আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অংকে মাষ্টার্স (আমার লেখা প্রথম ছোট গল্প)

সুখীমানুষ হাফিস সাহেব অংকের টিচার। কেউ অংকে পারদর্শী হলে সাধারণত তাকে অংকের জাহাজ বলা হয়। কিন্তু কেন যেন হাফিস সাহেবের নাম হয়ে গেল অংকে মাষ্টার্স। তিনি অংকে অনার্স করা মানুষ। মানুষের মুখে তার হয়ে যাওয়া উপাধী নিয়ে তিনি খুবই বিব্রত।

নিদারুণ অর্থকষ্ঠে তিনি মাষ্টার্স করতে পারেননি। তাই প্রায়ই দারীদ্রের প্রতি তার অনেক রাগ হয়। তিনি শিক্ষক মানুষ রাগ করা তার মানায় না। হাফিস সাহেব প্রায়ই ভাবেন দারিদ্রতা মানুষকে মহান করে, রাগান্বিত না। ছেলে বুলবুল যখন প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো তখন নজরুল রাগ করেননি বরং লিখেছিলেন- হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান।

মাঝে মাঝে মনে হয়, দারীদ্রের কারনেই অনার্স শেষ করেই চাকরীর সন্ধানে নেমে শিক্ষক হয়েছেন। শিক্ষকতাতো মহান পেশা। আজ হাফিস সাহেবের মনটা ভালো না। দুই ছেলের সাথে তাঁর আজন্ম দূরত্ব। বড় ছেলেটার আজ এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।

হয়ত এই জন্যই ভয়ে ভয়ে ছেলেটা সকাল বেলা হাফিস সাহেবের সামনে পড়েনি। সকাল থেকেই মনে মনে তিনি একটা কথাই বারবার গুছাচ্ছিলেন কি বলে বের হবেন তিনি তার ছেলেকে। একবার ভাবলেন নাস্তার টেবিলেই ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বলবেন - "“ফলাফল যাই হোক মন খারাপ করিসনা, এবার এমনিতেই অংক প্রশ্ন জটিল হইছে"”। তিনি জানেন অংক প্রশ্ন জটিল হয়নি, ছেলেটা অংকে কাঁচা, তাই সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলবেন ভেবেছিলেন। আরএকবার ভাবলেন সরাসরিই বলবেন - “ বাবাকে কেন এত ভয় পাস? রেজাল্টের সাথে বাপ বেটার কোন সম্পর্ক নাই।

যদি খারাপ কিছু হয় মন খারাপের কিছু নাই”। কিন্তু সকাল বেলা আসার সময় তিনি বড় ছেলে আবুকেও দেখলেন না, ছোট ছেলে লাবুকেও না। বিয়ের আগে ভেবেছিলেন দুঃখে দুঃখে বড় হয়েছেন। একটা চাকরী পেয়েছেন। অতএব এখন বিয়ে করা যায়।

সংসার তিনি ভরিয়ে রাখবেন ভালোবাসায়। তিনি ভালোবাসার অভাব রাখেননি সংসারে। কিন্তু ভালোবাসায় সুখ আসেনি তার সংসারে। তিনি প্রায় সময় ভাবেন তিনি তার সাধ্যের মধ্যে এমন কি কিছু আছে যা তিনি করেননি? নাহ এমন কিছুই তিনি খোঁজে পাননা। বস্তুতঃ খোঁজে পেলেতো তিনি তা করতেনই! তিনি চেষ্টো করেন, তবু পারেন না।

বিয়ের পর ঘরের বাইরে কারো কোলে কোন শিশু দেখলেই পাশ থেকে বাবুটাকে দেখে মৃদু ঢং করার চেষ্টা করতেন। সোনামনিটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হেসে, একটা হাতের আঙ্গুলটা নেড়ে বাবুটাকে একটু হাসানো যায় কিনা এই চেষ্টা করেছেন। বাসের জানালার পাশে যেদিন বসেছেন জ্যামে আটকা পড়া পাশের কোন গাড়ীতে থাকা ফুটফুটে সোনামনিদেরকে লক্ষ্য করে আদুরী হাসি হেসেছেন যেন বাবুটা একটু মজা পায়। আবার একটু ভয়ও কাজ করতো গাড়ীতে থাকা বড়রা ব্যাপারটা দেখলে কেমন ভাবে নিবেন। তবু তিনি নিয়মিত বাচ্চাদে প্রতি একটা মায়া অনুভব করতেন।

যে মায়ার উৎস অবশ্যই সাত আকাশেরও অনেক উপর পর্যন্ত বি¯তৃত। প্রায়ই মনে হতো তিনি বাবা হিসাবে খুব বন্ধু বাৎসল্য হবেন। ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের কাছে সব কথা গোপন রেখে তাঁর কাছে এসে বলবে। তিনি ওদের সাথে খেলবেন, মিশবেন, কাঁধে কাঁধ রেখে হবে সন্তানের সাথে পিতার পথচলা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

বাস্তবে ছেলেদের সাথে হয়েছে দূরত্ব। এতটা দূরত্ব যে এরা এক সাথে খেতে পর্যন্ত ভয় পায় হাফিস সাহেবের সাথে। তিনি প্রাণপনে চেষ্টা করেন দূরত্ব কমাতে, কিন্তু পারেন না। দূরত্ব যেন কমার নয়, শুধুই বাড়ার। আজ স্কুলে তিনি এসেছেন ঠিকই কিন্তু কিছুতেই মন বসছেনা।

তরুণ বয়সে অনুভব করা প্রথম ভালোলাগার অনুভূতিদের চাইতেও কোটিগুন বেশী মমতায় তার মন আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। কেবল মনে হচ্ছে ছেলে দুইটার একটাকেও আজ দেখলেন না। বড়টার আজ রেজাল্ট দিবে, একটু আদর করে আসা দরকার ছিলো। এগারোটার সময় ক্লাশ টেনের অংক ক্লাশ দিয়ে তার দিন শুরু হয়। প্রতিদিন তিনি অন্তত পাঁচ মিনি আগে ক্লাশে থাকার চেষ্টা করেন।

কারন নাম ডাকতে ডাকতে প্রথম ক্লাশের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। যদিও তিনি ক্লাশে নাম ডাকেন না। তিনি এক নজর বুলিয়ে দেখে নেন কে কে আসে নাই। যে আসে নাই তার নাম ধরে বলেন হয়ত বলেন - “আইয়ূব আলী আছস্”? সাধারণত এই ক্ষেত্রে তাঁর ভুল কম হয়। ছাত্ররা প্রায়ই একই জায়গায় বসে, এদের বসার বিন্যাসে খুব একটা হেরফের হয়না।

আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রায় হেরফের হয়না বল্লেই চলে। হাফিস সাহেব মাঝেমধ্যেই ভাবেন মেয়েরা নিশ্চয়ই গল্প করার সুবিধার জন্যই পাশাপাশি বসে। এমনকি এদের মধ্যে অবস্থান বুঝাতেও হয়ত তা কাজে আসে। ঐদিন রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তিনি খেয়োল করলেন এক মেয়ে তার পাশের জনকে বলছে - “চুন্নিটারে চিনস নাই! ঐযে ছয় নাম্বার বেঞ্চের ডান পাশে যে বসে”। আজ হঠাৎ করেই খেয়াল কারলেন টিচার্স রুম খালি।

এগারোটা তিন বাজে। তিনি খুব লজ্জিত হলেন। তারাহুরা করে চক, ডাষ্টার আর হাজিরা খাতা নিয়ে তিনি ক্লাশের উদ্দেশ্যে বের হতে গিয়ে চেয়ার এর হাতলে লেগে হুচট খেয়ে পড়তে পড়তে পড়লেননা। পাঞ্জাবিটা ছিড়ে গেল। চেয়ারে লেগেছিলো পাঞ্জাবির নীচের অংশ কিন্তু ছিড়লো কাঁধের কাছে।

তিনি একবার পাঞ্জাবির দিকে তাকালেন, সময় নষ্ট না করে রওয়ানা হলেন ক্লাশে। ক্লাশে ঢুকতে গিয়ে তিনি আরেকবার হুচট খেলেন। ক্লাশের সবাই একত্রে দাড়িয়ে বল্লো - স্যার আসসালামুআলাইকুম। তিনি প্রতিদিনই যা বলেন আজও তাই বল্লেন - দাড়ানোর দরকার নাই বাবারা, সম্মান করতে দাড়ানো লাগেনা। বসো।

তিনি আজ হাজিরা খাতা খুলতেই ভুলে গেলেন। ছাত্ররা স্যারকে দেখে একটু উদ্বিগ্ন। মারুফ ছেলেটা এই ক্লাশের সবচেয়ে চটপটে, ছাত্রও ভালো কিন্তু রুল নং অনেক পিছনে। হয় এমনই। কিছু কিছু ষ্টুডেন্ট আছে এরা সব দিক দিয়েই বেশ ভালো কিন্তু ষ্টুডেন্ড হিসাবে মাঝারি।

হাফিস সাহেব হয়ত তাই এই মাঝারী টাইপ ছেলেটাকে একটু বেশীই স্নেহ করেন। মারুফের দিকে তাকিয়ে হাফিস সাহেব বল্লেন - “বাবা আজ জানি তোদের কি পড়ানোর কথা”। মারুফ বল্লো, স্যার আওজ্জা গল্প করেন। হাফিস সাহেবের মন আবার খারাপ হয়ে গেলো। ক্লাশে ছেলেরা কত প্রঞ্জলভাবে তার সাথে কথা বলে।

ছেলেরা কেউ তাকে ভয় পায়না, সম্মান করে, পছন্দ করে। কিন্তু তিনি বাবা হিসাবে কেন দিন দিন এমন হয়ে গেলেন? তার ছেলে আবু বা লাবু কি কোন দিন কাছে এসে বলেছে “বাবা একটা গল্প বলো”। পরীক্ষার মাত্র কিছুদিন আগে তিনি বড় ছেলেটাকে মেরেছেন। ভালোই মেরেছেন। এমনিতে তিনি কোনদিন ছেলেদের পড়ালোখার খবর নেন না।

ছেলেরা বিব্রত হয়, কী দরকার? হঠাৎ করেই মনে হলো পরীক্ষা চলে আসছে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। তিনি আবুর পড়ার টেবিলে বসলেন। আবু কেমন যেন একটু ভয় ভয় দৃষ্টিতে বাবাকে দেখছে। হাফিস সাহেবের মিজাজ গরম হয়ে গেল। আরে আমি তোর বাপ, তুই আমারে ভয় পাবি কেন! তারপরেও তিনি মাথা ঠান্ডা রেখেছেন।

একটা খাতা টেনে লিখলেন এক্স গুনন এক্স। এরপর বল্লেন সমান সমান কত? লাবু কিছুটা উদাস, কিছুটা ভয় নিয়ে লেখলো টু-এক্স। হাফিস সাহেব বল্লেন তাহলে এক্স প্লাস এক্স কত? এবার আবু সত্যিই ভয় পেলো। কারন সে জানে ভুল করেছে। এক্স গুনন এক্স হবে এক্স-স্বয়ার, আর এক্স প্লাস এক্স হবে টু-এক্স।

কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবুর মনে হলো তার উপর বুঝি বিল্ডিং ভেঙ্গে ইট পাথর পড়ছে। হাফিস সাহেব নিজের অজান্তেই ছেলেটাকে অনেক মারলেন। অনেক। মারুফ গল্প করতে বলেছিলো হাফিস সাহেবকে। তিনি গল্প না করে চুপচাপ ভাবছেন।

তিনি ভেবে পাচ্ছেননা ছেলেটাকে কেন সেদিন তিনি এত মারলেন? এক অপরাধবোধ ও অপার এক মায়ার সমন্বয়ে হাফিস সাহেব আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। তিনি খেয়ালও করলেন না তার চোখ ভিজে ওঠেছে। তিনি পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছে বল্লেন - বাবারা আজ আর ক্লাশ নিবোনা, তোমরা গন্ডগোল করোনা। তিনি আলাদা করে কথা বলার সময় তুই করে কথা বলেন ছাত্রদের সাথে। আর সবাইকে সম্বোধন করলে তুমি করে সাধারণত বলেন।

ধীর পায়ে তিনি ক্লাশ থেকে বের হয়ে সরাসরি বাসার দিকে হাটা শুরু করলেন। তাঁর হাতে রয়ে গেল হাজিরা খাতা, চক ডাষ্টার। আশেপাশের সবাই হাফিস সাহেবের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। ছেড়া পাঞ্জাবীর অংশটা আরো বড় হয়েছে। বাম পাশের কাঁধটা প্রায় সবটাই বের হয়ে আছে।

তিনি মনের কোথায় যেন একটা বড় ধরনের অঘটনের পূর্বাভাস পাচ্ছেন। তাঁর খুব সখ ছিলো ছেলেটাকে অংকে মাষ্টার্স করাবেন। পিএইডি করাবেন। ছেলের নাম হবে ড. আবু হাফিস। অভাব অনটনের কারনে তিনি মাষ্টার্স করতে পারলেন না।

তবু তার নামটা জুড়ে থাকবে ছেলের নামের শেষে। আর ছেলের নামের প্রথমে থাকবে ড এর পর একটা ফোঁটা। শিক্ষকরা জাতির মেরুদন্ড। তিনি তাঁর ঘরের জন্যই মেরুদন্ড হতে পারলেন না। জাতির জন্য কী হবেন? মায়া মমতাই সব না সংসারে।

বুদ্ধির প্রয়োজন অনেক বেশী। মায়ামমতা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতেও বুদ্ধি লাগে। এই বুদ্ধির প্রয়োজন তিনি তার জীবনে খুব অনুভব করেন। আজ কেবলই মনে হচ্ছে তিনি কোথায় যেন কি পারেননি। তিনি অন্যের ছেলেমেয়েদের অসীম মমতায় বাবা ডাকেন, বাজান ডাকেন, মা ডাকেন, মমনি ডাকেন।

কিন্তু নিজের সংসারে কোথায় সেই লজ্জা, কোথায় সেই বাঁধা কাজ করে তিনি জানেননা। তিনি বাসার পথে হাঁটছেন আর কেবলই মনে হচ্ছে ছেলেটাকে পরীক্ষার আগে এমন করে মাইর দেয়া ঠিক হয়নি। তাঁর নিজের স্বপ্ন কেনইবা তিনি চাপাতে যাবেন ছেলের উপর? প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজের মত করে বড় হবে। হাফিস সাহেব যতই বাড়ীর কাছে যাচ্ছেন অতই যেন বুকের ভিতর ধুক ধুক করছে। ভরা দূপুর, শুনশান নিরবতা।

বাড়ীর কাছাকাছি এসে তিনি দেখলেন বাড়ীতে মানুষের জটলা। তাঁর হাত, পা ভার হয়ে এলো। হাফিস সাহেব ঢুকরে কেঁদে ওঠলেন। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আর অস্ফুট উচ্চারণ করলেন... আবু.. আবু... । ২-১০-১১, ঢাকা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৭৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।