আমি সকলের মংগল কামনা করি। ‘‘মাই লর্ড ’’ উপনিবেশিক এই শব্দটি এখনো চালু থাকবে?
বৃটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোতে মানুষের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করেছে যে, বিচারকরা ভুলের উর্দ্ধে। তারা খোদার সমতুল্য। ধর্মাবতার। তার জন্যে বিচারকদের সম্মোধন করার নিমিত্তে তারা সেই ধরনের শব্দ চয়ন করে চালু করে গেছেন।
হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের “মাই লর্ড” সম্মোধন করা তেমনি একটা ব্যাপার। ভারতে এই মাই লর্ড সম্মোধনের প্রথাটি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে 'ইউর অনার' বা অনারেবল কোর্ট সম্মোধন করা হয় সেখানে। বলাই বাহুল্য, এতে সম্মানিত বিচারকদের সম্মানকে কোনভাবেই খাটো করা হয়নি। বরং বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
কেননা বিচারকদের “মাই লর্ড” সম্মোধনকে জনগণ কখনোই ভাল চোখে দেখেনি। আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গেও এটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিচারপতিদের “মাই লর্ড” সম্বোধন করা হয় না। করা হয় “ইউর অনার” বলে। (সংবাদ ইত্তেফাক, ২৮ এপ্রিল ২০০৬) বিচারকদের প্রতি মাথা নোয়ানোর রীতিটিরও বিলুপ্তি ঘটাতে হবে।
এর দ্বারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী বিচারপতি কিম্বা আইনজীবী সকলেই বিব্রতবোধ করে থাকেন। আর এ রীতিটা যুক্তির বিচারে সরাসরি অনৈসলামিকও বটে।
বিচারকদের ‘বিব্রতবোধ’ কতটুকু আইনসম্মত:
একজন বিচারপতি শপথ নেয়ার সময় সংবিধান অনুযায়ী পাঠ করে-‘‘আমি ........ বিচারপতি নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষন করিব। আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীত বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবতী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরন করিব।
’’ -এরূপ শপথ নেয়ার পর কোন বিচারপতি বিচার করতে গিয়ে যদি বলেন, তিনি বিব্রতবোধ করছেন, তাহলে এটা কি তার শপথের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ন কিম্বা আইনসম্মত হলো ? সম্মানিত বিচারপতিদের প্রতি জনগনের পক্ষে আমার প্রশ্ন রইল।
হাইকোর্টের বিচারকগণ ‘জাষ্টিস‘ নাকি ‘জজ’
আমাদের সংবিধানের ৯৪নং অনুচ্ছেদের (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও আপীল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করিবেন। এটার ইংরেজী ভার্সন হলো- The Chief Justice, and the Judges appointed to the Appellate Division, shall sit only in that division and the other judges shall sit only in the High Court Division.
সুতরাং সংবিধান অনুসারে দেখা যাচ্ছে, কেবল মাত্র প্রধান বিচারপতিকে চীফ জাষ্টিস হিসাবে আখ্যায়িত করা যাবে। বাকিরা সবাই জজ বা বিচারক হিসাবে আখ্যায়িত হবেন। কিন্তু সংবিধান এখানে একটা ধুয়াশার সৃষ্টি করেছে।
অনেক বিচারপতি থাকলে সেখানেই কেবল প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন আসে। অন্যরা জজ হলে তিনি প্রধান জজ হিসাবে আখ্যায়িত হওয়ার কথা। কিন্তু সংবিধানে ব্যবহৃত এসব শব্দগত মারপ্যাচে আইনের ভাষায় বলতে গেলে এটা বলাই সঙ্গত হবে যে, প্রধান বিচারপতি বা চীফ জাষ্টিস ছাড়া হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্টের সকল বিচারকই জজ হিসাবে গন্য হবেন, বিচারপতি নামে নয়। সংবিধানের ৯৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ীও ব্যাপারটি স্বীকৃত বটে। বাংলায় প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যান্যদের বিচারপতি না বলে বলা হয়েছে বিচারক।
সম্প্রতি সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনী হলেও এ ব্যাপারটি আবারো উপেক্ষা করা হয়েছে।
‘বাংলা ভাষা’-এদেশের উচ্চাদালতে চলার যোগ্যতা কখন অর্জন করবে?
উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত বিদেশেও চলে, সে কারণে উচ্চাদালতের রায় বিদেশের আদালতগুলোতে যায়। স্বভাবতই এখানে ইংরেজীর ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু তাই বলে বাংলা চলবে না এটা কেমন যুক্তি? ইতিহাস ঘেটেঁ যতটুকু জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো ১৯৬৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর ঢাকা হাইকোর্টের শামসুদ্দীন আহমদ নামীয় আইনজীবী একটি ফৌজদারী রিভিশনের দরখাস্ত বাংলায় লিখে হলফনামা করানোর জন্য দাখিল করেন। কিন্তু দরখাস্তটি ইংরেজীতে লিখিত না হওয়ার কারণে তা গৃহীত হয়নি।
হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার একটি লিখিত আদেশ দ্বারা তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এ আদেশের বিরুদ্ধে একটি রীট পিটিশন হয়। কিন্তু হাইকোর্ট সে রীট পিটিশন খারিজ করে দেন। যদিও সেটা পাকিস্তান সংবিধানের ২১৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী ছিল।
৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এদেশ স্বাধীন হয়েছে।
এদেশের নাম বাংলাদেশ। জাতি হিসাবেও এখন আমরা বাঙ্গালী। কিন্তু বাংলাটা আজো এখানে সেই আগের মতই অবহেলিত আছে। এখনো এদেশের হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টে বাংলা ভাষা অচল। ব্যবহারের অযোগ্য।
যদিও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক কিছু জাজমেন্ট বাংলায় লিখেছেন। ঐ পর্যন্তই। অথচ আমাদের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে ষ্পষ্ট করে লেখা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা” খেয়াল করুন ইংরেজী, হিন্দি বা ফরাসী ভাষার কথা কিন্তু বলা হয়নি। আর জানেন তো, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আর সর্বোচ্চ আদালত-এ সর্বোচ্চ আইন মানছে না সে ধরনের কথা বলে আমি কি আদালত অবমাননার মামলায় জড়াতে যাব? আপনারাই বলুন।
ব্রাকেটে আরেকটা কথা, যারা বিদেশ থেকে বিরাট বিরাট ডিগ্রী নিয়ে হাইকোর্টে সুপ্রীম কোর্টে প্র্যাকটিস করছেন, মুখে হরদম ইংরেজীর খই ফুটিয়ে নিজের পান্ডিত্য জাহির করেন, (সবার কথা বলছি না, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন) তারা ভাল বাংলা বলতে পারেন না বা বাংলা তেমন আসে না” জাতীয় একটা হাবভাব প্রদর্শন করতে কসুর করেন না। নিজের রাষ্ট্রভাষা ভুলে যাওয়া কোন গৌরবের কথা হলো ? দু’ লাইনের বাংলা বলতে গিয়ে ১০/১৫টা ইংরেজী শব্দ ঢুকান। এটা বাংলার জন্যে কি কোন ভাল লক্ষণ ? হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞজনেরা বলছেন, এখানে বাংলা চালু করলে আইনের বারটা বেজে যাবে। কোর্টের মান কমে যাবে। বিদেশে এদেশের আইনের রেফারেন্স দেয়া হবে না।
তাই বাংলা চলবে না। যুক্তিগুলো আমিও সমর্থন করি। কিন্তু এদেশে সংবিধান তো অন্য কথা বলছে, এটাই আমি বুঝাতে চাচ্ছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।