রণেশ মৈত্র
গত ১১ অক্টোবর এক বিশাল রোডমার্চ করে ঢাকা থেকে সিলেট গেলেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর তিনি রাজশাহী বিভাগ অভিমুখেও রোডমার্চ করেছেন। যাত্রাপথে রোডমার্চের গাড়ি বহর থেকে নেমে অনেকগুলো পূর্বনির্ধারিত স্থানে পথসভা-জনসভা করেছেন। সর্বত্রই জমায়েত হয়েছে বিপুল-বিশাল। গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এ একটি দুর্ভাবনার বিষয়।
মানুষ যে গভীর আগ্রহ নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনতে এসেছে এবং অনেকেই যে তার বক্তব্যকে সমর্থন করেছে- তাও ধরে নেওয়া যায়। যদিও পুরো বক্তব্যকে সামনে ধরলে লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে। আগামী দিনগুলোর জন্য এক উদ্বেগজনক চিত্রই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাই সিলেট রোডমার্চের সময় দেওয়া তার বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়েই এ নিবন্ধটি লিখতে বসতে হলো। লেখার জন্য আমার একজন চেকোশ্লোভাকিয়া প্রবাসী শুভাকাক্সক্ষীর অনুরোধও আমাকে লেখাটি লিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বেগম খালেদা জিয়া সাধারণ মানুষ নন। কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন সুপরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিকে তিনি সামরিক বাহিনীর নামে করে গেছেন কলুষিত। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, 'I will make polities difficult for the politicians.' এবং সত্যিই তিনি তা করে গেছেন। নানা প্রলোভন দেখিয়ে এ দল সে দল থেকে আদর্শ ও নৈতিকতাবর্জিত বেশকিছু নেতাকর্মী সমবায়ে 'জাগদল' নামে প্রথমে তিনি একটা খিচুরি মার্কা দল গড়ে তোলেন।
পরবর্তীতে সেই দলকে আরও পুষ্ট করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। একেবারেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেওয়া এ দলটির কার্যকলাপ খুব বেশিদিন চালানোর সুযোগ পাননি দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে নিহত হন তিনি। এ হত্যালীলার বিচার বিএনপি দফায় দফায় ক্ষমতায় এলেও করেনি। বিষয়টি অবশ্যই রহস্যাবৃত।
বেগম জিয়া, তার স্বামীর গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন স্তাবক-নেতাদের অনুরোধে। আশির দশকে বিএনপির নেতৃত্বভার গ্রহণ করে সেই থেকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। দলীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়নি- মূলত দল স ষ্টার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। রাজনীতিতে বেগম জিয়ার অনেক সাফল্য থাকলেও তার দু'পুত্রের কারণে সে সাফল্য অনেকখানি ম্লান হয়েছে। মায়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ নিয়ে তারা যে দুর্নীতি ও যথেচ্ছতায় জড়িয়ে পড়েন তা দুর্ভাগ্যজনক।
জ্যেষ্ঠপুত্রের কার্যালয় বলে পরিচিত হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির যে প্রসার ঘটেছে তা সারাবিশ্বে চরমভাবে নিন্দিত হয়েছে। দেশ ও দলকে তারা যেভাবে লুটপাটের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছেন তা আজ এক কলঙ্কিত ইতিহাস। মা হয়ে সন্তানের এ দুর্নীতিমূলক ক্রিয়াকলাপের প্রতি সমর্থন জানানোই শুধু নয়, তাদের জন্য মনে মনে গর্বিত বোধ করা এমনটিও দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়।
তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বারকয়েক উকিল নোটিসের পরও তিনি ছাড়েননি বরং নোটিসগুলো বেআইনি ঘোষণার দাবিতে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে তাতে যখন হেরে গেলেন এবং বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন তখন দেখা গেল ওই বাড়িতে তিনি বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। অর্ধডজন নারীকর্মিসহ অর্ধশতাধিক চাকর-চাকরানী-ছিল ওই বাড়িতে যা সামন্ত প্রভূদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বেগম জিয়ার ব্যক্তিজীবনের এ দিকগুলো অবশ্য আমার মূল আলোচ্য বিষয় নয়। তার রোডমার্চ ও সিলেটের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণ নিয়ে লেখার কাজে এখন ফিরে আসি।
দুর্নীতি আজ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বন্ধ। এ সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংকের।
অন্য দাতাসংস্থাও এই সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে- এমনটা ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। দেশেও আন্দোলন চলছে দুর্নীতির কারণে, অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রীর আশু পদত্যাগ বা পদচ্যুতির দাবিতে। তেমনই অসংখ্য অভিযোগ বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের বিরুদ্ধে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে তার নীরব, নিস্পৃহ ভূমিকার জন্য। কিন্তু সরকারি দলের দুর্নীতি যেমন নিন্দার্হ তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দুই খ্যাতিমান পুত্র তারেক-কোকোর দুর্নীতির বিচার তিনি চাইছেন না কেন? নিজের সন্তান বলে? সেটা কি স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি বলে অভিহিত হবে না? এ বিষয়টি তিনি কি তার আগামী সভাগুলোতে স্পষ্ট করে বলবেন- চাইবেন দুর্নীতিবাজ বিদেশি টাকা পাচারকারী, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী লালনকারী তারেক-কোকোর কঠোরতম শাস্তি? সেক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন অর্জনে সক্ষম হবেন।
দ্রব্যমূল্য এবং অপরাপর ক্ষেত্রেও বেগম জিয়ার শাসনামলও জনগণের জন্য সুখপ্রদ ছিল না। তা বুঝলে তারই মঙ্গল হবে। কিন্তু সিলেটের বিশাল জনসভায় তিনি এগুলোকে আড়াল করে একতরফাভাবে সরকার ও সরকারি দলকে আক্রমণ করেছেন- যা সুধীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা হতাশ হয়েছেন।
তিস্তার জলবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তিনি সরকারি ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন।
এ অভিযোগ আদৌ ধোপে টেকে না। কারণ খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জির ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিস্তা-চুক্তির সবকিছু চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও স্বাক্ষর করতে না পারার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ খবর, এত বেশি আলোচিত যে, বেগম জিয়ার এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত বক্তব্য নেহাতই সবার কাছে 'ফালতু কথা'র মতো মর্যাদা পাবে।
ভারতের কোনো কোনো ভূমিকার সমালোচনা এক জিনিস আর উগ্র ভারত বিরোধিতা ভিন্ন জিনিস। দুর্ভাগ্যজনক যে, বেগম জিয়া সশরীরে মুক্তিযুদ্ধ দেখার সুযোগ পাননি।
তাই ভারতের ভূমিকা তার প্রত্যক্ষ জ্ঞানে থাকার কথা নয়। তাই তিনি জামায়াতের মতো উগ্র ভারতবিরোধী হতে পেরেছেন আর তার দ্বারা তিনি তার, তার দলের এবং বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতিও সাধন করতে পুনরায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। তিনি নিয়েছেন উগ্র সাম্প্রদায়িক ভূমিকাও। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্গা মন্দিরে দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমা দর্শনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়ে সৌজন্যমূলক এবং শ্রদ্ধাসূচক যে কথা বলেছেন- তার সমালোচনায় বিদ্রুপাত্মকভাবে বেগম জিয়া শেখ হাসিনার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কোনো সভ্য দেশের নেতা-নেত্রীর জন্যে অশোভন।
মনে পড়ে অতীতের এক নির্বাচনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে মসজিদ থাকবে না সেখানে উলুধ্বনি দেওয়া হবে। এমন চরম সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তৃতা তার কণ্ঠে শোভা পায় কি?
মনে পড়ে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহের কথা। বিএনপি- জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যে ভয়াবহ তাণ্ডব ঘটিয়েছিল তা দুর্ভাগ্যজনক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি-সম্পত্তি লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা প্রভৃতি নির্মম ঘটনা- প্রতিমা ভাঙা, মন্দিরে অগি্নসংযোগ ইত্যাদি আমাদের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। কৈ, বেগম জিয়া অতীতের অনেক ঘটনার বিচার চাইলেও এই ভয়াবহ ঘটনার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা- তার উল্লেখ মাত্রও করলেন না।
অপরপক্ষে এ ঘটনার তদন্তের জন্য বর্তমান সরকার একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। প্রায় বছরখানেক আগে কমিশন তার প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সরকার এ পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশও করেনি বা দোষীদের বিচারের কোনো ব্যবস্থাও করছে না। বিরোধীদলীয় নেতা এ ব্যাপারে তো সরকারের সমালোচনা করতে পারতেন- তা না করে নীরব থাকলেন। অর্থ কি এই নয় যে, বিচার তিনি বা তার দলও আদৌ চান না? এরপরও তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে উল্লেখ করে বলেছেন, তারা যেন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে তার দলকে ভোট দেন।
বলেছেন, আওয়ামী লীগ হিন্দুদেরকে কিছু দেয়নি- দেবেও না। বিএনপিকে ভোট দিলে দেবে। কিন্তু তিনি তো বললেন না, অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন একটি বর্বর আইন। এ আইন কথা দিয়েও আওয়ামী লীগ বাতিল করল না- বিএনপি ক্ষমতায় এলে করবে। অতীতে না করে ভুল ও অন্যায় করেছে- তাই আমরা দুঃখিত।
কৈ, এমন কথা তো তিনি বললেন না।
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ চায় রাষ্ট্র ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব থাকবে। কিন্তু বিএনপি চায় রাষ্ট্রের ধর্মীয়করণ। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতাসীনরাও কম যায় না। তারা সংবিধানে বিসমিল্লাহ ঢুকিয়েছে, জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধতা দিয়েছে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সনি্নবেশিত করেছে।
এগুলো সবই বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির স্বার্থে- বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানের পরিপন্থী এবং আদালত কর্তৃক বেআইনি ঘোষণা করা সত্ত্বেও। আর এর ফলে যারাই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপি, বলয়ের বাইরে একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তির সন্ধান করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বরং প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালেন তার চরম সাম্প্রদায়িক উক্তির দ্বারা।
তরুণ নেতৃত্বকে আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছেন তিনি। প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তিনি দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন- আর পর্দার পেছনে থেকে নয়, এবার বিএনপি নির্বাচিত হলে তারেক-কোকো-বাবর প্রমুখ তরুণদেরকেই (কারণ তাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র) রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করবেন।
বস্তুত সবই প্রলাবোক্তি। তাই মনে হয় বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে সর্বোত্তম কাজ হবে অবিলম্বে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করা। নতুবা উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আরও উদ্বেগজনক হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তার সমালোচনামূলক কটূক্তি। সবার প্রত্যাশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে তার কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখবেন।
দলমত নির্বিশেষে সব মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ত্বরান্বিত ও কঠোরতম শাস্তির দাবি তিনি তুলবেন। কিন্তু তিনি হতাশ করলেন সবাইকে।
লেখক : রাজনীতিকগত ১১ অক্টোবর এক বিশাল রোডমার্চ করে ঢাকা থেকে সিলেট গেলেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর তিনি রাজশাহী বিভাগ অভিমুখেও রোডমার্চ করেছেন। যাত্রাপথে রোডমার্চের গাড়ি বহর থেকে নেমে অনেকগুলো পূর্বনির্ধারিত স্থানে পথসভা-জনসভা করেছেন।
সর্বত্রই জমায়েত হয়েছে বিপুল-বিশাল। গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এ একটি দুর্ভাবনার বিষয়। মানুষ যে গভীর আগ্রহ নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনতে এসেছে এবং অনেকেই যে তার বক্তব্যকে সমর্থন করেছে- তাও ধরে নেওয়া যায়। যদিও পুরো বক্তব্যকে সামনে ধরলে লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে। আগামী দিনগুলোর জন্য এক উদ্বেগজনক চিত্রই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তাই সিলেট রোডমার্চের সময় দেওয়া তার বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়েই এ নিবন্ধটি লিখতে বসতে হলো। লেখার জন্য আমার একজন চেকোশ্লোভাকিয়া প্রবাসী শুভাকাক্সক্ষীর অনুরোধও আমাকে লেখাটি লিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বেগম খালেদা জিয়া সাধারণ মানুষ নন। কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন সুপরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিকে তিনি সামরিক বাহিনীর নামে করে গেছেন কলুষিত।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, 'I will make polities difficult for the politicians.' এবং সত্যিই তিনি তা করে গেছেন। নানা প্রলোভন দেখিয়ে এ দল সে দল থেকে আদর্শ ও নৈতিকতাবর্জিত বেশকিছু নেতাকর্মী সমবায়ে 'জাগদল' নামে প্রথমে তিনি একটা খিচুরি মার্কা দল গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে সেই দলকে আরও পুষ্ট করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। একেবারেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেওয়া এ দলটির কার্যকলাপ খুব বেশিদিন চালানোর সুযোগ পাননি দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে নিহত হন তিনি।
এ হত্যালীলার বিচার বিএনপি দফায় দফায় ক্ষমতায় এলেও করেনি। বিষয়টি অবশ্যই রহস্যাবৃত।
বেগম জিয়া, তার স্বামীর গড়ে তোলা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন স্তাবক-নেতাদের অনুরোধে। আশির দশকে বিএনপির নেতৃত্বভার গ্রহণ করে সেই থেকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। দলীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়নি- মূলত দল স ষ্টার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য।
রাজনীতিতে বেগম জিয়ার অনেক সাফল্য থাকলেও তার দু'পুত্রের কারণে সে সাফল্য অনেকখানি ম্লান হয়েছে। মায়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সুযোগ নিয়ে তারা যে দুর্নীতি ও যথেচ্ছতায় জড়িয়ে পড়েন তা দুর্ভাগ্যজনক। জ্যেষ্ঠপুত্রের কার্যালয় বলে পরিচিত হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির যে প্রসার ঘটেছে তা সারাবিশ্বে চরমভাবে নিন্দিত হয়েছে। দেশ ও দলকে তারা যেভাবে লুটপাটের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছেন তা আজ এক কলঙ্কিত ইতিহাস। মা হয়ে সন্তানের এ দুর্নীতিমূলক ক্রিয়াকলাপের প্রতি সমর্থন জানানোই শুধু নয়, তাদের জন্য মনে মনে গর্বিত বোধ করা এমনটিও দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়।
তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি বারকয়েক উকিল নোটিসের পরও তিনি ছাড়েননি বরং নোটিসগুলো বেআইনি ঘোষণার দাবিতে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে তাতে যখন হেরে গেলেন এবং বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন তখন দেখা গেল ওই বাড়িতে তিনি বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। অর্ধডজন নারীকর্মিসহ অর্ধশতাধিক চাকর-চাকরানী-ছিল ওই বাড়িতে যা সামন্ত প্রভূদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বেগম জিয়ার ব্যক্তিজীবনের এ দিকগুলো অবশ্য আমার মূল আলোচ্য বিষয় নয়। তার রোডমার্চ ও সিলেটের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণ নিয়ে লেখার কাজে এখন ফিরে আসি। অন্য একটি লেখায় আমি স্পষ্ট করেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা আমারও দাবি এবং সব শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষই এ প্রশ্নে একমত।
তাই এ দাবিতে তারা একা নন এবং বিশ্বাস করি, সরকার এ দাবি শেষতক মেনে নিতে বাধ্য হবে। তবে যত দ্রুত তারা এই যৌক্তিক দাবিটি মেনে নেয় দেশে সঞ্চারিত রাজনৈতিক উত্তাপ তত দ্রুতই প্রশমিত হবে এবং মানুষও আশ্বস্ত হবে। কিন্তু রোডমার্চ নামক কারমার্চের অপর মূল দাবি সরকার পতনের দাবিটি সর্বদাই পরিত্যাজ্য। এই দাবির অর্থ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দেশের উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিঘ্ন ঘটানো। দেশকে ভালোবাসেন এমন কেউই এই জাতীয় দাবি উত্থাপন করতে পারেন না।
সংবিধান বর্ণিত পাঁচ বছর মেয়াদ অতিক্রম করতে দেওয়া উচিত এবং আশা করি, বিএনপি তাদের দাবিনামা থেকে এ দাবিটি প্রত্যাহার করে নেবে।
তারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিরাজ করার কারণে, জনজীবনের দুর্ভোগ অনবরত বৃদ্ধির কারণে, দুর্নীতি সর্বত্র অবাধে ছড়িয়ে পড়ার কারণে এবং সরকারের সীমাহীন দলবাজির কারণে। এ সমালোচনাগুলো তো সরকারের প্রাপ্য। সরকার এর কোনোটাই অস্বীকার করতে পারবে না। সরকার সমর্থক অথবা বিএনপি বিরোধী বহু বিজ্ঞজনই তাদের লেখায়-বক্তৃতায়-ভাষণে এ দাবিগুলো বারবার উত্থাপন করা সত্ত্বেও সরকার নীরব, নিষ্ক্রিয়-নিস্পৃহ।
দুর্নীতি আজ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বন্ধ। এ সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংকের। অন্য দাতাসংস্থাও এই সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে- এমনটা ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। দেশেও আন্দোলন চলছে দুর্নীতির কারণে, অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রীর আশু পদত্যাগ বা পদচ্যুতির দাবিতে।
তেমনই অসংখ্য অভিযোগ বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের বিরুদ্ধে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে তার নীরব, নিস্পৃহ ভূমিকার জন্য। কিন্তু সরকারি দলের দুর্নীতি যেমন নিন্দার্হ তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দুই খ্যাতিমান পুত্র তারেক-কোকোর দুর্নীতির বিচার তিনি চাইছেন না কেন? নিজের সন্তান বলে? সেটা কি স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি বলে অভিহিত হবে না? এ বিষয়টি তিনি কি তার আগামী সভাগুলোতে স্পষ্ট করে বলবেন- চাইবেন দুর্নীতিবাজ বিদেশি টাকা পাচারকারী, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী লালনকারী তারেক-কোকোর কঠোরতম শাস্তি? সেক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন অর্জনে সক্ষম হবেন। দ্রব্যমূল্য এবং অপরাপর ক্ষেত্রেও বেগম জিয়ার শাসনামলও জনগণের জন্য সুখপ্রদ ছিল না। তা বুঝলে তারই মঙ্গল হবে।
কিন্তু সিলেটের বিশাল জনসভায় তিনি এগুলোকে আড়াল করে একতরফাভাবে সরকার ও সরকারি দলকে আক্রমণ করেছেন- যা সুধীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা হতাশ হয়েছেন।
তিস্তার জলবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ তুলে তিনি সরকারি ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন। এ অভিযোগ আদৌ ধোপে টেকে না। কারণ খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জির ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিস্তা-চুক্তির সবকিছু চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও স্বাক্ষর করতে না পারার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এ খবর, এত বেশি আলোচিত যে, বেগম জিয়ার এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত বক্তব্য নেহাতই সবার কাছে 'ফালতু কথা'র মতো মর্যাদা পাবে।
ভারতের কোনো কোনো ভূমিকার সমালোচনা এক জিনিস আর উগ্র ভারত বিরোধিতা ভিন্ন জিনিস। দুর্ভাগ্যজনক যে, বেগম জিয়া সশরীরে মুক্তিযুদ্ধ দেখার সুযোগ পাননি। তাই ভারতের ভূমিকা তার প্রত্যক্ষ জ্ঞানে থাকার কথা নয়। তাই তিনি জামায়াতের মতো উগ্র ভারতবিরোধী হতে পেরেছেন আর তার দ্বারা তিনি তার, তার দলের এবং বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতিও সাধন করতে পুনরায় প্রবৃত্ত হয়েছেন।
তিনি নিয়েছেন উগ্র সাম্প্রদায়িক ভূমিকাও। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্গা মন্দিরে দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমা দর্শনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়ে সৌজন্যমূলক এবং শ্রদ্ধাসূচক যে কথা বলেছেন- তার সমালোচনায় বিদ্রুপাত্মকভাবে বেগম জিয়া শেখ হাসিনার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কোনো সভ্য দেশের নেতা-নেত্রীর জন্যে অশোভন। মনে পড়ে অতীতের এক নির্বাচনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, নৌকা প্রতীকে ভোট দিলে মসজিদ থাকবে না সেখানে উলুধ্বনি দেওয়া হবে। এমন চরম সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তৃতা তার কণ্ঠে শোভা পায় কি?
মনে পড়ে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহের কথা।
বিএনপি- জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যে ভয়াবহ তাণ্ডব ঘটিয়েছিল তা দুর্ভাগ্যজনক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি-সম্পত্তি লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা প্রভৃতি নির্মম ঘটনা- প্রতিমা ভাঙা, মন্দিরে অগি্নসংযোগ ইত্যাদি আমাদের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। কৈ, বেগম জিয়া অতীতের অনেক ঘটনার বিচার চাইলেও এই ভয়াবহ ঘটনার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা- তার উল্লেখ মাত্রও করলেন না। অপরপক্ষে এ ঘটনার তদন্তের জন্য বর্তমান সরকার একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। প্রায় বছরখানেক আগে কমিশন তার প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সরকার এ পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশও করেনি বা দোষীদের বিচারের কোনো ব্যবস্থাও করছে না। বিরোধীদলীয় নেতা এ ব্যাপারে তো সরকারের সমালোচনা করতে পারতেন- তা না করে নীরব থাকলেন। অর্থ কি এই নয় যে, বিচার তিনি বা তার দলও আদৌ চান না? এরপরও তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে উল্লেখ করে বলেছেন, তারা যেন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে তার দলকে ভোট দেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগ হিন্দুদেরকে কিছু দেয়নি- দেবেও না। বিএনপিকে ভোট দিলে দেবে।
কিন্তু তিনি তো বললেন না, অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন একটি বর্বর আইন। এ আইন কথা দিয়েও আওয়ামী লীগ বাতিল করল না- বিএনপি ক্ষমতায় এলে করবে। অতীতে না করে ভুল ও অন্যায় করেছে- তাই আমরা দুঃখিত। কৈ, এমন কথা তো তিনি বললেন না।
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ চায় রাষ্ট্র ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব থাকবে।
কিন্তু বিএনপি চায় রাষ্ট্রের ধর্মীয়করণ। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতাসীনরাও কম যায় না। তারা সংবিধানে বিসমিল্লাহ ঢুকিয়েছে, জামায়াতকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধতা দিয়েছে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সনি্নবেশিত করেছে। এগুলো সবই বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির স্বার্থে- বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানের পরিপন্থী এবং আদালত কর্তৃক বেআইনি ঘোষণা করা সত্ত্বেও। আর এর ফলে যারাই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপি, বলয়ের বাইরে একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তির সন্ধান করছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন বরং প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালেন তার চরম সাম্প্রদায়িক উক্তির দ্বারা।
তরুণ নেতৃত্বকে আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছেন তিনি। প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তিনি দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন- আর পর্দার পেছনে থেকে নয়, এবার বিএনপি নির্বাচিত হলে তারেক-কোকো-বাবর প্রমুখ তরুণদেরকেই (কারণ তাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র) রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করবেন।
বস্তুত সবই প্রলাবোক্তি। তাই মনে হয় বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে সর্বোত্তম কাজ হবে অবিলম্বে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করা।
নতুবা উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আরও উদ্বেগজনক হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তার সমালোচনামূলক কটূক্তি। সবার প্রত্যাশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে তার কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখবেন। দলমত নির্বিশেষে সব মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ত্বরান্বিত ও কঠোরতম শাস্তির দাবি তিনি তুলবেন। কিন্তু তিনি হতাশ করলেন সবাইকে।
লেখক : রাজনীতিক
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।