আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার জন্মই হইয়াছে এসব কমিটির সদস্য হইবার জন্য!



এ বছরের প্রথম দিকে পরিচয় হয় ফিলিপাইনের এক তরুণীর সাথে। আমার ভাব-ঢং দেখে তরুণী প্রথমে আমাকে ভারতীয় বলে ধরে নেন এবং নিজেই আসেন আমার সাথে পরিচিত হতে। ভারতীয় নয়, আমি বাংলাদেশী; এ কথা বলার সাথেই সেই তরুণীর চোখের আগ্রহ যেন আরো খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে আসে। এবার তিনি নিজেই বলা শুরু করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়, বাগেরহাট? নীলফামারি? টাঙ্গাইল? কুমিল্লা? আমি তাকে বললাম, না, আমি এসব কোথাকার নই; কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে তুমি আমাদের দেশের অনেক জায়গা চেন, নাম বলতে পার। এবার তরুণীটি বোধহয় আর উত্তেজনা থামাতে পারলেন না।

সহাস্যে আমার বাহুতে তার ডানহাত চালালেন। আর উচ্চস্বরে বলতে থাকলেন, তোমার বাড়ি নিশ্চয়ই নোয়াখালী ! তুমি নোয়াখালী থেকে এসেছ। এতদূর দেশে কারো মুখে নিজের জেলার কথা শুনতে কার না ভালো লাগে? তারপরে যদি আবার ‘অন্যএক’ হন নারী তাহলে তো আর কথাই নাই। তরুণীর নাম ‘চিকে’, তিনি তথ্য-প্রযুক্তি কিভাবে নারীদের উন্নয়ন করতে পারে সে বিষয়ে কাজ করছেন। যাই হোক ঐ তরুণী আমাদের আজকের বিষয় নয়, বিষয় নোয়াখালী।

নোয়াখালী দেশের সবচেয়ে পুরানো জেলাগুলোর একটি। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সবক্ষেত্রেই এ জেলার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দরিয়ার কূলে অবস্থানের কারণে একসময়ে নোয়াখালী কেবলমাত্র ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে সীমিত থাকলেও আজকের প্রেক্ষাপটে সে জায়গাটির অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। সভ্যতা নিয়তই মানুষকে সৃষ্টিশীল করে তুলছে। দুনিয়াজোড়া মানুষ সকলেই তাদের সামর্থ্য ও সাধ্যমাফিক এখানে কন্টিবিউট করার চেষ্টা করে।

প্রকারান্তে তারা নিজেরাই এ সভ্যতার স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু যদি প্রশ্ন আসে আমার প্রতি আমরা এ সভ্যতায় কতখানি শরিক হয়েছি? কতখানি আমি দিয়েছি কিংবা কতখানি বাদ রেখেছি নেয়া থেকে? আমার কাছে কোন জবাব নাই। এতসময় আমরা পার করে এলাম কিন্তু আমরা আজে একটি পরিকল্পিত শহর তৈরি করতে পারিনি। আমাদের একখানা শহর আছে কিন্তু তার কোন অলংকার নাই। বাচ্ছারা অভিযোগ করে আমরা তাদের বিনোদনের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করি।

কিন্তু আমরা জবাব দিতে পারি না। অবশ্য আমাদের নেতারা এ প্রশ্নের জবাব আমাদের সাথে সাথে দিয়ে দেন। শিশুপার্কের জন্য প্রকল্প তৈরি হয়েছে, টাকা আছে, আগামি মে (!) মাসের মধ্যে শিশুপার্ক হয়ে যাবে। আমরা আমজনতা খুশী হয়ে হাততালি দিতে দিতে বাসায় ফিরি। বিশ্বকাপ জেতার মত একখানা ভাব নিয়ে বাচ্ছাদের বলি, পার্ক হয়ে যাবে- নেতাজী বলেছেন।

কিন্তু মে মাস আসে, মে মাস যায় কিন্তু পার্ক তৈরি হয় না। ছেলে আমার শিশু থেকে বুড়ো হয়ে যায়-তবু পার্ক তৈরি হয়। তার একদিন ভিসিডিতে হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে বাচ্ছা আমার বলেই ফেলে, বাবা তোমরা সব মিথ্যুক। আমি কোন জবাব দিতে পারি না। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি।

ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আল্লাহকে বলি, ‘মাবুদ আমার-আমাদের নেতারা যেন তাদের সন্তানদের সাথে সত্যি কথা বলতে পারে তার তওফিক দিও’। শহরে বেশ কয়টি প্রতিষ্ঠান আছেন। জনগণের জন্য এ সকল প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও কালের-কাওচালিতে এসকল প্রতিষ্ঠান নেতাদের ব্যক্তিগত দোকানপাটে পরিণত হয়েছে। জেলার অনেক পুরানো একটি জনপ্রতিষ্ঠান- নোয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি। অনেক গড়াগড়ি পর অবশেষে এসে টাউন হলের পাশে মাথা গেঁড়েছে।

কিন্তু পাঠক, ব্যবস্থাপনা আর জনঅংশগ্রহণের দিক থেকে তাথৈইবচ একখানা অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতবিশাল সংগ্রহশালা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকলেও বেঁচে আছে মৃতপ্রায় অবস্থায়। পাশেই আছে নোয়াখালী টাউন হল। কিন্তু এত এত গরিমাময় এ প্রতিষ্ঠানটি অবস্থা খুবই নাজুক, হতশ্রী। ফোটাকয়েক বৃষ্টিতে টাউন হল নামক ঘরখানার সামনে একহাটু পানি জমে থাকে।

কিন্তু টপকে যেতে পারলেই সারে, কোণার রুমখানা একেবারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। হরতন, ইসকা যাই চালান সমস্যা নেই। শুধু সমস্যা আমজনতা, সমস্যা সমাজ-সচেতন নাগরিকদের। একটি ভালো সভা, চর্চা, স্টাডি সার্কেলে বসতে চাইলেও সে জায়গাখানি এশহরে পাওয়া খুবই দুষ্কর। জানা মতে টাউন হল পরিচালনার জন্য একখানা কমিটিও আছে।

কিন্তু তারা কোথায় কিংবা টাউন হলের উদ্দেশ্য কি অথবা এ ঘরখানা দিয়ে আগামিতে কী হবে তার কোন ভাবনা হয়ত তাদের মধ্যে নেই। শেষবার মেসবাহ ভাইয়ের স্মরণ সভায় গিয়ে টাউন হলের মঞ্চের পেছনে একখানা কালো পর্দা দেখেছিলাম। ঠিক কবে এ পর্দাটি লাগানো হয়েছিল তা জানার কোন উপায় না থাকলেও ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ছেঁড়া পর্দাখানা দেখে যে কেউ এটা অন্তত: বুঝতে বাকি থাকবে যে কর্তৃপক্ষ এ হলটির বিষয়ে আসলেই কতখানি উদাসিন। ছেঁড়া পর্দাটি বারবার উড়তে দেখে মনে হচ্ছিল ঈশ্বর যদি আমাদের বিবেকের সামনে ঝুলে থাকা পর্দাটি ছিঁড়ে দিতেন তাহলে হয়ত আমাদের আগামি দিন আরো সুন্দর হত। আমরা হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গাগুলোর একটির বাসিন্দা এ ভেবে পুলকিত হতে পারতাম।

শহরে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, রাষ্ট্র এসকল প্রতিষ্ঠানকে এক ধরণের ‘জনসভা’ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তাও করেছে। কেউ গড়ে উঠেছেন পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে, কেউ সংস্কৃতির নেকাবে, কেউবা ‘জনমিলনের’ জন্য। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে কালে-ভদ্রে এ সকল প্রতিষ্ঠান দু’চার জন আমজনতাকে কাতারে সামিল করলেও পরবর্তীতে সেসকল প্রতিষ্ঠানের শরীরময় একখানা স্বেচ্ছাচারিতার উর্দি গেঁড়ে বসেছে। ফলে এসকল প্রতিষ্ঠান সামাজিক কারণে গড়ে উঠলেও সেখানে সমাজের আর দশজনের কোন অংশদারিত্ব থাকেনি। সমাজের বদলে প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যক্তি, পরিষদের কিংবা হাতেগোনা সদস্যদের ‘ব্যক্তিগত সাদৃশ্য’ সম্পদে পরিণত হয়েছে।

সমাজ কী সভ্যতা তৈরি করে নাকি সভ্যতাই নতুন নতুন সমাজ তৈরি করে, এটি আমার কাছে একটি জটিল ও গাণিতিক প্রশ্ন। কিন্তু একটি আদর্শিক, দেশপ্রেমিক, জবাবদিহিমূলক সমাজ তৈরি করতে হলে অবশ্যই সমাজের প্রত্যেকটি চোখকে সমানভাবে কাজ করা জরুরি। একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের দায়িত্ব-সম্পর্ক জোরদার ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য এসকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে/ গড়তে সহায়তা করে এবং জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের শর্তপূরণে চাপ তৈরি করে। নৈতিকভাবে এসকল প্রতিষ্ঠান জন-অধিপরামর্শক হিসেবে রাষ্ট্রকে অবহিত করে এবং কিন্তু এসকল প্রতিষ্ঠান যদি পরবর্তীতে তাদের এ জায়গা থেকে সরে আসে তাহলে সমাজ কাঠামোয় ‘বিকলাঙ্গতা’ তৈরি হয়। তাই এ সকল প্রতিষ্ঠানকে সরব হওয়া এবং একই সাথে কার্যকরী করে তোলা জরুরি।

প্রয়োজনে রাষ্ট্র নিজেই সক্রিয়তা উদ্যোগে অনুঘটকের ভূমিকায় আসতে পারে। রাষ্ট্রের মূল¯িপ্রট থেকে এটাই সত্য সবার ওপর জনগণ সত্য এবং জনগণকে রাষ্ট্রই সবোর্চ্চ সহায়তা করতে পারে। দিন কয়েক আগে প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে হেঁটে আসছিলাম, সাথে আরো অনেকেই আছেন- যারা প্রায় সকলেই সকলেই উনার ছাত্র ছিলেন। কতদূর হাঁটার পর স্যার হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। বেশ হতাশা আর আবদারের সুর স্যার তাঁর প্রিয় ছাত্রদের বললেন-এই শহরে কী আমরা কোথায়ও একটু বসার জায়গা পাবো না? সবাই মিলে বসবে, আড্ডা দিবে, শহরের সুন্দর আর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবে।

স্যারকে আমরা কোন কথা দিতে পারিনি কিন্তু আমরা সবাই অনুধারণ করেছি এতটুকু জায়গা নিশ্চয়ই দরকার। দরকার এ কারণে কেননা আমাদের প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের দূরত্ব কমাতে হবে, আমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে ফেরি করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের সাথে। প্রিয় মাইজদী’র সকল সমস্যাই কমে যাবে যদি আমরা শহরের সকল প্রতিষ্ঠান সমূহকে তাদের লক্ষ্য মোতাবেক সচল করতে পারি। আগামি দিনের নোয়াখালী শহরটা আরো সুন্দর হবে। দুনিয়াজোড়া মানুষ আমাদের চিনবে এটাই হোক আমাদের প্রেরণা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.