আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্টমার্টিনের পথে ; মৃত্যুর দুয়ার থেকে

আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। কিস্তি :৬৬: সেন্টমার্টিনের পথে ; মৃত্যুর দুয়ার থেকে সাগর আমাকে প্রচণ্ড টানে, আকাশের চেয়ে সাগর আমার ভালো লাগে বেশি। সাগরের বুকে মুদ্রিত পুরোটা আকাশ দেখতে আমি বার বার যাই সমুদ্রে। সেইবার একেবারেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলাম আমরা।

প্রথম দলগত ভাবে আমরা যাচ্ছিলাম সেন্টমার্টিন। চট্টগ্রামে বিরতিতে ‘কুরা’ দিয়ে রাতের খাবারের পর বাস চলছে। সকালে পৌছালাম টেকনাফে। সে সময় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টি যেতো হতো ট্রলারে। ট্রলার ছাড়তো টেকনাফ বাজারের ব্রিজের গোড়া থেকে।

সেখানেরই একটা রেস্টুরেন্টে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে রওয়ানা করলাম। ২০০০ সালের ঘটনা এটা। এবারই প্রথম দলগত ভাবে সেন্টমার্টি যাচ্ছ্ িঅন্য রকম একটা উত্তেজনা কাজ করছে। সাধারণত সে সময় ট্রলারে সকালের দিকে যাত্রা করার নিয়ম, কিন্তু আমাদের পুরনো পর্যটক ভাইয়েরা সময়কে গুরুত্ব দিলেন না। দুপুরের খাবারে পর নৌকা চলছে।

টেকনাফ বাজার থেকে খাল বেয়ে আমরা নাফ নদীতে পড়লাম। নৌকা টলছে। এটাকে গুরুত্ব দেয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ নৌকা মাতালের মত না দুললে ভ্রমণ আনন্দময় হয় না। আমি ও বাবু সামনের দিকে বসেছি।

নৌকার এ জায়গাটা আমার ভীষন ভালো লাগে। সাগর কিম্বা নদী-লেক সবখানে নৌকার সামনে বসে জল ছুঁয়ে যতে আমার ভালো লাগে। আসলে আমি আগাড়োই একটু ভিন্নতা পছন্দ করি! কিছুক্ষণ পর আমার পাশে এসে বসলে রনি চাকমা, তার পাশে প্রজ্ঞা জুঁই ত্রিপুরা ও রুমি তঙচইঙ্গা। নৌকা চলছে। নাফ নদীতে পড়ার আগে আমি সালেহীন ভাইয়ের গীটারের আজাইরা হাত বুলাইতে লাগলাম।

সে সাথে একটা বেসুর ট্রলার জুড়ে। কিন্তু নৌকার লাফানি দেখে সবাই একটু যেন ভয় পাইলো। সালেহীন ভাই বললো এইটা কিচ্ছু না। মাহবুব ভাই তার পুরনো গল্প শোনাচ্ছেন। শহীদ ভাইও সাহস দিচ্ছেন।

রনি ও প্রজ্ঞা কালেমা পড়ছে। আমরা তখনো হাসি আড্ডা এবং আনন্দময় মুডে। তবে ট্রলার যখন সাগরে পড়লো তখন আর আনন্দ ছিল না। তখন মধ্যদুপুর। এখন তো নাফ নদী পার হলে সেন্টমার্টিন দেখা যায়, সে সময় সেন্টমার্টিন দেখার জন্য আমরা বাইনোকুলারে চোখ রেখেও দেখতে পাচ্ছি না।

সমুদ্রের পাহাড়ের মত প্রচণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সে সাথে আমাদের নৌকা প্রচণ্ড রকমের দুলছে। মনে হচ্ছে এখনই ডুবে যাবে। আমাদের নৌকার দুজন চালকের একজন বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো। মাঝি বলছে, তার তিরিশ বছর ধরে এই রুটে চলাচলের মধ্যে আজই এ রকম একটা বিপদে পড়লেন।

আমরা সবাই আল্লাহ আল্লাহ করছি। পথ যেন শেষ হচ্ছে না। সে সময় সেন্টমার্টিন পৌছাতে সাধারণত ট্রলারে ৫ ঘণ্টার মত সময় লাগতো। কিন্তু আমরা পৌঁছাতে পারি ৬ ঘণ্টা পরেও। ট্রলারের মধ্যে আমরা ৪৫ জনের মত।

সাগরের মাঝখানে আসতে আসতে প্রায় সবাই বমি করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। অনেকে অর্ধ অচেতন। বমি আর সাগরের লবণ পানিতে সবার কাপড় চোপড় মাখামাখি। আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম, এটি আমাদের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহুর্ত। পকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড, পায়ে থাকা জুতাটা খুলে রাখলাম।

একটা দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাবু। আমরা সব মিলিয়ে গোটা দশেক মানুষ তখনো সাগরের এই উন্মত্ত আবহাওয়াটা উপভোগ (!) করছিলাম। জীবনের পুরনো দিনের বিভিন্ন স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে সাথে করার বিভিন্ন পাপের ছবি। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ কয়েকটি ক্ষন কাটিয়ে নিচ্ছি।

ভাবছিলাম মৃত্যুর পর কী হবে, লাশটা কোথায় পাওয়া যেতে পারে? এ সব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে আমরা সেন্টমার্টিন এসে পৌছালাম। যখন ট্রলার তীরে দেখা গেলেআ বাবু যে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সেটি কোথাও বাঁধা ছিল না। তানিম ভাই যে বাঁশটা ধরে দাঁড়িয়েছিলেন সেটিও কোথঅও আটকানো ছিল না। ট্রলার থেকে নামলাম সন্ধ্যায়। কারো মুখে হাসি নেই।

যাদের জ্ঞান নেই তাদের নামানো হল তীরে। ডাক্তার ডাকা হলো। সবাই সুস্থ হতে হতে রাত। আমরা সেবার উঠলাম সেন্টমার্টিনে সরকারি একটি বাংলোয়। ওই বাংলোয় ছেলেরা দুই রুমে নিচে ফোরিং করে থাকলাম।

গাদাগাদি করে। সেই এক অমানবিক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যার পরে সবাই একটু একটু করে কথা বলছিলাম, ভাবছিলাম কীভাবে ফিরব। পরের দিন অনেকে বললেন, হেলিকপ্টার ছাড়া ফেরার অসম্ভব। তবে শেষ পর্যন্ত সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দুদিন পর আমরা বঙ্গপোসাগর পাড়ি দিলাম, মনে হলো পুকুরের ওপর দিয়ে ট্রলার চলছে।

সেই ভয়ঙ্কর রূপে একবারই বঙ্গপোসাগর আমার চোখে ধরা পড়েছিল, এরপর আর কখনো এমন রূপ তার দেখিনি। দেখতে চাইও না। সাগরের উতল ভাব আমার বরাবরই ভালো লাগে। কিন্তু এতটা ভয়ঙ্কর রূপ আমি ভাবতে পারি না। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই ট্যুরের স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভাসে।

পাহাড় সমান ঢেউ, সেই ঢেউয়ের মাথায় আমাদের নৌকা। ধপাস করে পড়ছে ঢেউয়ের কারণে সৃষ্ট পানির গর্তে। সবাই ভিজে যাচ্ছি। আবার নৌকা ঢেউয়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে। এ ভাবে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।

ভাবা যায়! যায়, আবার যায় না। তবুও আমার জীবনের পর্যটনের একটি অন্যতম আনন্দময় ট্যুর গয়ে আছে সেই সেন্টমার্টিন ভ্রমণ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।