..............................................
একটা পুরানো গল্প দিয়ে শুরু করি! আমি তখন ক্লাসে থ্রীতে পড়ি। আম্মু নিয়মিত স্কুল থেকে আনা নেয়া করে। তো, আমার স্কুলের উলটা দিকে, রাস্তার ওইপারে তখন নতুন একটা ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে, নাম “মাইলস”। সে সময় টিভিতে নতুন একটা এড দেয়া শুরু করলো, “শার্ক এনার্জি ড্রিংক”। আমার তো এড দেখে মাথা নষ্ট অবস্থা! বাংলাদেশে এর আগে এনার্জী ড্রিংক বলে কোনো পানীয় ছিলোনা, তাই আম্মু’র ও কোনো আইডিয়া ছিলোনা এ সম্পর্কে।
আমি একদিন ছুটির পর কান্না-কাটির চুড়ান্তে উপনিত হলাম এই দাবীতে যে, আজকে আমারে শার্ক খাওয়ানো লাগবেই! স্নেহময়ী মা আমারে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে মাইলসে ঢুকলেন। তখন শার্কের দাম ছিলো খুব সম্ভব ৩৫ টাকা, দোকানি ৪০ টাকা রেখেছিলো। আমি হাতে নিয়েই আর দেরী করলাম না, বোতলের মুখ খুলেই মুখে চালান দিবো এমন সময়ে নাক মুখ কুচকে বমি আসলো! এমন বাজে, ওষুধের মতো গন্ধ আগে কখনো খাইনি! জিনিসটা মুখেও নিলাম না, মুখ লাগিয়ে লোকটাকে দিয়ে দিলাম। লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানালো যে, তিনি টাকা ফেরত দিবেন না। আম্মু কিছু না বলে আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন।
আমি বের হয়ে বললাম, “আম্মু, পার্ক খাবো (ওইটাও তখন বিটিভিতে নতুন এড দেয়)” আম্মু কোনোক্কিছু না ভেবেই, আকাশ-বাতাস কাপিয়ে গগনবিদারী আওয়াজে এক চড় মারলো! ওইদিন আমার শার্ক, পার্ক কিছুই খাওয়া হয়নাই।
গল্পটা শেষ! ইদানিং আমার এরকম আরেকটা ব্যাপারে আম্মুর কাছে বায়না ধরা উচিত ছিলো, কিন্তু আমি খুবই চিন্তিত ব্যাপারটা নিয়ে। আমি মোটামুটি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, একটা বস্তুর এত দ্রুত পসার দেখে! জিনিসটা হলো, আমাদের সবার খুব বেশী পরিচিত নয়, আর তা হলো – "সীসা" বা আধুনিক ফ্লেভার্ড হুক্কা। আমি অবাক হয়ে যাই, মাত্র বছর দেড়েক-দুই এর মধ্যে কিভাবে ক্লাস এইট-নাইনের ছেলে-মেয়েদের হাতে এই জিনিস এসে পড়লো!
গ্রাম অঞ্চলে হুক্কা খুব বেশী যে জনপ্রিয়, তাও কিন্তু না! জমিদার গোছের কিছু লোক ভাব দেখানোর জন্য গরর গরর শব্দ করে দামী হুক্কা খেত। আর কোনো দরিদ্রের খোয়াইশ জাগলে নারিকেলের খোসা দিয়ে বানিয়ে নিতো হুক্কা।
গ্রাম অঞ্চলে যেই জিনিস আজ বিলুপ্ত, শহরাঞ্চলে আজ তাই জনপ্রিয়!
কোনো এক চতুর মাধ্যমে এই মিথ্যা কথা ছড়িয়ে গেছে যে, হুক্কা/সীসা সিগারেটের তুলনায় কম বিষাক্ত মতান্তরে বিষাক্ত নয়। আর বিশ্বব্রহ্মান্ডের এই অন্যতম ডাহা মিত্থ্যে কথাতেই হোক অথবা বন্ধুদের সামনে বুক উচু করে বলার জন্যই হোক, অসম্ভব হারে স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে জিনিসটির কদর বেড়ে চলেছে। বর্তমানে একদম হাতের কাছেই বিড়ি-সিগারেটের মতোই পাওয়া যাচ্ছে। জিনিসটাতে একটা তথাকথিত "রয়াল (তাদের ভাষায়)" ভাব থাকলেও ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যেই অনায়াসে পাওয়া যায়!
আমার সবচেয়ে কষ্টটা এই জায়গায় যে, যেসব ছেলে-মেয়ে কোনোদিন সিগারেট স্পর্শ পর্যন্ত করেনাই, আজ তারা বাপের পকেট কিভাবে খালি করে ধোয়া দিয়ে পেট ভরছে দেখে! জীবনে একটা টাকা ঘুষ খায়নি, এরকম এক পরিচিত খালু। তিনি একজন প্রাক্তন সচীব।
তিনি চাইলে আজ তার কোটি কোটি টাকা থাকতো, কিন্তু সততা তার কাছে জীবনের থেকেও দামী। জীবনে কোনোদিন সকাল বেলায় তাজা মাছ কিনেন নাই তিনি। বিকেলের পর মলিন হয়ে যাওয়া মাছ কম দামে কিনে আনতেন। একজন সচীব! আজ তার ছোট ছেলে, যে কিনা আজানের আগে দৌড় দিয়ে ইফতারী ফেলে নামাজে চলে যেত, সেও এই সীসায় আসক্ত! কষ্ট কই রাখি?
আমার আরেকটা ভয়, অস্বাভাবিক হারে মেয়েরা সীসায় আসক্ত হয়ে পড়ছে! চেনা বেশ কিছু বান্ধবী সীসা নিয়ে খুব খোলাখুলি আলাপ করছে, যেনো এটা হোটেল রাজ্জাক থেকে এক গ্লাস লাচ্চি খাবার মতোই কোনো একটা ব্যাপার!
এবার একটু দেখি, সীসায় আসলেই কোনো বিপদ আছে কিনা। মাঝে মাঝে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই, নিজেকেও না! তাই, এই তথ্য খুজে বেড়ানো –
১) এই সীসার ৪টা পার্ট।
বেজ, পাইপ, বওল আর মাউথপিস। বওলটাকে এলুমিনিয়ামের কভার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় আর সেই ফয়েলের মাঝে উত্তপ্ত কয়লা রাখা হয়। যা কিনা ভেতরের টোব্যাকো (তামাক) পুড়াতে সাহায্য করে। অশিক্ষিত মাত্র জানে যে, কয়লা পুরে কার্বন মনো অক্সাইড হয়, যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে চরম ক্ষতি করে। মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
২) এই ধোয়া বেজ এ রাখা সুগন্ধী (যেমনঃ স্ট্র্যবেরী, নারিকেল, চকলেট, গোলাপ) পানির ভেতর হয়ে আসে এবং তা মাউথপিসের সাহায্যে সোজা ফুসফুসে পৌছে।
৩) রয়টার্সের নাম তো শুনেছেন? রয়টার্সের এক সংবাদ অনুযায়ী একটা পুর্ণ সেশনের সীসা গ্রহন এক প্যাকেট সিগারেট সেবনের মতোই মারাত্মক।
৪) সিগারেট এদিক থেকে একটু কম ক্ষতিকর, তবে দুটো জিনিসই ক্ষতিকর। সিগারেটে যেখানে ১-৩% নিকোটিন থাকে, সেখানে সীসাতে ব্যাবহৃত তামাক থেকে ২-৪% নিকোটিন থাকে। সুত্রঃ ড. কেনেথ, আমেরিকা একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এর প্রেসিডেন্ট।
৫) ইয়েমেন এর একটি প্রসিদ্ধ হাসপাতালের কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট ড. আহমেদ আল-মোতাররেব বলেন, “ একবার পুর্ণ ভাবে সীসা গ্রহন করা ৬০টি সিগারেট গ্রহন করবার সমান”। সুত্রঃ Journal of Periodontology (Nov. 2005)
৬) কিছু আধা শিক্ষিত মানুষ যুক্তি দেখায়, “এটা তো পানির মুধ্যে দিয়ে আসে। সব কিছু তো শোষন হয়ে যায়”। আমি তাদের দক্ষিন হাত ব্যাবহার করে বলি, “ওহে মুর্খ, নিকোটিন পানিতে প্রকৃতভাবে দ্রবীভুত হয় নারে ছাগলের ৩নম্বর বাচ্চা”
৭) সুগন্ধী, ঠান্ডা ধোয়া এবং প্রবল বিশ্বাস যে এটি ক্ষতিকর নয়, এগুলোই সীসার প্রতি মোহের একমাত্র কারণ। (সুত্রঃ ড. আল খামেরী, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
)
আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। যাদের কথা বললাম, এদের কথায় যদি তারা কান না দেয়, আমার মতো চশমা পরা, হাবাগোবা ছেলের কথায় কান দিয়ে তারা কেনো তাদের জীবনের ক্ষতি করবে! ক্ষতিই তো, আমার কথা মানলে তো সীসা বার গুলা বন্ধ হয়ে যাবে! তখন, এই জমাট বেধে আড্ডা মারা আর সীসা খেয়ে লদকা-লদকি করার মুড আসবে কোথা থেকে? আক্রমনাত্মক ভাষা ব্যাবহার করায় দুঃখিত, তবে আমার হাতে শক্তি থাকলে, চাবকায়া সোজা বানিয়ে দিতাম! বাপের নাম ভুলে যেতো, সীসা আর কি জিনিস!
এখন এদের দরকার একটা গাইডেন্স, ঠিক ক্লাস থ্রী তে থাকতে যেমন ছিলো আমার মা। যে কিনা প্রচন্ড স্নেহময়ী কিন্তু দরকারের সময় বজ্রকঠোর। তাদের এখন একটা উপযুক্ত পদক্ষেপের প্রয়জোন যেটা কিনা আমার আম্মু নিয়েছিলো! আমি খুবই শংকিত, নতুন জেনারেশন নিয়ে কেনো যে জাফর ইকবাল, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এতো আশাবাদী! এদেরকে কি জবাব দিবো? স্যার, আমরা সীসা খাই? সিগারেট খাই? ইভ-টিজিং করি? পারলে আপনারা দেশ বানায় নেন, আমাদের দিয়ে আশা করে লাভ নাই! এই কথা বলবো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।