একমুখাপেক্ষি না হয়ে যা কিছু ভাল তা গ্রহন করা উচিৎ... আমার কাছে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ খেলা দলটাকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দলই মনে হয়। এ পর্যন্ত যে চারটি বিশ্বকাপ বাংলাদেশ খেলেছে তার মধ্যে ২০০৭-ই ছিলো বাংলাদেশের জন্য স্বপ্নের বিশ্বকাপ। সেবার আমরা কোর্য়াটার ফাইনালই শুধু খেলিনি, কোর্য়াটার ফাইনালে তখনকার নাম্বার ওয়ান দল দক্ষিন আফ্রিকাকেও আমরা হারিয়েছিলাম।
২০০৭ বিশ্বকাপের দলটাকে একটু দেখে নিই..
১. তামিম ইকবাল
২. শাহরিয়ার নাফিস
৩. আফতাব আহমেদ
৪. আশরাফুল
৫. হাবিবুল বাশার
৬. সাকিব আল হাসান
৭. মুশফিকুর রহিম
৮. মাশরাফি বিন মর্তুজা
৯. মোহাম্মদ রফিক
১০. আব্দুর রাজ্জাক
১১. সৈয়দ রাসেল
বিশ্বকাপের এই দলটা একদিনে তৈরী হয়নি। এটা ডেভ হোয়াটমোরের চার বছরের ফসল বলা চলে।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর এপ্রিলের দিকে ডেভ বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পায়। ২০০৩ সালটা বাংলাদেশের হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে কাছে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ওয়ানডে অথবা টেস্ট ক্রিকেটে কোনো জয়ের দেখাই পায়নি।
জয়ের দেখা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয় ২০০৪ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত। ১০ মার্চ বাংলাদেশ হারিয়েছিলো জিম্বাবুয়ের মতো পরাশক্তিকে।
এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে তখনকার জিম্বাবুয়ে দলটি অনেক পরিনত ছিলো এবং যেকোনো বড় দলকে চ্যালেন্জ করার মতো শক্তি তাদের ছিলো। সেই ম্যাচে ৩২ বলে ৫১ রান করে ম্যাচ সেরার পুরুস্কার পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৪ সালেই আরো দুটি জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ। ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হারায় ভারতকে।
এবছরই ওয়ানডেতে অভিষেক হয় আব্দুর রাজ্জাক ও আফতাব আহমেদের ।
২০০৫ সালে বাংলাদেশকে বড় দলগুলো নতুনভাবে চিনতে শুরু করে। সেবছর ১৪ টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ চারটি জয় তুলে নেয়। সেবছরই বাংলাদেশ প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ পায়। অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কার্ডিফের ইতিহাস গড়া সেই জয়টিও ২০০৫ সালে।
ঠিক তার পরের ম্যাচে ইংল্যান্ড ৩৯১ রান করেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো শুধুমাত্র আশরাফুলের ৫২ বলে ৯৪ রান করা সেই ইনিংসার জন্য। সেবছর ওয়ানডেতে অভিষেক হয়েছিলো শাহরিয়ার নাফিসের ।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ শিখে গিয়েছিলো কিভাবে জিততে হয় এবং ২০০৬ সালে এসে বাংলাদেশ ২৮টি ম্যাচ খেলে জয় তুলে নেয় ১৮ টি। রেকর্ডটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!! অষ্ট্রেলিয়াকে হারানোর কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ হারায় শ্রিলঙ্কাকে । মার্চ মাসে কেনিয়াকে ৪-০ তে হারালেও জিম্বাবুয়ের মাটিতে জুলাই-আগষ্টে হওয়া সিরিজটায় ২-৩ এ হেরে যায় বাংলাদেশ।
পরের সিরিজে আবারো কেনিয়াকে ৩-০ তে হোয়াইট ওয়াশ এবং দেশের মাটিতে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ৫-০ তে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইট ওয়াশ করে বাংলাদেশ। ২০০৬ এ বেশীরভাগ খেলাগুলো ছোটো দলের সাথে হলেও জয়ের একটা ধারা তখনই গড়ে উঠে। আর এরই মধ্যে বড় দলগুলোকে আচমকা হারিয়ে দেওয়াটা যেনো বড় দলগুলোর জন্য একটা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। বড় দলগুলো বাংলাদেশকে এখন আর আন্ডারডগ ভাবে না! এবছরই ওয়ানডেতে অভিষেক হয় বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ।
চলে আসে ২০০৭ সাল।
গতো চার বছরে ডেভ তিলে তিলে যে দলটাকে গড়লেন সেই দলকে এখন পরীক্ষা দিতে হবে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ শুরু হয় মার্চ মাসে। এর আগেই জিম্বাবুয়েকে ৩-১ এ হারিয়ে সিরিজ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। আত্ববিশ্বাসটা তখন তুঙ্গে ছিলো বাংলাদেশের। বিশ্বকাপ শুরুর আগে মাশরাফি ভারতকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো, "ধরায়ে দেবানে"।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মাশরাফি, রফিক, রাজ্জাক, তামিম, মুশফিক আর সাকিবের নৈপুন্যে বাংলাদেশ হারিয়ে দিলো ভারতকে , মাশরাফিই যেনো বলে কয়ে হারালো ভারতকে। সেই বিশ্বকাপে টপ ফেভারিট ভারতকে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিলো। ভারত যেনো আজও সেই খেলা ভুলতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিলো দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠা। সেই স্বপ্ন যেনো সত্যিই হলো।
ভারত ও বারমুডাকে হারিয়ে বাংলাদেশ উঠে গেলো দ্বিতীয় রাউন্ডে। সেই দলটার আত্ববিশ্বাস এবং টিম স্পিরিট ছিলো চোখে পড়ার মতো। অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে হোচট খায় বাংলাদেশ। তবে শেষ ম্যাচে মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৩ বলে ৮৭ এবং রাজ্জাক, রফিক ও সাকিব আল হাসানের বোলিং নৈপুন্যে এক নম্বরে থাকা দক্ষিন আফ্রিকাকে হারিয়ে আবারো চমক সৃষ্টি করে বাংলাদেশ।
২০০৭ সালেই ওয়ানডেতে অভিষেক হয়েছিলো বর্তমানে ড্যাসিং ওপেনার তামিম ইকবালের ।
অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ শাহরিয়ার নাফিসের একজন যোগ্য সঙ্গী খুজছিলো এবং এবছরই যেনো সেই অভাবটা পুরন হলো।
২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম রাজ্জাক, আফতাব, শাহরিয়ার নাফিস, সাকিব ও তামিমের মতো খেলোয়ারকে। ডেভের হাত ধরেই এরা দলে এসেছে। এর আগে দলে অটোমেটিক চয়েস হিসেবে ছিলো আশরাফুল, মাশরাফি অথবা রফিকের মতো খেলোয়ার। ২০০৭ সালের দলটা সত্যিই স্বপ্নের দল ছিলো।
খেয়াল করে দেখুন দলে অটোমেটিক চয়েস হিসেবে তখন খেলছিলো নাফিস, আশরাফুল, আফতাব, মাশরাফি, রফিক এবং রাজ্জাকের মতো খেলোয়ারেরা।
ডেভ বিদায় নেয়ার পরের ইতিহাসটা একেবারেই অন্যরকম। এক আইসিএল ঝড়ই যেনো বাংলাদেশকে ওলটপালট করে দিয়ে গেলো! ২০০৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব দেয়া হলো জেমি সিডন্সকে। সিডন্স ভাঙাচোরা দলটাকে গোছানোর চেষ্টা করলেন। তিনি যে সফল হননি তা কিন্তু নয়।
সিডন্সের সময়েই আমরা নিউজিল্যান্ডকে দেশের মাটিতে ৪-০ তে বাংলাওয়াশ করেছি। ওয়েষ্টইন্ডিজকে ওয়েষ্টইন্ডিজের মাটিতে ৩-০ তে হারিয়েছি।
সিডন্সও বাংলাদেশকে গড়ার জন্য ৪ বছর সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু ডেভ হোয়াটমোর বাংলাদেশকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন আমরা কি সেখান থেকে সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছি? ২০১১ বিশ্বকাপের পর অধিনায়ক নির্বাচন করতে গিয়েই দেখা গেলো অধিনায়ক বানানোর মতো যোগ্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কেনোনা দলে সাকিব-তামিম ছাড়া অটোমেটিক চয়েস করার মতো কোনো খেলোয়ারই নেই। শতো সাফল্যের ভেতরও এটাই সিডন্সের মূল ব্যার্থতা।
ডেভ যেমন দলে নিয়ে এসেছিলেন সাকিব-তামিম, নাফিস, আফতাব অথবা রাজ্জাকের মতো খেলোয়ারকে তেমনি সিডন্স তার চার বছরে খেলতে সুযোগ করে দিয়েছেন ইমরুল, জুনায়েদ, রকিবুল, নাইম অথবা রিয়াদকে। একমাত্র ইমরুল ছাড়া এদের সবাইকে ব্যার্থ খেলোয়ার বলেই অভিহিত করা যায়। এরা কখনই দলে অটোমেটিক চয়েস হওয়ার মতো খেলোয়ার না। সিডন্স রকিবুল আর জুনায়েদকে সুযোগের পর সুযোগ দিয়েছে। এদেরও যে প্রতিভা ছিলো না, তা কিন্তু নয়।
এরাও নিশ্চয়ই পারফর্ম করেই দলে এসেছিলো। কিন্তু সিডন্সের পিঠ বাচিয়ে চলার নীতিই এদেরকে ধ্বংস করে দিলো!! মনে আছে জুনায়েদের অভিষেক হয়েছিলো পাকিস্তানের বিপক্ষে টি২০ ম্যাচ দিয়ে। সেই ম্যাচে সে ৪৯ বলে ৭১ রান করেছিলো। এই ম্যাচ অবশ্য সিডন্স দায়িত্ব নেয়ার আগেই খেলা হয়েছিলো। সিডন্স আমাদের খেলোয়ারদের মেধাকে কাজেই লাগাতে পারেনি! একজন কোচের দায়িত্ব হচ্ছে খেলোয়ারের ভেতর থেকে তার সেরাটা বের করে আনা।
সিডন্স সেই কাজটিই করতে পারেনি।
২০০৮-২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ যতগুলো জয়ের মুখ দেখেছে তার বেশীরভাগ জয়ই এসেছে সাকিব এবং তামিমের হাত ধরে। এক সাকিব-তামিম ছাড়া দলটার চেহারা কেমন হতে পারে তা সেদিনই উপলব্ধি করা গেছে যেদিন সাকিব এবং তামিম একই দিনে খারাপ খেলেছে। আর এই সময়টাতে বাংলাদেশ বেশীরভাগ ম্যাচই জিতেছে বোলিং নৈপুন্যে। কিন্তু সিডন্স ছিলো মূলত ব্যাটিং কোচ।
যদিও সে আজ পর্যন্ত কোনো আর্ন্তজাতিক ম্যাচই খেলেনি!!
সিডন্স চার বছরে খুব ক্ষতি করে দিয়ে গেলো বাংলাদেশ দলের! রফিককে হারানোর পর গতো চার বছরে আমরা রফিকের মতো একজন খেলোয়ারকেই তৈরী করতে পারলাম না! ২০০৩-২০০৭ সাল পর্যন্ত বেশীরভাগ ম্যাচে জয়ের নায়ক আশরাফুলকেও আমরা হারালাম! আশরাফুলের নাকি টেকনিকে সমস্যা!! এক আশরাফুলের উদাহরন দিয়েই সিডন্সকে একজন ব্যার্থ কোচ হিসেবে অভিহিত করা যায় । বিশ্বকাপে সিডন্স চার ওপেনারকে খেলালেন ১,২,৩ এবং চার নম্বরে। নাইম এবং রিয়াদও যেখানে খেলছিলো সেখানেও কি তারা যোগ্য?
(ব্যাট হাতে ডেভ এবং বল হাতে সিডন্স)
সিডন্স একটা ভাঙাচোরা দল রেখে গেলেন, যেখানে ডেভ রেখেগিয়েছিলেন একটা স্বপ্নের দল, পার্থক্য এখানেই। দেখা যাক স্টুয়ার্ট ল দলকে কতদূর নিয়ে যেতে পারেন। আমার মতে গত ১০ বছরের সেরা খেলোয়ারদের নিয়েই আমাদের সামনে যাওয়া উচিত।
সাকিব, তামিম, আশরাফুল, মাশরাফি, শাহরিয়ার নাফিস এবং অলক কাপালির মতো খেলোয়ারকে শক্তিতে পরিনত করতে পারলে আমার বিশ্বাস আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা হয়তো আবারো ফিরে পাবো আমাদের স্বপ্নের দলকে, যে দল পিঠ বাচানোর জন্য খেলবে না, খেলবে জেতার জন্য. . . ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।