স্বপ্নের ক্যানভাসে এবার একটা প্রজাপতি কিংবা রংধনু চাই
ছোটবেলায় আমরা যখন প্রাইভেট টিউটর কে জ্বালায়ে মাছভাজা করে ছেড়ে দিতাম,তখন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনাই যে এক মাঘে শীত যায়না। এই মহা মুসিবত যে আমার ঘাড়েও চাপবে তা বুঝলে আমার টীচারদের জ্বালাতন করার তোড়জোড় একটু কমায়ে দিতাম। আমি তখন ক্লাস টু তে। । বাড়ির মানুষজনের শাসন আর চোখ রাঙ্গানি থোড়াই কেয়ার করতাম দেখে আমার মা ঠিক করল আমারে টিউটর দেবে।
আমার মা অফিসে চলে গেলে আমি নিজেকে রাজা বাদশাহ গোত্রীয় ভাবা শুরু করতাম। পাড়া ঘুরে কারো বাসায় নাস্তা,কার বাসায় দুপুরের খাবার,তো কারো বাসা থেকে মুরগির রান চিবুতে চিবুতে টহল মারতাম, পড়ালেখাটাও একেবারে শিকেয় উঠেছিল বই কি! । আমাদের বাড়ির পাশেই মিশনারী স্কুল ছিল,ওইখানে কিছু স্টুডেন্ট আর টিচার আবাসিক ছিল। অবশেষে মিশন স্কুলের এক টিচার মা ঠিক করলেন আমার জন্য কারণ উনি শুনেছিলেন তারা নাকি একটু কড়া হয়,আর ওই টাই আমার জন্য নাকি উপযুক্ত মুগুর ।
শেষমেশ টীচার আসলেন, টিচার কে দেখেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
আমার ধারণা ছিল যে টিউটর মানেই চশমা পরা হাসি মুখের ম্যাডাম। পেল্লাই সাইজের গম্ভীর টাইপের টিচার দেখেই আমার ভিলেন ভিলেন লাগল। আমাকে পড়তে বসায় ,কার সাধ্যি ! এইভাবে সাতদিন ধরে টিচার আসতেন আর আমি বিদায় করে দিতাম,এমনকি একটু আধটু হুমকি ধামকিও দিয়েছিলাম ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব বলে ! সাতদিন যাওয়ার পর ও যখন টীচার আমার বাড়ির পথ ছাড়লেন না ,আমি ঠিক করলাম একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে । টিচার আসতে দেখে এক ছুটে পাশের পচা ডোবা থেকে এক মগ পানি এনে ঢেলে দিয়েছিলাম টিচারের মাথায়। আর চরম একটা হুমকি দিয়েছিলাম ,আবার আসলে বিছুটি পাতা দিয়ে দেব গায়ে ।
সেইদিনের পর টিচার মনে হয় হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন,আর আমিও। তবে যাওয়ার আগে টীচার আমার দাদীকে বলে গিয়েছিলেন, এইরকম ত্যাঁদড় পিচ্চি ইহজনমে উনি দেখেননি আর দেখবেন বলেও আশা রাখেননা !
ওই টিউটর মনে হয় মনে বড়ই দুঃখ পাইছিলেন মনে ,এল্লিগা আমার টিউশনি গুলাও ছিল মনে রাখার মত । একেকটার চেয়ে একেকটা কয়েক কাঠি সরেস। প্রথম প্রথম টিউশনি পাওয়ার জন্য ঝক্কি,সে তো একটা আছেই,বেতন বেশি তো ম্যালা দুর বাসা , বাসা কাছে তো বেতন কম,দুটাই ঠিক আছে তখন আবার দেখা যায় এক্কেবারে ন্যাদা পোলাপান পড়ানো লাগবে......যাইহোক অবশেষে কষ্টে সৃষ্টে প্রথম যে টিউশনি টা পাইলাম ওইটা আজিমপুর। কাছাকাছি আর মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে দেখে রাজি হয়ে গেলাম।
প্রথম দিন গিয়ে মাইয়ার মারে এক্কেরে ইম্প্রেসড করে ফেললাম( মেয়েকে ১ম /২য় করেই ছাড়ব টাইপ ডায়লগ মেরে) ।
পরদিন থেকে পড়ানো শুরু করলাম,মিনিট বিশেক গেসে,মেয়ে কয় কি,মিস আজ আর পড়বনা,অনেক্ষন পড়সি(!!)। আমি প্রথম দিন আর ঝাড়ি দিলাম না,বুঝায়ে শুনায়ে আবার পড়াইতে বসলাম । একটু পর মেয়ে আমারে জিগায়, “মিস,ডু ইউ হ্যাভ এ বয়ফ্রেন্ড?” আমি তো পুরাই টাশকি। থতমত খেয়ে বললাম,না তো ।
মেয়ে চোখ কপালে তুলে বলে, হোয়াট? ইউ আর সো ব্যাকডেটেড। আমি আরেকবার বেকুব হলাম। ক্লাস সিক্স এ পড়া ওই মেয়ে তখন যা বলল তার মর্মার্থ হল- আমি ক্লাস সিক্সে পড়ে বয়ফ্রেন্ড জুটায়ে ফেলসি আর আপনি এত বুড়ি হয়েও পারেন নাই? প্রেস্টিজ নিয়ে টান পড়ার কারনেই হোক আর মেয়ের কেরামতি দেখে ভয় পেয়েই হোক, আমি মোটামুটি চুপসানো বেলুনের মত একটা চেহারা বানায়ে আবার পড়ানোয় মন দিলাম । কিছুক্ষন পর আবার আমাকে বলে, ম্যাম , আপনি জানেন তো আমার বাবা যে 'অমুক" কোম্পানির মালিক ( একটা বিখ্যাত কলম কোম্পানি) । আমি বললাম ,না তো ! পরে খেয়াল করে দেখি মেয়ের হাতে ইন্ডিয়ান "লিঙ্ক" কলম।
আমার বাপের কলম ফ্যাক্টরি থাকলে তো আমি জীবনেও কলম কিনতাম না কিন্তু এই মেয়ের কাহিনী কিছুই বুঝলাম না। দিন কয়েক পর আমি এইটা আবিষ্কার করতে সক্ষম হইলাম, নিজের কলম ব্যাগ থেকে বের না করে অন্যের কাছ থেকে কলম ধার করে সংগ্রহ করা ওই মেয়ের অন্যতম হবি !
যাই হোক,এই মেয়ে কে পড়ানো আর গাধা পিটিমানুষ বানানো এক ই ব্যাপার। । দুই আর দুইয়ে যে চার হয় এইটা বের করতেও ক্যালকুলেটর চাপত। তবে স্বীকার করতেই হবে অসাধারণ স্মরণশক্তির জোরে এই মেয়ে একেকটা অঙ্ক হুবহু মুখস্থ করে ক্লাস সিক্সের মুখ দেখতে পেরেছে ! আমি কিছু বুঝিয়ে শেষ করার পর বেশিরভাগ সময় ই তাকিয়ে দেখতাম, সে হয় জানালা দিয়ে তাকায়ে আছে আর না হয় বিশাল নখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়ে আছে আর নয়ত দীঘল কেশ নিয়ে খেলা করছে !! একদিন নিজের কেশরাশির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে মুগ্ধ নয়নে একগোছা কেশ রাশি হাতে নিয়ে মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, মিস,আমার চেহারা সাথে ক্যাটরিনা কাইফের চেহারার অনেক মিল আছে না? আমি এক পলক তাকিয়েই বললাম, আরে তাই তো, এতদিন তো খেয়াল ই করিনিইইইই ! মেয়ে গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে বলে, একচুয়ালি সি ইজ হট এন্ড কিউট, বাট নট প্রিটি।
ম্যাম, ডোন্ট ইউ থিংক , আই এম প্রিটি? আমি হেহেহেহে মার্কা হাসি ঝুলায়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। কোনভাবেই দ্বিমত পোষণ করে একটা জ্ঞানগর্ভ সৌন্দর্য বিষয়ক বক্তৃতা শুনতে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না ।
শুধু এই পিচ্চির বিনোদন ই যথেষ্ট না, তার আবার ছোট দুইটা ভাইবোন ছিল। টীচার দেখামাত্র ভাইটা ঢিশুম ঢিশুম গুলি করা হাউস অফ ডেথ আর না হয় ভি কপ খেলতে বসত। এই খেলাগুলার বস্তাপচা সাউন্ডে আমার ইচ্ছে করত জানালা দিয়ে ঝাঁপ মারি।
তিন বছরের ছোট বোন টা ছিল আরো এক কাঠি উপরে। তার জন্য প্রতিদিন চকলেট ( লাভ ক্যান্ডি) নিয়ে যেতে হত,না হলে ওই বিচ্ছু পিচ্চির জ্বালায় ওখানে থাকাই রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার ছিল। যাহোক ,মাস দুয়েক যাওয়ার পর মেয়ের অসম্ভব প্রতিভার ফসল হিসেবে মিডটার্ম পরীক্ষায় যখন ডাব্বা মারল,তখন বুঝলাম,এখন মান সম্মান নিয়ে পালানোর সময় চলে আসছে।
এবার ধানমন্ডিতে দুই জমজ বোনকে পড়ানো শুরু করলাম। আমি জানতাম জমজ দের অসম্ভব মিল, এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতে একরকম আবার আচার আচরণেও নাকি অনেক মিল।
কিন্তু এই দুইটা বিপরীত মেরু কেমনে কেমনে এক মায়ের পেটে এক লগে দশ মাস ছিল আল্লাহ মালুম। এক বোন ছিল মা্রাত্মক ব্রিলিয়ান্ট, আর আরেকটা ঠিক তার সমানুপাতিক গাধা। এদেরকে ঘড়ি ধরে দুই ঘণ্টা পড়াইতে হইত। একদিন মাঝে ৫-৭ মিনিটের জন্য একটা রুম ছেড়ে বাইরে গেসে কি কারণে। পড়ানো শেষে যখন উঠতে যাব,তখই ওই মেয়ে বলে ,মিস, আমি ৫মিনিটস কম পড়েছি, প্লীজ কাভার ইট আপ ।
আমার তখন একটা কথাই মনে হইসিল,আল্লহর দুনিয়ায় এই "আজিব জিনিস" গুলা কেমনে যে আমার কপালে জোটে !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।