হবে। (উনিশ) অমুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সামাজিক ও একটি ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য কিছু লোককে নিবেদিত প্রাণ হয়ে ওই সেক্টরে কাজ করতে হবে।

উপজাতীয়দের মধ্যে কিছু লোক নিয়োজিত করতে হবে। (বিশ) তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের মধ্যে এবং ব্যবস্থাপনায় জরুরি ভিত্তিতে একটি সেল করে কাজ করতে হবে। এখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাল কর্মসংস্থান হতে পারে- তার সুযোগ নিতে হবে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন হিসাবে বিবেচিত হবে এবং ভূমিকা পালন করবে। ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা খুব সহজ।

কিন্তু আমরা কোন মনোযোগ দেইনি। (একুশ) আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন চালু করার প্রশ্নে জনমত গঠন করা উচিত। বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে সরকারের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি। সাড়ে ষোল কোটি মানুষের দেশে সবকিছু রাজধানীমুখী- যা আন ম্যানেজেবল। সামাজিক শক্তি অর্জন করতে হবে।

প্রচারমুখিতার পরিবর্তে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও বিভিন্ন স্তরের চালিকা শক্তির ওপর আদর্শিক ও নৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে হবে। রাজনীতি প্রবণতার পরিবর্তে আন্দোলনের প্রকৃতি হতে হবে সামাজিক ধাঁচের এবং মানব কল্যাণধর্মী। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই নতুন কর্মকৌশল গ্রহণের ব্যাপারে জনশক্তির কাছে আলোচনা ও মতবিনিময় হওয়া উচিত। জামায়াতের যতো সংস্কার কামারুজ্জামান লিখেন, জামায়াতের যত বদনামই ধর্মহীন শক্তি করুক না কেন, জামায়াতকে অগ্রাহ্য করে কোন কিছু করা সঠিক হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশল অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত জামায়াতকেই নিতে হবে।

তবে চিন্তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৪১ সালে পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে উঠে, লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি স্বাধীন আবাসভূমির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার- সেই সময় নতুন একটি দল জামায়াত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে কয়েকটি আঞ্চলিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিভক্ত ভারতে জামায়াতের কর্মপন্থা কি হবে সে ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই কিছুসংখ্যক সদস্যসহ পাকিস্তানে চলে আসলেও জামায়াতের একটি বড় অংশ ভারতেই থেকে যান। তারা সেখানে এক ধরনের কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে যান।

কিন্তু পাকিস্তান জামায়াত তার কর্মসূচিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। জামায়াত রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ, জামায়াতের কর্মপন্থায় বিরাট পরিবর্তন আনা হয়। বাংলাদেশে জামায়াতের নানা সংস্কারের বর্ণনা করে তিনি লিখেন, এক সময় জামায়াত আইনজীবীদের সদস্য করতো না। কিন্তু কৌশল বদলানো হয় এবং বাস্তবতার দাবি মেনে নিয়েই আইনজীবীদের দলের সদস্য করা হয়।

প্রচলিত নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতো না, এমনকি ভোটও দিত না। ভারতীয় জামায়াত এখনো নির্বাচনে অংশ নেয় না। শুধুমাত্র ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষিতে জামায়াতের সদস্যদের ভোট দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কাশ্মীর জামায়াত হিন্দুস্থান জামায়াত থেকে আলাদা অর্থাৎ, স্বাধীন জামায়াত হওয়ায় তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, এক সময় জামায়াত রুকন ছাড়া কাউকে নির্বাচনে মনোনয়ন দিত না।

এখন এই নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং রুকন ছাড়াও এখন মনোনয়ন দেয়া হয়। মহিলাদের সংসদে পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছে। এমনকি নির্বাচনে মহিলাদেরও মনোনয়ন দান করা হয়েছে। বিগত উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের ২৪ জন মহিলা প্রার্থী ছিল, এর মধ্যে ১২ জন নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জামায়াত নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে প্রার্থীর ছবি ব্যবহার করতো না।

এখন ছবি ব্যবহার করছে। গঠনতন্ত্র সংশোধন করে অমুসলিমদের জামায়াতের সদস্য হবার পথে বাধা দূর করা হয়েছে। এখন একজন অমুসলিমও চাইলে জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন। জামায়াতের মহিলা সদস্যদের মজলিসে শূরার সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। এ সবই করা হয়েছে প্রয়োজনে, সময়ের দাবি এবং বাস্তবতার আলোকেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

ট্রাইব্যুনালে ন্যায় বিচার পাবো না কামারুজ্জামান চিঠিতে স্পষ্টই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তারা ন্যায় বিচার পাবেন না। 'ক্ষমতার রাজনীতি, ধর্মহীনতার রাজনীতির মিথ্যা অভিযোগের নির্মম শিকার হয়ে আমার বন্দি জীবনের অনুভূতি সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করছি'- উপশিরোনামে তিনি এ বিষয়ে এগারটি কারণ উল্লেখ করেন। এক. বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে আমাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। সহসা সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। দুই. আন্দোলন করে আমাদের মুক্ত করা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।

আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটার কোনো আশঙ্কাও নেই, পুরো মেয়াদ পর্যন্তই সরকার ক্ষমতায় থাকবে। তিন. বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই আমাদের কিছু সংখ্যকের বিচারের নামে প্রহসন হবে। কারণ, ইস্যুটাকে এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। চার. তথাকথিত ট্রাইব্যুনালের কাছে কোনো ন্যায় বিচার আমরা পাবো না। আইনটা একটা কালো আইন হওয়ার কারণে সরকার যা চাইবে তাই করা বা তাদের কাঙ্ক্ষিত রায় দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

পাঁচ. জামায়াতের ওপর এবং জামায়াতের নেতা হিসাবে আমাদের ওপর সুস্পষ্ট জুলুম হচ্ছে এ জন্য অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা করলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কার্যকরভাবে আমাদের তথা জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না। ছয়. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিচার কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মৌখিক সৌজন্য প্রকাশ করলেও একটি ইসলামী দলের নেতাদের শাস্তি হলে (তা যতো অন্যায়ই হোক না কেন) ভিতরে ভিতরে তারা অখুশি হবে না। সাত. জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। দেশের ভেতর ও বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধীদের দল হিসেবে চিত্রিত করবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।

জামায়াতের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আট. জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও সরকার জামায়াতকে স্বস্তির সঙ্গে কোনো কাজ করতে দেবে না। সর্বদা চাপের মুখে রাখবে। নয়. এহেন পরিস্থিতিতে জামায়াতের পক্ষে গণসংগঠনে পরিণত হওয়া বা নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন লাভের যোগ্যতা অর্জন কখনো সম্ভব হবে না। দশ. বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে যে নির্বাচন হবে তাতেও জামায়াত ভাল করতে পারবে- এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।

এগার. জামায়াতের প্রতি আমাদের যে আবেগ, ভালবাসা তাতে জামায়াত ছাড়া আমরা অন্যকিছু ভাবতেও পারি না। জামায়াতকে উপেক্ষা করে কিছু করতে গেলে ভুল বোঝাবুঝি অনিবার্য এবং কিছু করলেও তা সফল ও জনশক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মৃত্যুদ-ের আশঙ্কা, যুদ্ধাপরাধীদের দল হবে জামায়াত চিঠিতে কামারুজ্জামান বর্তমান সরকারের মেয়াদে তাদের মৃত্যুদ-, জামায়াতের সম্ভাবনাময় নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য এবং তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তার ভাষায়, 'সরকারের আরো তিনবছর সময় আছে। এই সময়ের মধ্যেই যে কোনভাবে প্রহসনের বিচার করে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে পারে।

জামায়াতের কর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্য মৃত্যুদ-ও দিতে পারে এবং অনেককে যাবজ্জীবন কারাদ-ও দিতে পারে। আবার সম্ভাবনাময় জামায়াত নেতাদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ভাবমর্যাদা খতম করে নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াতকে একটি অকার্যকর দলে পরিণত করতে পারে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলে এবং বঙ্গবন্ধু যেহেতু ক্ষমা করেছিলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমা করতে জানে বলে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমা করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারে।

জামায়াতকে বিএনপি জোট ত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে পারে এবং এর বিনিময়ে বিচারের বিষয়টি শিথিল করার প্রস্তাব দিতে পারে। তার মূল্যায়ন, 'যেভাবেই উপসংহার টানা হোক না কেন তাতে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই মিডিয়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে তাহলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে দেশে-বিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে। ' আমাদের ভবিষ্যত কি? উপরোলি্লখিত অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে চিঠিতে কামারুজ্জামান নিজেই প্রশ্ন করেন, 'এই জায়গায় এসে আমরা থমকে দাঁড়িয়েছি।

প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত কি?' এরপর তিনি লিখেন- এক) যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকবো। (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে। ) দুই) পরবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।

তিন) আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো। অর্থাৎ, একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি। বিকল্প তিন অবস্থান উল্লেখ শেষে তিনি লিখেন, 'আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব অাঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না। ' উপরোলি্লখিত তিনটি বিষয়ে কামারুজ্জামান সংক্ষেপে নিজের ব্যাখ্যাও দেন।

তিনি বলেন, তৃতীয় যে পন্থা নতুন নেতৃত্বের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার কথা বিবেচনা করা যেতো যদি একাত্তর সালের বিষয়টার একটা রাজনৈতিক মীমাংসা বা মিটমাট আমরা করতে পারতাম। জামায়াতের ভাবমর্যাদা যেভাবে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, জামায়াত সম্পর্কে যে এলার্জি তৈরি করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তক, মিডিয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় যেভাবে জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বাংলাদেশ বিরোধী দল হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে তাতে নতুন নেতৃত্ব হলেও দেশের সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্ম এবং রাজনৈতিক মহল জামায়াতকে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারবে না। দ্বিতীয় যে পন্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আমার মনে সামগ্রিক বিবেচনায় এই বিকল্প পন্থাটির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইসলামী আন্দোলন এই কৌশল অবলম্বন করে ভাল ফল লাভ করেছে। কামারুজ্জামান চিঠিতে তুরস্ক, মিশর, আলজেরিয়া, সুদান, ইয়ামেন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও জর্দানের নাম উল্লেখ করে লিখেন এসব দেশে ইসলামী আন্দোলন কৌশল পাল্টিয়ে ভাল ফল পেয়েছে।

তবে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন ওইসব দেশ থেকে বেশ ব্যতিক্রম বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি লিখেন, 'পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করার মতো অতি স্পর্শকাতর কোনো অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে। ' প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে বিরোধিতা করেছিল- কামারুজ্জামান চিঠিতে তা অকপটে স্বীকার করেছেন। তবে তার দাবি, "আমরা ১৯৭১ সালে জামায়াতের নেতৃত্ব দেইনি।

নেতৃত্ব দেয়াতো দূরের কথা- জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও তখনকার দলীয় নেতারাও যুদ্ধে শরিক ছিলেন না। আমাদের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা কেউই যুদ্ধ করিনি, বা কোনো বাহিনীর সদস্যও ছিলাম না। আমাদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ বা লুটতরাজের প্রশ্নই ওঠে না। আজ রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার কারণেই রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার শিকার আমরা বা জামায়াত। আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সাজানো এবং সর্বৈব মিথ্যা।

" চিঠির শেষ অংশে তিনি লিখেন, আমাদেরকে নিয়ে সরকার ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালাম- যাতে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ না থাকে। এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। দোয়া করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতালা আমাদেরকে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তওফিক দান করুন। আমিন! জনশক্তি বিকল্প পথের সন্ধান করছে কামারুজ্জামান বলেন, একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সার্বিক প্রয়াস চালানো দরকার।

জামায়াত আমাদেরকে অসাধারণ শৃঙ্খলা শিক্ষা দিয়েছে সেই সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের থাকতে হবে। শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে সংগঠনের অভ্যন্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। জনশক্তি বিকল্প পথের সন্ধান করছে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে নতুন চিন্তাধারাকে দারুণভাবে অভিনন্দন জানাবে। দূরের চিন্তা যারা করেন না, কিংবা স্থিতাবস্থা বজায় রাখাটাই যারা ভাল মনে করেন; তারা হয়তোবা বিরোধিতা করতে পারেন।

তবে তাদেরও আন্তরিকতার অভাব নেই। ধৈর্য্যের সঙ্গে সবাইকে বুঝাতে হবে এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে অথবা কমপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ইতিহাসের এই সংকট সন্ধিক্ষণে আন্দোলনের জন্য নতুন কৌশল নির্ধারণ এক ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। আমি বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন। কামারুজ্জামানের লেখা চিঠি নিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা মুখ খুলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকার চেষ্টা করেও অন্য কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শুধুমাত্র জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, 'এত বড় চিঠি কারাগার থেকে আসলো কি করে?' তিনি বলেন, 'কারাগারে যারা আছেন, তারা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.