আবারও মৌলবাদের উদ্যত ফণা!
ফকির ইলিয়াস
======================================
আবারও সংঘবদ্ধ নাশকতার চেষ্টা করেছে একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দল। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিলের নামে '৭১-এর পরাজিত এ শক্তি তৎপর হয়েছে। পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছে। রাজনৈতিক এ দলটি বিষধর সাপের মতো বাংলাদেশে সংগঠিত হচ্ছে। সে খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় গেল ক'মাসই প্রকাশ হয়ে আসছিল।
বাংলাদেশকে তাদের মতো করে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে চায় জামায়াত- এমন তথ্য প্রকাশ করেছে উইকিলিকস। বিষয়গুলো নতুন কিছু নয়।
জামায়াত নামের রাজনৈতিক সংগঠনটি মূলত জন্ম নিয়েছিল চরম সুবিধাবাদের ওপর ভর করে। এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবুল আলা মওদুদী যেসব তত্ত্ব বিতরণ সে সময় করছিলেন, তা ছিল তৎকালীন সমসাময়িক হক্কানি আলেমসমাজ দ্বারা ঘৃণিত। রাজনৈতিকভাবেও মওদুদীপন্থিরা ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান-ভারতের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে।
পরে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে পাকিস্তানের বশ্যতা তারা মেনে নেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রাম করে তখনো জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষে দালালি করে। পরে তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তারা 'বাংলাদেশ'-এর বশ্যতা মেনে নিয়ে সে মৌলবাদী রাজনৈতিক চর্চা শুরু করে।
তাদের এই যে মুখোশ পরার রাজনীতি, তা নতুন নয়। এরা সময়-সুযোগ পেলেই মেধাবী গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে ভেঙে চুরমার করে দেয়ার প্রয়াসী হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই মৌলবাদী চক্রটিকে বাংলাদেশে মদত দিয়েছে একটি রাজনৈতিক শক্তির ছায়া, যারা নিজেদের প্রগতিবাদী মনে করেন। সমান্তরাল বলয় থেকে আওয়ামী লীগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপিবিরোধী যে আন্দোলন করেছিল তাতে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছিল এই পরাজিত মৌলবাদীরা। আর সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক পুনর্বাসন পাকাপোক্ত করে। '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই আলবদর নেতা নিজামী ও মুজাহিদ পরে বাংলাদেশের মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত পাওয়ার সুযোগ লাভ করে।
এটা কারও অজানা নয়, বিএনপি একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক দল।
তাদের জন্মই হয়েছিল ধর্মীয় লেবাসকে অবলম্বন করে। যদিও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাসহ জন্মদাতা স্টিয়ারিং কমিটির কেউই বড় রকমের কোন ধার্মিক ছিলেন না। অথচ লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছে, এরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নগ্ন সুবিধা নিতে সবসময় ব্যস্ত থেকেছে।
খুবই অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কিছু প্রগতিবাদী, বামপন্থি, মুক্তিযুদ্ধের নায়করাও শেষ পর্যন্ত এ ডানপন্থি রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চেয়েছেন। প্রকারান্তরে তারা এ ভূখন্ডে মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী শক্তির বিস্তারকে ত্বরান্বিত করেছেন।
ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা টিকে থাকার জন্য যে কোন অপশক্তির সঙ্গেও যে আঁতাত করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তৈরি করেছেন বিএনপির এমন প্রগতিবাদী নামধারী অনেক নেতা।
বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্তদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে। এই বিচারকাজকে বাধা দেয়ার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং হবে, তা সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। সিলেটে সম্প্রতি মৌলবাদী একটি চক্র মিছিল করে গোলযোগ বাধানোর চেষ্টা করেছে। এর ক'দিন পরই ঢাকায় এরা চড়াও হয়েছে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর।
সুযোগ পেলে তারা যে বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে, এসব কর্মকান্ড এরই পূর্ব লক্ষণ।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিএনপি এবং জামায়াত একই সমান্তরালে আন্দোলনের একটি মওকা তৈরি করতে চাইছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২৭ সেপ্টেম্বরের পরই 'মহাকর্মসূচি' ঘোষণা করা হবে। এর আগেই তাদের মদতপুষ্ট মৌলবাদী পেটোয়া বাহিনী রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের যোগসূত্র যে খুবই ঘনিষ্ঠ, তা না বোঝার কোন কারণ নেই।
বিএনপি চেয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পরপরই নতুন নতুন ইস্যু দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে। তারা তা পারেনি। মূলত তারা কোন ইস্যুই খুঁজে পায়নি। কারণ তিস্তার পানি চুক্তি বনাম ট্রানজিট ইস্যুতে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলো ফিকে হয়ে যায়। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে বিএনপি তাৎক্ষণিক কোন আন্দোলন সূচিই দিতে পারেনি।
এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিএনপি কৌশলে তাদের মিত্র মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের অগ্রবর্তী টিম হিসেবে মাঠে নামাতে চাইছে। ঢাকায় হঠাৎ করেই মৌলবাদীদের মারমুখী অ্যাকশন এরই পূর্ব পরিকল্পনা।
এই যে পরিকল্পনার ছক, তা ছিন্ন করেই সরকারকে সামনে এগোতে হবে। আর সেজন্য সরকারের আত্মবিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমরা দেখছি সরকারের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন কর্মকান্ডে দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন।
হাঁপিয়ে উঠছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারের উদাসীনতা, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রয়োগের নিশ্চয়তা, বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি দলের ক্ষমতাবানদের অবৈধ দাপট এ মুহূর্তে গণমানুষের তীব্র উষ্মের কারণ। বিনীত অনুরোধ করি, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি যেন তাদের গত নির্বাচনী এজেন্ডাগুলো ভালো করে পড়ে দেখেন- তারা কী বলেছিলেন আর কী করছেন!
শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার মন্ত্রিসভার কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে মন্ত্রিত্ব খারিজ হয়ে যাবে। তাহলে কী দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী? না হলে এমনটি বললেন কেন?
বলা দরকার, সামনের আড়াই বছর সরকারের জন্য কুসুমাস্তীর্ণ সময় প্রতীক্ষা করছে না। অনেক প্রতিকূলতা সরকারকে অতিক্রম করতে হবে।
এর জন্য সরকার কতটা প্রস্তুত? গণতন্ত্র রক্ষা কঠিন কাজ। আর বিশেষ করে যে ভূখ-ে জঙ্গিবাদীদের দোসর ষড়যন্ত্রে মাতোয়ারা থাকে সে মাটিতে সব দিকে চোখ-কান খোলা রাখা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতির পেছনে ছুরিকাঘাত করার জন্য একটি গ্রুপ আগেও ছিল, এখনো আছে। বর্তমান সরকারের শীর্ষদের উচিত, মোসাহেববেষ্টিত না থেকে দেশের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা। তা না করতে পারলে মহাজোট সরকারকে রাজনীতিতে হোঁচট খেতে হতে পারে।
নিউইয়র্ক, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ শুক্রবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।