যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না # আমাদের কলোনিতে উত্তাপ ছড়িয়ে যাবার মতো কোনো ঘটনা আজকাল ঘটে না দেখে জয়নাল চাচার মন বেজায় খারাপ। চাচা উত্তেজনা প্রিয় কোনো মানুষ নন। তাই তিনি যখন আজ চা বানাতে বানাতে বললেন- কলোনিটা মইরা গেল গা, তখন আমাদের অবাক না হয়ে উপায় থাকে না।
ঘটনার আরেকটু গভীরে গেলে স্পষ্ট হয় চাচার হাহাকারের পেছনের কারণ।
এই কলোনির জন্ম থেকেই বলা যায় চাচা এখানে তার এই ছোট্ট চায়ের দোকান নিয়ে আছেন। আমরা, তার আগে আমাদের বড় ভাই, তারও আগে অনেকেই এই দোকানে চা খেতে খেতে বড় হয়েছেন, নানা তর্কে-বিতর্কে এই চায়ের দোকান মাতিয়ে রেখেছেন। আর তর্কের বিষয়ের আর কী আর শেষ আছে? বিশ্ব রাজনীতে থেকে শুরু করে কলোনির রাজনীতি, আর্জেন্টিনা সেরা না ব্রাজিল, আবাহনী না মোহামেডান, কোন ছেলে কোন মেয়েকে নিয়ে ঘুরল, কার বাড়িতে আজ কী রান্না হচ্ছে অথবা অমুকের বিয়ে কেন ভেঙে গেল, কার চরিত্র ভালো ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে আড্ডা চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। আর যত আড্ডা তত চা, তত সিগারেট আর চাচার মুখে হাসি।
এখন যে আড্ডা হয় না তা না তবে আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা চায়ের কাপে ঝড় ওঠে না, সিগারেটের খন্ডিত অংশ দিয়ে ভরে থাকে না মাটি, এখন শুধু থাকি আমি এবং আমরা কয়েকজন যারা কলোনির ঐতিহ্য ধরে রাখার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর না হলেও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার ব্যাটন এখন আমাদের হাতেই এসে পড়েছে। তাই, চাচা যখন কলোনির মরে যাওয়ার কথা বললেন, স্বভাবত আমাদের নিজেকে ব্যর্থ মনে হলো এবং পেছনের কারণ স্পষ্টভাবে বুঝতে না পেরে চাচার কাছে জানতে চাইলাম- হঠাৎ আবার কী হইল?
কিছু যে হই না, এইটাই তো সমস্যা। বিক্রি কইমা গেছে।
আমরা সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বিক্রী কইমা গেছে মানে কী? আমরা তো সারাদিন আপনার দোকানে পইড়া থাকি।
আরে তোমরা থাকলে কী হইব? আগে কী হইত? ঐটাও নতুন করে কওন লাগব? আর তোমরা সারাদিন কই থাকো? রাইত হলে আসো।
এই ছয়মাস আগেও আমরা প্রায় সারাদিন পড়ে থাকতাম এখানে- বাড়ি ফেলে, পড়াশোনা ফেলে, এমনকি বাথরুমটাও সেরে নিতাম গণশৌচাগারে; তাই চাচার অভিযোগ সত্য বলেই প্রমাণ হয়।
বাড়ি থেকে অনেককেই বের হয়ে যাবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল, এমনকি আমাকেও। একবার আড্ডা দিয়ে গান গেতে গেতে যখন রাত বারোটায় বাসায় ঢুকতে নেই তখন বাবাকে দেখি তার বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে অগ্নিচোখে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। আমাকে দেখে কিছু না বলে চুপচাপ ঢুকে যান ভেতরে।
পরদিন সমন জারি হয় বাড়িমুখো না হওয়ার জন্য। আমি হতচ্ছাড়া, বাউন্ডুলে নিজেকে যাই ভাবি না কেন, যাই হই না কেন বাড়ি না ফিরতে পারলে যে ঐসব ভাবের দুনিয়ায় থেকে জীবন কাটবে না তা আমি ভালোই জানতাম। বাবা এককথার মানুষ, তাই ভয় পেয়েছিলাম বেশি। পূর্ব ইতিহাস বলে বাবা এর আগে একবার বড় ভাইকে বের করে দিয়েছিলেন, তারপর মা কান্নাকাটি করে ভাইকে বাসায় ফেরাতে পেরেছিলেন তাও এক সপ্তাহ পর। ভাই বাইরে কোনো এক বন্ধুর বাসায় শরনার্থীর মতো ছিলেন।
আমি এসব পারতাম না, পারব না। তাই বাবার সমন পেয়ে ভয়ে বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুর বোনের বাচ্চা হয়েছে দেখে আসতে দেরি হয়েছে এই অজুহাতে সেই যাত্রা বেঁচে যাওয়ার পর এবং বন্ধুমহলে অনেকেই বাড়ি থেকে এমন হুমকির সম্মুখীন হওয়াতে আমাদের দোকানযাত্রা কিছুদিনের জন্য স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। তবে এর পেছনে শুধু বাসার হুমকি দায়ী ছিল না বরং ক্রমশ নিরস হয়ে যাওয়া পরিস্থিত অথবা বলা যায় পরিস্থিতি আসলে নিরস হয় নি বরং উত্তেজনাপূর্ণ কিছু ঘটনা যার কাছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহগুলো ম্লান হয়ে গিয়েছিল আমাদের মন ভেঙে দিয়েছিল।
আজ এতদিন পর চাচা যখন বলল, কলোনিটা মইরা গেছে গা অন্যসব ঘটনা ছাপিয়ে আমাদের ছয়মাস আগের ঘটনাগুলো একে একে মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠতে থাকে।
আমরা কেউ কাউকে কিছু বলি না, একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সবার মনে এখন এক-ই কথা ঘুরছে, আবর্তিত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর টের পাই আবর্তিত হতে হতে আমরা আবার পৃথিবীর মতো ঘুরতে থাকি যেমনটা আগে ঘুরেছিলাম, তখন সূর্য ছিল, ঘোরার উদ্দ্যেশ ছিল, এখন সূর্যের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই, কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে যাই, যা দেখে চাচা আবার বলে, ধুর মিয়ারা কথা কও না ক্যান?
আমরা কজন বিষণ্ণ যুবক কিছু না বলে ধীরে ধীরে যে যার বাসার দিকে রওনা দেই, চাচাকে গজগজ করতে শুনেও না শোনার ভান করে চলে আসি। এইখানে, ঠিক দোকানের উল্টোদিকের বাড়িতে যে জানালাটি এখন শুন্য, যে বারান্দার এখন কোনো কাপড় ঝুলে না, যে বাড়ির গেটে ঝুলছে বিশাল একটি তালা সে বাড়ির সাবেক বাসিন্দা নীরার কথা ভেবে সবাই বিশাল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং অনুভব করতে পারি নীরা যাওয়ার সময় কলোনির প্রাণ হাতে নিয়ে চলে গেছে, আমাদের বাঁচিয়ে রেখে মৃত করে গেছে।
#
বিশ্বকাপ ফুটবলের পরে এক মন খারাপ করা সময় নীরার আগমন এই কলোনিতে।
বিশ্বকাপ নিয়ে উত্তেজনা, মারামারি, মিছিল শেষে প্রিয় দু দলের বিদায়ে আমাদের ভেতরে যখন বিভিন্ন ভাগ-উপভাগের সৃষ্টি হলো তখন নীরার আগমনে সেই ভাগ-উপভাগ ভেঙে একজনের একক গ্রুপে পরিণত হলো।
অর্থাৎ নীরাকে কেন্দ্র করে আমাদের একতা ভেঙে পড়ল।
নীরারা চাচার দোকানের ঠিক সামনের বাসাটাই উঠেছিল। দোকানের সামনে টুলে বসলে দেখা যেত নীরার ঘরের বারান্দা। আর নীরা বদ্ধ ঘরে থাকতে পছন্দ করত না বলেই ধারণা হয়। তাকে প্রায় দেখা যেত বারান্দায় এপাশ থেকে ওপাশ থেকে হাঁটাহাঁটি করছে।
তখন আমাদের টেনশনের অন্ত্য থাকত না। কী হলো তার, মন খারাপ নাকি, বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা দু চারটা সিগারেট বেশি খেয়ে ফেলতাম।
আমি অপেক্ষায় থাকতাম দুপুরের। সূর্য যখন মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে থাকত তখন স্নিগ্ধ বৃষ্টি ছোঁয়া নিয়ে চুল মুছতে মুছতে গোসল শেষে নীরার বারান্দায় এলে আমার ঘামে ভেজা শরীর থেকেও সুগন্ধ বের হতো।
এই সময়টাতে লোকসমাগম বেশি থাকত এবং প্রায় আমাদের ভেতর হাতাহাতি লেগে যেত এবং কিছুক্ষণ পর আমরা বুঝতে পারতাম এই হাতাহাতিতে কোনো লাভ নেই বরং কিছু একটা করতে হবে।
তো কিছু একটা করতে হবে এই তাগিদ আসামাত্র আমাদের ভেতর হাহাকারের সৃষ্টি হতো কারণ নীরার কাছাকাছি কিভাবে যেতে হবে তা আমাদের জানা ছিল না। শুধু জানতাম নীরার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিভাগে পড়ে এবং সে যথেষ্ট স্মার্ট আর আমরা পড়াশোনা থেকে দূরে সিগারেট খাওয়া যুবকের দল। এই হতাশা থেকে ক’জন আবার পড়াশোনা করতে শুরু করে, কেউ কেউ আবার বই নিয়ে দোকানের সামনে হাঁটাহাঁটি শুরু করে। বিশেষ সূত্রে যখন আমরা জানতে পারি, নীরা ফুটবল পছন্দ করে এবং মেসির জন্য পাগল তখন ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের মন কিছুটা ভেঙে যায় এবং উচ্ছ্বাসের প্রাথমিক মুহূর্ত পার হয়ে যাওয়ার পর মেসিভক্ত যুবকেরা মেসিকে ঈর্ষা করতে শুরু করে অতঃপর কেউ কেউ দাবি করতে শুরু করে তাদের দুর্ভাগ্য তারা আর্জেন্টিনায় জন্ম নেয় নাই, নিলে মেসিকে কবেই তারা ছাড়িয়ে যেত।
এইসব আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক চাচার দোকানের বিক্রি বাড়িয়ে রেখেছিল, তাই আজ যখন চাচা তার হতাশার কথা ব্যক্ত করে আমরা নস্টালজিক না হয়ে পারি না।
একদিন সকালে আচমকাই যখন দেখলাম নীরাদের বাসার সামনে ট্রাক মালামাল নিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা সবাই ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গেলাম। যাওয়ার ঠিক আগে নীরা আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। এক হাসি আমাদের ভেতরে হাজার কান্নার তৈরী করে দিল।
তবে চাচার হতাশা কিছুদিনের ভেতর কেটে যাবে এমন একটা আভাস আমরা পেলাম যখন শুনলাম নীরাদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া আসবে।
#
চাচার দোকান থেকে ফিরে পরদিন সকালে যাওয়ামাত্র জানতে পারলাম নীরাদের বাসা আর খালি থাকছে না।
চাচার মুখে হাসি। কি মিয়ারা,কিছু একটা হবে মনে হইতেসে না?
তো ভাড়াটিয়া কবে উঠতেসে?
শুনলাম তো কালকেই।
কিছুক্ষণের ভেতর আমরা দেখতে পাই, গত কয়েকমাসে এদিকে না আসা তরুণের দল দোকানে ভিড় জমাতে শুরু করেছে এবং নতুন ভাড়াটিয়া নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এইবার যেইটা সব সেইটা নীরার মতো দেমাগী হইব না, আরো সুন্দর হইব, এইবার আর লাইন ছাড়তেসি না কিছু একটা করেই ছাড়মু। অথচ এক সময় বলা হতো নীরার মতো সুন্দর আর কেউ থাকতে পারে?
হঠাৎ কানে আসে, তুই লাইন ছাড়বি না মানে? গতবার ঝামেলা করসিলি, এইবার কিছু খবর আছে কইলাম?
ঐ খানকির পোলা, কলোনিতে কী একটা মাইয়া নাকি? অন্যদিকে যা, আমি আগে বুকিং দিসি।
অতঃপর আবার হাতাহাতি, আবার সেই উত্তেজনা।
আমি এখন কিছুটা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শিখেছি। এরা মূর্খ, নিজেকে কিছুটা চালাক মনে হয়। এবার যা করার গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেই। মনে মনে কিছু ছক কাটতে থাকি যেমন বাসার অন্যকারো সাথে আগে ভালো সম্পর্ক গড়তে হবে, মেয়ের সাথে যেভাবে হোক কথা বলতে হবে তবে বখাটেপনা করে নয়।
তো এভাবেই চাচা আক্ষেপ করার একদিনের মাথায় মৃতপ্রায় কলোনিতে আবার প্রাণ ফিরে এলো এবং দুপুর দু’টোর পর বেনসন শেষ হয়ে গেলে একদল ছেলেপেলে গোল্ড-লিফ টানতে শুরু করল। উত্তেজনায় সবাই টগবগ করে ফুটছে তো ফুটছেই।
আমরা সবাই ধরেই নিয়েছি নতুন ভাড়াটিয়াদের কেউ নীরা থেকেও অধিক রুপবতী, লাস্যময়ী হবে।
#
ট্রাক এসে থামে, জিনিষপত্র নিয়ে কুলিরা নামে। বাসায় মানুষেরা ঢোকে।
আমাদের বয়সী এক যুবক, হুইল চেয়ারে এক বৃদ্ধ, পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধা ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে। আমরা ক’জন কিংবা আরো বেশি কিছু মানুষ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে বিশেষ কাউকে দেখার অপেক্ষায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি।
আর কেউ আসে না, আর কেউ নামে না। দুপুরের রোদ বাড়তে থাকে। আমার গায়ে ঘামের দুর্গন্ধ, কোনো বৃষ্টি ছোঁয়া আসে না।
মালামাল রেখে কুলিদের ভেতর একজন যখন দোকানে আসে তখন আমরা জানতে পারি এই বাড়িতে কে কে আছে, কে কে থাকবে। নিমিষেই চাচার দোকান ফাঁকা হয়ে যায়। এবার আক্ষরিক অর্থেই আমরা কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আমরা আবার নস্টালজিক হয়ে যায়, চাচা গালি দেয় ধুর শালা! এইটা কিছু হইল!
কুলিটি এসে বলেছিল, হুইলচেয়ারে বসা বৃদ্ধ একজন মুক্তিযোদ্ধা- তিনি, তার ছেলে, আর তার স্ত্রী এখানে থাকবেন। আমরা এই কলোনিতে একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে কী করব? যদিও কথাটা ভাবার সময় আমাদের মনে থাকে না কোনো এক দিন কোনো এক তর্কে আমরা বলেছিলাম, ইশ! যুদ্ধের সময় যদি জন্ম নিতাম, যুদ্ধ কইরা ফাটাই ফেলতাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।