আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্মই আমার আজন্ম পাপ....... কবি দাউদ হায়দার , কবিতা লিখে যিনি আজও নির্বাসিত

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই , পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই কবিতা লেখার অপরাধে চারটি দশক তাকে আটকে রাখা হয়েছে স্মৃতির কারাগারে। যে দেশে অজস্র যুদ্ধ অপরাধী দম্ভের পতাকা উড়িয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে ছাপ্পান্ন হাজার, সেখানে কবিতা লেখার অপরাধে একজন কবি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরতে পারেন না- বড়জোর প্লেনের জানালা দিয়ে একনজর দেখতে পারেন ফালি ফালি শষ্যক্ষেত, মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করে হয়তো 'ওইখানে পাবনা- ওইখানে ইছামতী'! দেশের যদি হাত থাকতো, দুহাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিতো। কিন্তু দেশ তো শাসনের ম্যান্ডেট, ক্ষমতার আস্ফালন, কট্টর প্রতিক্রিয়াশীলতার দোর্দন্ড প্রতাপ, দেশতো ব্লাসফেমী- কবিতা লেখার অপরাধে মাথা কেটে নেবার ফতোয়া। বাংলাদেশের এই একজন কবিই আছেন যিনি কবিতা লেখার অপরাধে নির্বাসিত। জার্মানীতে কী নেই- সব আছে।

কিন্তু কোথায় দাউদ হায়দারের ইছামতী নদী!একটি কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন অগ্রসর ভাবনার কবি দাউদ হায়দার। দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন সত্তর দশকের শুরুর দিকে। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোন এক কবিতাকে “দ্যা বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া” সম্মানে ভুষিত করেছিল। সংবাদের সাহিত্যপাতায় 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন । ধারণা করা হয়ে থাকে, তিনি ঐ কবিতাতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ), যিশুখ্রীষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধকে অপমান করেছিলেন ।

তাঁর সংগস অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সংকলিত আছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদ শুরু করে এবং ঢাকার কোন এক কলেজের শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন ’৭৪-এর ২২ মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে কলকাতাগামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। কবির নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন ছিল মুজিব সরকার। ’৭৬-এ দাউদ হায়দার তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে জমা দিলে তা আটক করা হয়।

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও। পাসপোর্ট ছাড়া অন্য আরেকটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে সমস্যা দেখা দেয়। ভারত সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না নির্বাসিত কবির। তিনি অন্য কোনো দেশেও যেতে পারেন না পাসপোর্টের অভাবে।

এমন এক দুঃখকালে তার পাশে এসে দাঁড়ান কবিবন্ধু নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ’৮৫-এর কোনো এক ভোরে জার্মানির বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান দাউদ হায়দার। জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে এখন ঘুরছেন দেশান্তরে। কোনো পাসপোর্ট নেই তার।

জার্মানি যাওয়ার পর থেকে তিনি সেখানের ‘ডয়েচে ভেলে’ রেডিও চ্যানেলের প্রভাবশালী সাংবাদিক। জন্মই আমার আজন্ম পাপ “জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই পালাই পালাই সুদূরে চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী নতুন মডেলের চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো ভাংগাচোরা চেহারার হদিস ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল- অর্থাৎ আমার নিবাস। ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না সন্তান সন্তুতি পঙ্গু পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও- আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব। নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ- যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।

শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি- জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায় কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার যারা আমাকে অপারেশন করবে? পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়ি টাকায় একসের চাল ও অন্যান্য সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো? আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি ঘৃণা আমি পাপী এরা কেন জন্ম নেয়? এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ। মরণ এসে নিয়ে যাক, নিয়ে যাক লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর? -বলে প্রাসাদ প্রেমিকেরা আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ আহা দুঃখ দুঃখরে! আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ। ২২ বছর বয়সী তরুণ এক কবি বুকে প্রচণ্ড অভিমান আর প্রবল রক্তক্ষরণ নিয়ে ছেড়েছিলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় জনপদ। ৪০বছরে এক মুহূর্তের জন্যও পা ছোঁয়াতে পারেননি জšে§র মাটির ওপর। দেশে ফেরার জন্য নিয়ত পড়ছে চোখের জল।

একটি কবিতায় ফুটে ওঠে তারই কথা তোমার কথা / দাউদ হায়দার মাঝে মাঝে তোমার কথা ভাবি আকাশে জমেছে মেঘ, বাতাসে বৃষ্টির গান রাত্তির বড় দীর্ঘ; কিছুতেই ঘুম আর আসছে না । একবার এপাশ, একবার ওপাশ, আর বিশ্বচরাচর জুড়ে… নিথির স্তব্ধতা । মাঝে মাঝে মনে হয় অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই । মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার বাংলাদেশে ঘুরে আসি । মনে হয়,মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে চিতকার ক’রে আকাশ ফাটিয়ে বলি; দ্যাখো, সীমান্তে ওইপাশে আমার ঘর এইখানে আমি একা, ভীনদেশী ।

২৫। ১০। ১৯৮৩  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.