সেই গল্পটির কথা আমরা কে না জানি? একদল বালক কুয়োর মধ্যে আটকা পড়া কিছু ব্যাঙকে ঢিল ছুড়ছিল। এর মধ্য থেকে একটি ব্যাঙ অবশেষে চিৎকার করে বলল : 'হে বালকগণ, তোমরা আর আমাদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ো না। তোমাদের জন্য যা খেলা, আমাদের জন্য তা মরণ। ' গল্পটির কথা মনে হলো ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষার সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু পরীক্ষার্থীর ফোন আর সাক্ষাৎ-আলাপকালে। ফেসবুকেও কেউ কেউ সেঁটে দিয়েছে তাদের এই উদ্বেগের পোস্টার।
পরীক্ষার্থীরা তাদের এই উদ্বেগের কথা আমাকে জানাচ্ছে গত মাস থেকেই। উদ্বেগের কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার এটাও মনে হলো, ব্যাঙগুলো তো তাদের প্রতি ঢিল নিক্ষেপকারী 'উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ' অর্থাৎ বালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল, কিন্তু এই পরীক্ষার্থীরা সেই দৃষ্টি আকর্ষণেও ব্যর্থ! পরীক্ষার্থীদের এই উদ্বেগের সত্যি কারণ আছে। পিএসসির ইচ্ছে থাকলেও সংগত কারণেই বিসিএস পরীক্ষা প্রতিবছর অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন ক্যাডারের পদ-চাহিদা, সমন্বয় এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ একটি কঠিন কর্ম। আমি জানি, একটি সাধারণ বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রায় দক্ষযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়।
এটি একটি পাবলিক পরীক্ষা হওয়ায় পিএসসি কর্তৃপক্ষকে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য নির্ভর করতে হয় বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। তারা পরীক্ষা গ্রহণের হল বা স্থান দিলে তবেই পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়। একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠানে এ পরীক্ষা গ্রহণ করার উপায় থাকে না। কারণ পরীক্ষার্থীদের সংখ্যাধিক্য। লিখিত পরীক্ষায় অবশ্য আসন সংকুলানের চাপটা অনেকাংশে কমে যায়।
আলোচ্য বিষয়ে আশার স্থান এটাই।
বেসরকারি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির দুয়ার উন্মুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রত্যাশিত একটি সরকারি চাকরি। শুধু প্রত্যাশিত নয়, বহুল প্রত্যাশিত। আর তা যদি হয় 'প্রথম শ্রেণীর' সরকারি চাকরি, সেটা সত্যি 'সোনার হরিণ' তার কাছে; শুধু তার কাছে নয়, পুরো পরিবারের কাছে। পরিবারের কাছে এ কারণে যে, এখনো আমাদের সমাজে সন্তানের আয়-উপার্জনের ওপরই পরবর্তীকালে মাতা-পিতারা নির্ভর করে থাকেন, ছোট ভাইবোনরাও।
আর সে সন্তান যদি হয় সংসারের বড়_তাহলে তার ওপর প্রত্যাশার মাত্রাটা থাকে আকাশচুম্বী। তাই প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরি পাওয়ার পরীক্ষায়, অর্থাৎ বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছে থাকে প্রতিটি শিক্ষার্থীর। কিন্তু ওই যে বললাম, সংগত কারণেই পিএসসি কর্তৃপক্ষের প্রতিবছর পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। আর এ কারণে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর একটি-দুটি বিসিএস পরীক্ষার বেশি সুযোগ খুব কম ছাত্রছাত্রীই গ্রহণ করতে পারে। পাস করার পর একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর বাড়তে থাকে চাকরি পাওয়ার চাপ আর দ্রুত কমতে থাকে তার চাকরি পাওয়ার সময়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে পাস করার পর একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ত্রিশ বছর হতে খুব বেশি সময় আর বাকি থাকে না।
৩১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। বিসিএস ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো চাকরি-পরীক্ষায় সম্ভবত এত বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেয় না। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর লিখিত পরীক্ষার জন্য খুব বেশি পরীক্ষার্থী নির্বাচিত বা বাছাই করা হয় না। অতীতে দেখা গেছে, লিখিত পরীক্ষার জন্য গড়ে প্রতি পদের বিপরীতে ৯ থেকে ১০ জন পরীক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়েছে।
এবার প্রায় দেড় লাখ প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থীর মধ্যে দুই হাজার ১০৮টি ঘোষিত পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে ১০ হাজার ২১২ জনকে। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে গড়ে এবার পাঁচ জনেরও কম পরীক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছে লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। পিএসসি সাধারণত বিজ্ঞাপনে ঘোষিত পদের চেয়ে কিছু বেশি পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে, অতীতে এমনই দেখা গেছে। তাহলে প্রতি পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষার্থীর গড় সংখ্যা এবার আরো কমে গেল। এ অবস্থায় যারা ৩১তম লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েছে তাদের সামনে প্রত্যাশা বেশি এবং প্রত্যাশা বেশি বলেই প্রতিযোগিতাটাও সর্বোচ্চ পরিমাণে হওয়ার কথা।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিতদের অন্তত ১০ শতাংশ পরীক্ষার্থী, যারা সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী (মোট জনসংখ্যার বিবেচনায়), লিখিত পরীক্ষায় ভালোভাবে তারা অংশ নিতে পারবে না। কারণ তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আর এই লিখিত পরীক্ষাই বিসিএসের মূল পরীক্ষা। দুর্গাপূজা যেহেতু সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয় এবং এটি যেহেতু সর্বজনীন, সেহেতু অনেক মুসলিম বা অন্য ধর্মাবলম্বী পরীক্ষার্থীরও এই পূজানুষ্ঠানের কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি বিঘি্নত হতে পারে। লক্ষ করার ব্যাপার, পিএসসিতে চলমান (৩০তম বিসিএস) মৌখিক পরীক্ষা (২০০) গত ঈদের কারণে কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ ছিল।
যেখানে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা (মৌখিক) ধর্মীয় উৎসব ঈদের জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকে, সেখানে ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা (লিখিত) কোন বিবেচনায় আরেক ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে অনুষ্ঠিত হবে? এই সিদ্ধান্ত মানবাধিকারের কতটুকু অনুকূলে? বর্তমান সরকার যেখানে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি অধিকতর সম্মান প্রদর্শন করেছে, সেখানে পিএসসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান (সংবিধানের নবম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সরকারি কর্মকমিশন সম্পর্কে উল্লেখ করা আছে) ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে একটি পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করার মাধ্যমে এই চেতনার বিপরীত অবস্থান নেবে, একথা আমি এখনো বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা, বিষয়টি পিএসসি কর্তৃপক্ষের গোচরে কেউ আনেননি।
আমি যতটুকু জেনেছি, অনুষ্ঠিতব্য ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষার সময়সূচি এরকম : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১ ইংরেজি প্রথম পত্র; ২৭ সেপ্টেম্বর ইংরেজি ২য় পত্র; ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিষয়াবলি প্রথম পত্র; ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিষয়াবলি দ্বিতীয় পত্র; ২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি; ৩ অক্টোবর গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা; ৪ অক্টোবর বাংলা প্রথম পত্র; ৫ অক্টোবর বাংলা দ্বিতীয় পত্র; ৯ অক্টোবর সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি লিখিত পরীক্ষা। পাশাপাশি স্মরণ করা যাক এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবের স্মারক : ২ অক্টোবর ষষ্ঠী; ৩ অক্টোবর সপ্তমী; ৪ অক্টোবর মহাষ্টমী; ৫ অক্টোবর মহানবমী; ৬ অক্টোবর বিজয়া দশমী। অর্থাৎ শারদীয় দুর্গোৎসবের কয়েক দিন আগে থেকে ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষা আরম্ভ, আর পূজার তিন দিন পর পরীক্ষা শেষ হবে।
ষষ্ঠী, সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী_এই চার দিন পূজা বাদ রেখে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যেতে হবে পরীক্ষার হলে। দশমীর দিন ৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি থাকায় বিসিএস পরীক্ষা নেই। হিন্দু পরীক্ষার্থীরা সেদিন পূজাস্থলে যেতে পারে, কিন্তু বাঙালি মাত্রই জানেন, দশমীর দিন আসলে পূজার কোনো আনন্দই থাকে না; সেদিন তো বিসর্জন। এরপর ৯ অক্টোবর পরীক্ষার্থীদের আবার পরীক্ষার হলে যেতে হবে।
এই অমানবিক ও অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে পিএসসি কর্তৃপক্ষ সরে আসতে পারে ৩১তম বিসিএস (লিখিত) পরীক্ষার তারিখ পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে।
মাত্র দুই সপ্তাহ পিছিয়ে আরম্ভ করলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রধান সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব অতিক্রান্ত হয় এবং এতে 'দুর্গা পূজার দিন পরীক্ষা নিয়েছে পিএসসি' এমন একটি কথা থেকেও মুক্ত থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
-----------------------------ড. সৌমিত্র শেখর
...............................অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।