আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চোখের ভেতর বৃষ্টি পুষি

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম... প্রতিদিন সকালে কোন না কোন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঢাকা শহরের ঘুপচি মেসে যারা থেকেছেন তারা ভাল করেই জানেন কেমন সমস্যা হতে পারে। হয় বাড়িওয়ালার চিল্লাচিল্লি, না হয় কাজের মহিলার উচ্চবাচ্য, না হয় রুমমেটের কচকচানি যেকোন একটা অনুসংগ থাকেই। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে নিজের মেধায় বড়জোর একটা বা দুইটা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি জুটানো যায়। এরপরে চাকরী নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের আরাম-আয়েশ, সাধ-আহ্লাদের কথা মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।

সাধ-আহ্লাদ ছিলই বা কবে সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। অজপাড়াগাঁয়ের সামান্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবাকে পেয়েছি অল্প ক'দিন। বাবা মারা যাওয়ার পরে টেনেটুনে চলা সংসারে বিলাসীতা শব্দটা সবসময় অবাঞ্চিতই হয়ে থেকেছে। আর এখন গোটা তিনেক টিউশনি’র পয়সা থেকে হিসেব করে বাড়ির জন্য আলাদা করে রাখতে হয়। মাসের শেষ দশটা দিন হয়তো পকেটে দশটা টাকার বেশি নিয়ে ঘোরা যায় না।

পাঁচ টাকা রিক্সা ভাড়া বাঁচানোর জন্য জ্বরের শরীরটাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে হয় টিউশনির বাসায়; সেটা যে মিস করা যাবে না কিছুতেই। অনেক সাধ্যি সাধনায় জুটানো টিউশনি ছুটে গেলে পরের কয়েকটা মাস ধারকর্য করে চলার মত দুঃসাহস এখন আর করা যায় না। এমনিতেই বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা থেকে একশ হাত দূরে থাকি বাড়তি খরচের ভয়ে; তার উপরে কিছু ধারকর্যের দায়ও এসে জুটেছে। পত্রিকার পাতা কেটেকুটে সার্কুলার জমতেই থাকে। কিন্তু ব্যাংক ড্রাফট আর পে-অর্ডারের মূল্যমান দেখে দরখাস্ত করা হয়ে ওঠে খুব অল্প কিছুই।

যদি ভাইভা পর্যন্ত যেতেও পারি, সাদামাটা গোটা চারেক সার্টিফিকেট আর মলিন পোষাক নিয়ে শেভিং ক্রিম ছাড়া শেভ করা আমার চেহারায় চাকরী পাওয়ার মত জেল্লা কখনোই আনতে পারি নি। মেসের প্রায় অখাদ্য রান্না খেয়ে না-খেয়ে মাশাল্লাহ বলিউডি নায়িকাদের মত স্লিম হয়ে উঠেছি দিনে দিনে। তবে সকালবেলার নাস্তা নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয় না। গলির মাথায় ছোট একটা চা-স্টল আছে। দোকানের মালিক নুরু চাচা।

কোন এক অদ্ভুত কারণে এই লোকটা আমাকে ভীষণ রকম পছন্দ করেন। চরমপন্থীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মোটামুটি স্বচ্ছল একটা পরিবার নুরু চাচা বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে তার বউ আর আট বছরের ছোট্ট একটা ছেলেকে নিয়ে ঢাকা শহরের এই কানাগলিতে এসে চা-স্টল পেতেছেন। কাঁচাপাকা চাপ দাঁড়িতে পঞ্চাশোর্ধ এই মানুষটার সদাহাস্য মুখ কখনো মলিন হতে দেখি নি। প্রথম বয়সে সন্তান হয় নি। এই কারণেই কিনা জানি না, আমার বয়সী একটা ছেলেকে দেখে ওনার ভেতরের সেই পুরনো বাবা সত্তাটা জেগে ওঠে হয়তো।

দোকানের বাকীর খাতায় অনেক টাকা জমিয়ে ফেলেছি এরমধ্যে। এই কথা তুললেই তিনি পাশ কাটিয়ে যান। মাঝেমধ্যে বাসায় ভালমন্দ রান্না হলে ডেকে নিয়ে খাওয়ান। নুরু চাচার বউ পাটিতে খাবার সাজিয়ে দিয়ে পাশে বসে এটাওটা তুলে দেন। কারেন্ট থাকলেও তালপাতার হাতপাখা দিয়ে এপাশওপাশ বাতাস করেন।

আমি নিচু হয়ে খাওয়ার ফাঁকে আড় চোখে অনেকবার দেখেছি ওনার চোখে জল টলটল করে। কি এক অদ্ভুত মায়া সে চোখে আমি তাকিয়ে থাকতে পারি না পাছে নিজের চোখ ভিজে ওঠে। মাঝে মধ্যে বলেন, ‘খাও বাবা। কত কষ্ট কর সারাটাদিন। মেসে কি খাও না খাও।

বাড়ি যাও বছরে একদুইবার। আমরাতো জানোই গরীব মানুষ। নিজের ঘর মনে করে এসে বলবা কি খেতে চাও। ’ সব ধরণের স্নেহমায়া, মমতা থেকে চিরবঞ্চিত এই আমি’টার জন্য একেবারেই অচেনা একজন মায়ের এই অব্যাখ্যনীয় মমতায় আমার ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে সব অভিমান বের হয়ে আসতে চায় যেন। আমি নাকেমুখে খাবার গুঁজে দিয়ে পালিয়ে আসি সেখান থেকে।

মায়ের স্নেহ পেয়েছি যেটুকু খুব বেশি মনে করতে পারি না। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি একদিন হুট করেই বাবা মারা গেলেন। তখন মায়ের কোলে তিনমাসের ছোট বোন আমার, মৌরী। জমিজমা নাই বললেই চলে। আর বাবা মারা যাওয়ার পরে আশ্রয় হল মেজো চাচার সংসারে।

তার কিছুদিন পরেই মা প্যারালাইজড হয়ে গেলেন। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যেতে লাগল যে সেই খেলাধুলা করা দুরন্ত শৈশবে এত কিছু বুঝে ওঠার মত পর্যাপ্ত সময় আমি পাই নি। নিজে থেকেই কেন যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া শুরু সেই তখন থেকেই। একটু বড় হয়েই বোনটা আমার ন্যাওটা হয়ে গেল। স্নেহবঞ্চিত হতভাগী বোনটা আমাকে লতাপাতার মত আঁকড়ে ধরল দিনে দিনে।

ঐ নিষ্পাপ মুখটার কারণেই হয়তো কিছুটা হলেও বেঁচে থাকার প্রেরণা এখনো ধারণ করে চলেছি নিজের খুব ভেতরে কোথাও। ছোট্ট বয়স থেকেই কি করে যেন অনেক কিছু বুঝে ফেলত। আমি পড়তে বসলে ছোট ছোট হাত দিয়ে চুল টেনে দিত। খাবার সময় এটাওটা নিজের পাত থেকে আমার পাতে তুলে দিত। হাটবারের দিন একদুইটা লজেন্স যদি পকেটে করে নিয়ে আসতাম, হাতে দিলে আগেই বলত, ‘তোর আছে? আমি একলা খাব না।

’ পরীক্ষার সময় প্রতিদিন বলত, ‘ মা’কে সালাম করে যা। আর আমাকেও করবি। তুই অনেক বড় হবি ভাইয়া। সেদিন আমাকে পুরা এক প্যাকেট লজেন্স কিনে দিবি। আর একটা লাল শাড়ি।

’ মাঝে মধ্যে গল্প, কবিতা লেখার একটা বদঅভ্যাস আছে আমার। নিজের মনে যা আসে লিখি। হয়তো নিজের কথাগুলো বলার মত কাউকে পাই না বলে নিজের সাথেই নিজের একটা কথা বলার মাধ্যম এই লেখালেখি। আমার এক বন্ধু একবার বলল, ‘দোস্ত, তুইতো অনেক ভাল লিখিস। আমার এক পরিচিত বড় ভাই আছেন একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক।

একদিন কথা বলিয়ে দেব। ’ আমি গিয়েছিলাম তার কাছে। কয়েকটা গল্প দেখে তিনি বললেন, ‘এসব চলবে না। কি লেখ ছাঁইপাশ দুঃখ দুঃখ গল্প! মানুষের চোখে রঙ্গীন চশমা বুজছো? তারা চায় চাকচিক্য, সুরসুরি আর রোমান্স। অস্থির প্রেমের গল্প যদি লিখতে পার তাহলে নিয়ে এসো, ভেবে দেখব।

’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বড় ভাই, একদিনে কয়টা বেনসন লাগে আপনার?’ অপ্রাসাঙ্গিক প্রশ্ন শুনে উনি একটু থেমে গেলেন। বললেন, ‘কেন জানতে চাইলে?’ বললাম, ‘এমনি ভাই, আমি তাহলে যাই এখন। ’ ইউনিভার্সিটিতে প্রথমদিনেই একটা মেয়েকে কেন যেন আলাদা করে চোখে পড়ে গেল। খুব বেশি সুন্দরী যে তাও না। গোল ফ্রেমের একটা চশমা পরা ঝাপসা গায়ের রঙ শান্ত চুপচাপ সেই মেয়েটিকে এরপরের কয়েকবছর চুপচাপ কতবার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি তার কোন হিসেব নাই।

ওর নাম সোহেলী। মেয়েটাও মনে হত আমাকে দেখে। কিন্তু সেটাকে অবচেতন মনের ভাবনা বলেই উড়িয়ে দিতাম। একসময় মনে হল আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল।

তখন মা প্রচন্ড রকম অসুস্থ বাড়িতে। চাচা সাফ বলে দিলেন সে আর এই দায় টানতে পারবে না। এখন থেকে সব চিকিৎসার ভার আমাকে নিতে হবে। আমি টিউশনির সংখ্যা বাড়িয়ে দিলাম। আর তখনই আমার এই চূড়ান্তরকম অসহায় অবস্থা।

সোহেলীর চোখের সামনে পড়ে যাব এই ভয়ে ক্লাসে যাওয়া কমিয়ে দিলাম। নিজের রুমে শুয়ে ছটফট করেছি কতদিন তার কোন ইয়ত্তা নাই। ডিপার্টমেন্ট-ফাংশন, কন্সার্ট, নাটক, শিক্ষা-সফর সবখানেই যাওয়া বাদ দিয়ে দিলাম। একেতো টাকাপয়সার টানাটানি তার উপরে আমার নিয়ন্ত্রণহীন সেই অবস্থায় আমি কিভাবে যে সেই সময়গুলো কাটিয়েছি নিজেও বলতে পারব না। মাস্টার্সে ওঠার কয়েকমাস পরে একদিন ছোট্ট একটা এসএমএস পেলাম, ‘তুষার, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

’ আমার ফোন নাম্বার সোহেলী কোথা থেকে পেয়েছে জানি না। ভেঙ্গে পড়া বলতে কি বুঝায় কত প্রকার সেদিন মনে হয় বুঝেছিলাম কিছুটা। কি অদ্ভুত রকম একটা চাপা কষ্ট সেদিন আমাকে ছুঁয়ে গেল আমার কাছে তার কোন ব্যাখ্যা আজও নাই। প্রচন্ড রাগ, অভিমান, হতাশা সব মিলেমিশে একটা ফিউশন হয়ে গেছে আমার ভেতরে সেদিন হয়তো। আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘ভাল খবরতো।

সুখে থাকো, বন্ধু হিসেবে এটাইতো চাই। পারলে আমাকে ক্ষমা কর। ’ এই শুরু, এই শেষ। সেদিন ডাইরির পাতা হয়ে উঠেছিল আমার পরম বন্ধু। নীরবে শুনে গেছে আমার তিলতিল কষ্টের কথাগুলো।

মিথ্যে বলব না, একটাও প্রশ্ন করে নি সেদিন আমার ডাইরিটা। যা কখনো বলা হয় নি তাই সেদিন হড়বড় করে বলে গেছি ডাইরির পাতা ভরে। আমার কষ্টগুলো বুকে নিয়ে ডাইরির পাতাগুলো সেদিন আর্দ্র হয়ে উঠেছিল আমি বুঝেছি। তোমারতো অনেক কিছুতে সুবিধা। যত যা কিছুই ঘটুক একটা ভাল বিয়ে হয়ে গেলে সব ল্যাঠা চুকে যায়।

কিন্তু আমাদের মত চালচুলোহীন ছেলেদের যত সমস্যা। না পারা যায় নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে। না পারা যায় পরিবারকে ছেড়ে দিতে। না পারা যায় নিজের পছন্দ মত কাউকে বেছে নিতে। কারণ শূন্য থেকে যাদের শুরু করতে হয় তাদের গুছিয়ে উঠতে উঠতেই অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে যায়।

আর এই দেশে শুধু মেধার জোরেই যে ভাল কিছু করা যাবে এমনও কোন নিশ্চয়তা নাই। সব মিলিয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় মাথাটা এমনিতেই অদৃশ্য ভারে নিচু হয়ে যায়। যতক্ষণ জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রাখা যায় ততক্ষণ ঠিক আছে। আর বেলুনের দম ফুরিয়ে যাওয়ার মতই যখন হাসিটা মিলিয়ে যায় তখন সেই আবার পুরনো মুখপোড়া হনুমান। আনন্দের উপলক্ষ্যগুলোও কাছেপিঠে খুব বেশি থাকতে চায় না।

কারণ আমার সংগ যদি কাউকে আনন্দ না দেয় তাহলে সে-ই বা বেশি সময় আমার পাশে থাকবে কেন? কিন্তু খুব কাছে এসে ভেতরে গুটিয়ে যাওয়া আনন্দটুকু যে বের করে নিয়ে আসতে পারে সেও যদি চলে যায় বা চলে যেতে বাধ্য হয় তখন আর কিছু বাকী থাকে না। আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়াগুলো বড় অদ্ভুত। কখনো নিজের মত করে পাওয়া হয়ে ওঠে না অনেক কিছুই। খুব কাছে গিয়েও হয়তো নানান কারণে আবার ফিরে আসতে হয়। হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নিতে হয়।

হয়তো অল্প কিছুদিন সময়ের ব্যাবধান মিলাতে না পেরে অনেক কিছু করা হয়ে ওঠে না, করা যায় না। হয়তো যে কথাগুলো বলার জন্য ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় সে কথাগুলো বলার সময় হওয়ার আগেই সবকিছু চোখের সামনে অসহায়ের মত ওলটপালট হয়ে যেতে দেখতে হয়। তখন কিছু করাও যায় না আবার কষ্টও পেতে হয় অনেক। কষ্ট পুষে বেঁচে থাকাটাই মনে হয় বেশিরভাগ মানুষের নিয়তি। অভিনয়টুকুও যে করতে পারে না, তার অবস্থা হয় সবচেয়ে করুণ।

আমাদের গ্রামের বাড়িতে তখন মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। ঈদের পনেরোদিন আগে মৌরী’র চিঠি পাই। ‘ভাইয়া, এবারও কি তুই বাড়ি আসবি না? মা তোর জন্য খুব কান্নাকাটি করছে। আমি কিন্তু একটুও কাঁদি না বুঝেছিস? তোর জন্য আমার কাঁদতে বয়েই গেছে। শোন, মা’কে এক শাড়িতে দেখতে দেখতে আর ভাল লাগে না।

এবার পারলে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনে দিস। আমার জন্য আবার কিছু কিনিস না যেন। মা বলেছে তার বাঁশের চোঙ্গায় জমানো পয়সা বের করে আমাকে একটা থ্রিপিচ কিনে দিবে এবার। আর তুই যদি না আসিস, আমিতো ঈদের দিন বেরই হব না। সারাদিন ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকব বলে রাখলাম।

ভাল থাকিস, মুখপোড়া হনুমান। ’ কয়েকদিন ধরে সারাদেশেই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রূপা নামে আমার একটা ছাত্রী আছে এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ওদের বাসায় গত দুই মাসের টিউশনির বেতন বাকী পড়ে আছে। আমি কখনো ছাতা ব্যাবহার করি না।

টাকা বাঁচানো একটা বিষয় আর বৃষ্টিতে ভিজে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটা আমার প্রচন্ড রকম একটা নেশা। নিজেকে কেমন রাজা রাজা মনে হয়। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মনে হয় আমার ভেতরে ঢুকে যায়। মুছে দেয় জমে ওঠা নানা রঙের ক্ষতগুলো। আমি বৃষ্টির মধ্যেই সন্ধ্যার দিকে রূপাদের বাসায় যাই।

তখন ঈদের দুইদিন বাকী। মেয়েটার মা মারা গেছেন ওর জন্মের সময়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। ঐ ঘরের ভাইবোনদের সাথে ও মিশতে পারে না। নতুন মা’ও অনেক বৈরী।

বাবাও তেমন কিছু খোঁজ খবর রাখেন না। কোন রকম পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই টাকা-পয়সা নিয়ে কখনো চাপ দিতে পারি নি। তবে ঈদের সময় দুইমাসের টাকা একসাথে পেয়ে যাব এটা ধরে রেখেছিলাম। না হলে এবারও বাড়ি যাওয়া হবে না।

রূপাদের বাসায় গিয়ে শুনি ওর বাবা-মা দেশের বাইরে গেছেন শপিং করতে। বাসায় কাজের বুয়া আর রূপা আর কেউ নাই। আমি ঘরে ঢুকলাম না। রূপা শাড়ি পরেছে। আমি জানি ও জন্মদিনে শাড়ি পরে।

ও জানে আমি কখনো জন্মদিন পালন করি না। কখনো উইশও করি নি। রূপা আমার হাতে একটা প্যাকেট দেয়। ভেতরে টাকা আছে বুঝতে পারি। আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘যাই।

’ আমি বুঝতে পারি রূপার চোখ ছলছল করে উঠেছে। পেছনে ফিরে রাস্তায় নেমে পড়ি। রূপা পেছন থেকে বলে, ‘তুষার ভাই, এককাপ চা খেয়ে যান অন্তত। আর একটা ছাতা নিয়ে যান। ভিজে জ্বর বাঁধাবেনতো!’ আমি পেছনে তাকাই না।

রূপার শেষ কথাগুলো ভারী হয়ে ওঠে। আমি জানি রূপা এখন কাঁদবে। ভীষণ রকম কান্না। রূপা ছাদে চলে যাবে। ওর সব কষ্টের আশ্রয় এই বৃষ্টি।

বৃষ্টির কাছে নিজেকে সপে দেবে। কতক্ষণ ভিজবে তা অবশ্য জানি না, তবে অনেকক্ষণ সেটা জানি। একটা যাত্রী ছাউনি ফাঁকা পেয়ে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা খুলি। একটা চিরকুট বের হয়ে আসে। ‘তুষার ভাই, বাবা-মা তাড়াহুড়া করে চলে যাওয়ায় আপনার বেতনের টাকা রেখে যান নি।

আমাকে হাত খরচের জন্য দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। প্যাকেটে আছে। আমি বললে আপনি নিবেন না, তাই বলি নি। আমার ইদানিং কান্না রোগে পেয়েছে। যখন তখন শুধু কান্না পায়।

আমাকে ক্ষমা করবেন। ’ মোবাইলটা কাল রাত থেকে অফ করে রেখেছি। কি মনে করে অন করলাম। একটা এসএমএস আসে। ‘ভাইয়া, মা নেই।

আমি বন্দরের দোকান থেকে তোকে ফোন করেছি অনেকবার, পাই নি। বাড়ি চলে যাইরে ভাই। মা’কে ওরা কোথায় যেন নিয়ে যাবে। আমি নিয়ে যেতে দেব না; কিছুতেই না। মৌরী...!’ আমার চারপাশ শব্দহীন হয়ে যায়।

আমি বৃষ্টি দেখি। মন্ত্রমুগ্ধের মত রাস্তায় নেমে যাই। বৃষ্টির ফোঁটা নেমে যাচ্ছে আমার কপালের চুল বেয়ে চোখের পাপড়ি চুঁয়ে টপ টপ করে। আমি ভাবতে থাকি ক’ফোঁটা অশ্রু হলে বৃষ্টির জল লোনা হয়ে যাবে। আমার চোখের ভেতর একটা ছোট্ট মেয়ে দৌড়াচ্ছে।

ভীষণ দৌড়াচ্ছে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। হোচট খেয়ে পড়ে কাদামাটি লেগে গিয়ে বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে আবার। মেয়েটার চোখে একজন মায়ের মুখ। মেয়েটা তার মা’কে কোথাও নিয়ে যেতে দিবে না।

-------------------------- গল্প মানে শুধুই গল্প; আবার জীবন মানেই গল্প। কিছু কষ্ট, কিছু অনুভূতি খুব বেশি চেনা মনে হয় কখনো কখনো। চারটা দেয়াল মানেই নয়তো ঘর নিজের ঘরেও অনেক মানুষ পর কখন কিসের টানে মানুষ পায় যে খুঁজে বাঁচার মানে ঝাপসা চোখে দেখা এই শহর আমি বৃষ্টি দেখেছি, বৃষ্টির ছবি এঁকেছি... শিরোনামটা শিরীষদা'র একটা কবিতা থেকে নেয়া। চোখের ভেতর বৃষ্টি পুষি চোখের ভেতর রোদ  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.