.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা
'উদ ইউ লাইক তু হ্যাভ সাম কেইক?'
ফেডের শিশু সুলভ কন্ঠে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
'নো থ্যাঙ্কস!'
জানালাম মুড ভাল নেই, আজ আমার নানী মারা গিয়েছেন। একবার 'না' বললে দ্বিতীয়বার খাবারের জন্য এরা সাধেনা।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল কাউকে চেনা যাচ্ছেনা। আলঝেইমার রোগের শুরু টা এমনি হয়ত! কিছু পরেই দূরবর্তী কোন স্মৃতির সাথে মিলতে থাকে খুব কাছের মুখ গুলো।
তারপর আস্তে আস্তে সেটাও ম্লান হতে থাকে। এভাবে নির্বাক হয়ে ৮ টি বছর স্মৃতি শূণ্যতার প্রকোপ ধরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যাওয়া। মৃত্যু শয্যায় থেকে প্রিয়জনের সাথে শেষবারের মত দুটো কথা বলার সৌভাগ্য কতজনরই বা হয়! আকস্মাৎ কোন দুর্ঘটনা কিংবা বহুল পরিচিত হার্ট এটাক! মরার আগে কিছু বলার ছিল প্রিয় মানুষদের, সে সুযোগ ও নেই।
আলঝেইমারের ব্যাপারটি নীরব নিশ্চিত দুর্ঘটনার মতই। স্মৃতি হারানো পর থেকেই কার্যত তিনি মৃত, বলার বা ভাববার কিছু মাত্র শক্তি আর থাকেনা।
এভাবে ৮ টি বছর অথবা সঠিক করে বলতে আট বছর আগেই তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে। হয়ত বা বলারও কিছু ছিলনা। কিন্তু আমার মত তরুণ হঠাৎ ধাবমান ট্রাক টিকে সামনে দেখে স্রষ্টার কাছে কিছুটা সময় চেয়েছিল ভালবাসার মানুষটিকে জানাতে যে তাকে কত ভালবাসে সে, হয়ত কখনই মুখ ফুটে বলা হয়নি লোক লজ্জার ভয়ে। মগজ ছিটকে যাবার সাথে সাথে ভালবাসার অনুভূতি গুলো অনস্তিত্বে চলে যায়। গল্পের পাঠক ভালবাসা বিমুখ এক বর্বর স্রষ্টার মূর্তি একে নাস্তিক হয়ে পড়ে।
আর দশ বছর পরেই আমি পঞ্চাশের বৃদ্ধ ভাবলেই ভর পেটে ধরানো সিগারেট টা ভীষণ তিতকুটে লাগতে থাকে। সিড়ি ভেঙ্গে নামার সময় চোখাচোখি হয় কোন দেবী দর্শন রক্ষণশীল আরব যুবতীর সাথে, অনধিকার চর্চার ভয়ে চোখ নামিয়ে ফেলি। বাইরে গিয়েই নিকোটিনের ধোয়ায় শ্বাস টেনে অস্থির নিজেকে শান্ত করি। নাহ্, বয়স আমার বেশি নয়, তবু এ যাবৎ ক্ষুধা, শ্রম, কাগজ কালির পিছনে যে সময় ব্যায় হয়েছে বিরতি ও ক্লান্তিহীনভাবে নির্বান্ধব পরিবেশে, মনে হয় এ যেন চল্লিশ বছরের জীবন দাহ।
দেশের মানুষ তাপ দাহে আছে জানি, তবুও টানা হেচড়ার জীবনটাতে ক্লান্তি-শ্রান্তি নেই।
দেশ ছাড়ার কিছু দিন আগেই মুম্বাই আই আই টির ছেলে রাকেশের সাথে পরিচয়, একই স্কুলে গন্তব্যের সূত্র ধরে। হঠাৎ এক রাতে শুধাল আমি ম্যাট ল্যাব পারি কিনা? জানাল ম্যাট ল্যাবে একটা ফাংশন লিখে দিতে হবে, প্রোজেক্টের মাঝে এসে আটকে গিয়েছে। কালকেই আমার কোর্স প্রোজেক্ট জমা, তবু বন্ধুত্বের খাতিরে নয়, দেশের কথা ভেবে খুব সাহস করে কাজটা নিলাম। চল্লিশ মিনিটের মাথায় কোড টা মেইল করে দিলাম। তার মুগ্ধতা আর কৃতজ্ঞতা দেখে ভীষণ তৃপ্তি পেলাম নিজের দেশটাকে আরেকটু তুলে ধরতে পেরে।
এ ছোট ছোট অর্জন গুলোই বাচিয়ে রাখে কাজের স্পৃহা, এক জন নৈরাশ্যবাদীর জীবন চলা।
প্রথম দর্শনেই রাকেশের মত আমি দেখতে পাকি অথবা সাউদীদের মত! প্রায় ছ'ফুটি বাঙালি সে আশা করেনি। বিব্রত হবার কথা জানাতেই দেখি সালাম দিচ্ছে। আমিও নিয়মিত নমস্কার দিয়ে জানলাম কংগ্রেসের ঘোর সমর্থক সে, রাজনীতিতে নামার প্রবল ইচ্ছে তার। অথবা পাশের বিল্ডিং এ পরিচয় মাইক রিচার্ড কে দেখি একদিন মসজিদে জুম্মার নামায়ে, বিস্ময়ে হতভম্ভ হয়ে তার ল্যাবেরই আরেকজন কে শুধালাম।
জানাল তিন সপ্তাহ আগে সে নতুন মুসলিম হয়েছে!
ফেড ততক্ষণে ল্যাবের অন্যদের কেক সাধা শুরু করেছে। খুব রহস্য করার পর জানাল তার গার্ল ফ্রেন্ড সুদূর জার্মানি থেকে কেক বানিয়ে পার্সেল করে পাঠিয়েছে। খুব গম্ভীরভাবে বললাম,
"ইউ নো ফেড, আই শুড বি জেলাস অফ ইউ নাও!"
ফেড আমার আগা গোড়া মনস্তত্ব জানে, জেনেই হেসে বলল,
"ইউ আর সো ফানি!"
স্মিত হাসিটা চেপে চোখ ফিরিয়ে নিলাম মনিটরে আবারও কাজের দঙ্গলে যার কোন অন্ত নেই, শব যাত্রার কাল ঠিক হবার আগ পর্যন্ত ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।