আমি মানুষ, আমি অনন্য, আমি ধ্রুব । “আস্তে আস্তে চেষ্টা কর আশা মণি , তুমি পারবেই!”
চোখের ব্যান্ডেজ খোলার প্রতিটিই পরতে পরতে এক অজানা কোনও অনুভূতিতে ডুবে ছিলাম । কিন্তু তুলা সরানোর পর কিছুতেই চোখ খুলে তাকাতে পারছিনা । অজস্র আলোর ঝলকানি যেন প্রতিরোধ গড়ে তুললো আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নের বিরুদ্ধে ।
“হ্যাঁ , এইতো হচ্ছে ! আস্তে আস্তে চোখ খোলো বোন , তোমাকে পারতেই হবে ।
”
উফফ! ডাক্তার আপা সেই কখন থেকেই বকবক করে যাচ্ছেন , একবার বলে মা আর একবার বোন । আমি এই মুহূর্তে চোখ না খুললে হয়ত তিনি হার্ট অ্যাটাকও করতে পারেন !
না, আমাকে পারতেই হবে ! শুধু কল্পনায় আঁকা পৃথিবীকে বাস্তবে দেখবো বলেই নয়, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম এক মমতাময়ী নারীর প্রতিচ্ছবি দেখার জন্য ; যার দুচোখ দিয়ে দেখবো আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নের পৃথিবী । তবু অজানা কিসের আশঙ্কায় কেঁপে উঠছিল হৃদয় ।
মাশাল্লাহ! কি নিষ্পাপ মায়াবী মুখ । ঠিক আমার দিকে তাকিয়েই যেন বসে আছে ।
ঝাপসা দৃষ্টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগলো । “আমি দেখতে পারছি!”, অস্ফুট কণ্ঠে একটা চিৎকার দিলাম । “আপা, আমি দেখতে পারছি !” এইবার যেন আমার সমগ্র অস্তিত্ব চিৎকার দিয়ে উঠলো ।
কিন্তু এ কি! সেই নিষ্পাপ চেহারাটি কোন জীবিত মানুষের নয় , ফ্রেমে বাঁধানো মধ্য বয়স্ক এক নারীর প্রতিকৃতি । “ ইনিই কি সেই মমতাময়ী নারী?”, আবেগ জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলাম ।
“হুম, যাকে তুমি প্রথম দর্শনেই দেখতে চেয়েছিলে । আর এই নাও,” একটা হলুদ খাম এগিয়ে দিলেন ডাক্তার আপা, “তোমার জন্য লেখা তাঁর শেষ চিঠি !” অতি যত্নের সাথে খুলতে লাগলাম চিঠিটা, মনের অজান্তেই হাতটা বারবার কেঁপে উঠছিল ।
................................................
প্রিয় আশা মণি,
আমি তোমায় কখনো দেখিনি, তবুও তুমি আমার অনেক প্রিয় ! কেননা, আমার দুচোখের স্বপ্ন আজ তোমার দুচোখে –আমার আনন্দ অশ্রু ঝরবে আজ থেকে তোমার অশ্রু জলে ।
কি এক মরণ ব্যাধি যেন বাসা বেঁধেছে শরীরে, হাসপাতাল এর বিছানায় শুয়ে তাই মৃত্যুর প্রহর গুনছি । আপনজনেরা রক্তের জন্য শুধু শুধু দৌড়াদৌড়ি করছে ডোনার ক্লাব গুলোতে , জানি কোন লাভ নেই ।
ও আচ্ছা, ডোনার ক্লাব এরই এক সদস্যের কাছে তোমার গল্প শুনলাম । জানলাম তোমার কল্পনার পৃথিবীর কথা !
তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না এই দুনিয়াটা তোমার কল্পনার পৃথিবীর চাইতেও কত্ত সুন্দর ! আমারও খুব ইচ্ছে করে – সবুজ অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ি ঝর্ণার কোলে দেখবো হিম শীতল জলধারা, কাশফুল বিছানো নদীর তীরে বসে দেখবো পালতোলা নৌকার বয়ে চলা ; বিশাল কোনও পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখবো দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর, কিংবা সমুদ্রের বেলাভূমিতে বসে দেখবো শেষ বিকেলের রক্তিম প্রহর !
না, সংসারের মায়াজালে আটকে পরে কখনো পারিনি এই মধুর স্বপ্নগুলো পূরণ করতে । অথচ তুমি অন্তরের আলোয় কল্পনাতেই গড়ে তুলেছ তোমার ‘অবাক পৃথিবী’ ! আর আমি আল্লাহর অশেষ নিয়ামত এই অপূর্ব দৃষ্টির আলো পেয়েও দেখতে পারিনি তাঁর সৃষ্টির যত সৌন্দর্য, যত বৈচিত্র্য !
জানি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, পৃথিবীর ঐশ্বর্য দেখার এই তৃষ্ণা কখনই মিটবে না । যখন এই চিঠিটা পরবে তখন হয়ত চলে যাব তোমার অবাক পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে । কিন্তু, তোমার তো কেবল শুরু ! জীবনের প্রতি মুহূর্ত কে রাঙিয়ে দিয়ো তোমার কল্পনার রঙে -
আর সন্ধান করিও জগতের যা কিছু সুন্দর যা কিছু ভালো,
আমার তৃষ্ণার্ত নয়নে জ্বালিয়ে দিয়ো তোমার অন্তরের আলো!
ইতি,
তোমার ‘অবাক পৃথিবী’র শুভাকাঙ্ক্ষী
................................................
[পুনশ্চঃ
অন্ধত্বের অভিশাপ ঘোচাতে যারা করে গেলো মরণোত্তর চক্ষুদান,
সেইসব সাহসী ও মহৎ মানুষদের তরে জানাই সশ্রদ্ধ সম্মান !]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।