আমি একজন সাধারণ ব্লগার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বেসরকারি 'রেডিও এবং টেলিভিশনের কার্যক্রম তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য' প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে।
জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি এর খসড়া পরিমার্জনের জন্য ফেরত পাঠালেও নাগরিক সমাজে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের আতঙ্ক দূর হয়নি। এ ব্যাপারে প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে পুরনো দিনের সিনেমা দেখানো ছাড়া টেলিভিশনগুলোর কোনো কাজ থাকবে না। নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমদ বলেন, এই নীতিমালা ইতিহাসের কালো দলিল হয়ে থাকবে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল, 'সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে'।
বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতিসংঘের আর্টিকেল ৩৯ অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলে প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালার খসড়ার অনেক প্রস্তাবই দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, 'প্রতিটি বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনের কার্যক্রম তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য নীতিমালা করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়'। নীতিমালায় বিধান রাখা হয়েছে লাইসেন্স সংক্রান্ত ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগের। যে কমিটি সংবাদ, বিজ্ঞাপন বা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বেসরকারি রেডিও বা টিভি চ্যানেলগুলোতে নীতিমালা অনুসরণ ও বাস্তবায়ন তদারকি করবে। এই কমিটি লাইসেন্স কার্যাবলি পরিচালনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।
এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী , 'সরকার বা সরকার অনুমোদিত প্রতিনিধি যে কোনো রেডিও বা টেলিভিশন (বিনা নোটিসে) পরিদর্শন এবং জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এই নীতিমালার আরও কিছু বিষয়কে বিশেষজ্ঞরা সুষ্ঠুভাবে মিডিয়া পরিচালনার জন্য হুমকি মনে করছে। নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, বেসরকারি রেডিও বা টিভি চ্যানেলের যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পর্কে 'যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই নীতিমালার আলোকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে এবং কর্তৃপক্ষ ৯০ দিনের মধ্যে সে অভিযোগের আলোকে যে কোনো রেডিও বা টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে'। অর্থাৎ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্স বাতিলও করা যাবে। এক্ষেত্রে নীতিমালার সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, 'অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট রেডিও বা টিভির লাইসেন্স সরাসরি বাতিল বা স্থগিত করে দিতে পারবে।
' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এ ব্যাপারে বলেন, আমি খুবই হতাশ! একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার কী করে এমন চিন্তা করতে পারে! গত নির্বাচনে বিজয়ে পিছনে এই গণমাধ্যমের যে বিশাল ভূমিকা ছিল আওয়ামী লীগ কী তা অস্বীকার করতে পারবে?
আসলে কোনো সরকার যখন জনগণ ও নাগরিক সমাজকে ভয় পেতে শুরু করে তখন সেই ভীতি থেকে সে এমন আচরণ করতে শুরু করে যা তার করা উচিত নয়। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, নাগরিক সমাজ ও জনগণের প্রতি ভীতি থেকেই সুশাসন ও গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী এমন নীতিমালা করতে সরকারকে প্ররোচিত করেছে। প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালায় সরকার শুধু খবরদারি করেই তার দায়িত্ব শেষ করতে চায়নি। কীভাবে বেসরকারি রেডিও টিভি সুষ্ঠুভাবে চলতে পারবে, তারও দিক নির্দেশনা খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে। যেমন, 'রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি এবং সরকারের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠান রচনা করতে হবে'।
'তথ্য পরিবেশন, শিক্ষার প্রসার, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সরকারকে উদ্বুদ্ধকরণ ও নির্মল আনন্দদান-এই চারটি হবে অনুষ্ঠান প্রচারের মূল লক্ষ্য'। 'বেসরকারি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্ম অ্যাক্ট '৬৩ বা তার অধীন প্রণীত বিধি-বিধান আনীতিমালার পরিপন্থী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না'। 'অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করা যাবে না'। 'কোনোক্রমেই কোনো অঞ্চলের প্রতি কটাক্ষ করার জন্য আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা যাবে না'। 'অনুষ্ঠানে কোনো প্রকার অশোভন উক্তি উচ্চারণ করা যাবে না'।
'প্রত্যেক রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেলের সুনির্দিষ্ট চার্টার অব ডিউটিস থাকতে হবে'। 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টেলিভিশন বা রেডিও বা অনুষ্ঠান পরিচালক জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে'। 'বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো প্রচারণা করা যাবে না'। 'বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বিজ্ঞাপনও প্রচার করা যাবে না'। 'ধর্ম বিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে"।
'সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করা যাবে না'। 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য বা হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না'।
প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা এ ব্যাপারে বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো স্বাধীনভাবে সংবাদ এবং টক শো সম্প্রচার করতে পারবে কিনা জানি না। নানাভাবেই এসব অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হবে। পুরনো দিনের সিনেমা দেখানো ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, যখন কেউ বুঝতে পারে পায়ের নিচে মাটি নেই তখন হতাশা থেকে নানা প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চায়। যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় কেউ ব্যর্থ হয় বা আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে তখনো তারা এ কাজটি করে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী গণমাধ্যমের উপর যারা আঘাত হেনেছে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। এটা বাস্তবায়ন করলে এরাও পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এম আকবর আলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের কাজ নয়।
আর করতে চাইলে প্রচলিত আইন দ্বারাই তা সম্ভব। সরকারের উচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বেতার ও টেলিভিশনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। অতীতের সরকারগুলো এ বিষয়ে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেনি। বর্তমান সরকারের উচিত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। দেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি স্বরূপ বিবেচিত হয় এমন আইন বা নীতিমালা না করে তা প্রত্যাহার করে নেওয়াই হবে সবার জন্য ভালো।
ইংরেজি দৈনিক নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারে যারা থাকে তারাই হঠাৎ গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ মনে করতে শুরু করে। এক সময় তারা কিছু তথ্য প্রকাশ হতে দিতে চায় না। কিছু তথ্য লুকিয়ে রাখতে চায়। তখন তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করতে চায়। আমাদের দেশে বারবার এমন ঘটনা ঘটেছে।
তবে যারাই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছে ইতিহাসে তাদের গতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যম সাংবাদিকতা আছে, থাকবে। এদিকে তথ্য মন্ত্রাণালয় সংক্রান্ত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি প্রস্তাবিত নীতিমালার কিছু বিষয় পরিমার্জন করার জন্য ফেরত পাঠিয়েছে। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় বাস্তবে তা কতটা করবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সার্বিক অবস্থা নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের একটি সংবিধান রয়েছে।
একটি নির্বাচনী ম্যানুফেস্টর রয়েছে। তাই মন্ত্রণালয়কে বলেছি, প্রস্তাবটি সংবিধান ও নির্বাচনী ম্যানুফেস্টরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিশীলিত ও পরিমার্জনা করে উপস্থাপন করতে। জনমত যাচাইয়ের জন্য ওয়েবসাইটেও দিতে বলেছি। বলেছি বিশ্বের অপরাপর সম্প্রচার নীতিমালাগুলো পর্যালোচনা করে দেখার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।