আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান : এক বর্ণাঢ্য আর বেদনাবিধুর জীবন

কেউ বুঝে না এই আমাকে...তাই আমিও কাউকে আর বুঝতে চাই না। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের জীবন ছিল একই সঙ্গে বেদনাবিধুর। বাংলাদেশের রাজনীতির এই বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ২০ মার্চ বাংলাদেশ সময় বিকেল চারটা ৪৭ মিনিটে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। সমগ্র জাতি আজ তার মৃত্যুতে শোকাহত। বিগত চার দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি পদে পেয়েছে ১৫ জন ব্যক্তিকে।

যাদের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর জিল্লুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ছিলেন পুরোদস্তুর রাজনীতিক। স্কুলজীবনে রাজনীতিতে হাতেখড়ি, এরপর একজন স্বেচ্ছাসেবক থেকে রাজনীতির পথচলায় দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন জিল্লুর রহমান। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার পরে এবারই এদেশে কোনো চলমান রাষ্ট্রপতির মৃত্যু হলো। তবে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হয়েছিল অপঘাতে অস্বাভাবিকভাবে, আর জিল্লুর রহমানের মৃত্যু হয়েছে জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে। কিশোরগঞ্জের ভৈরববাজার শহরের মোল্লাবাড়িতে ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ জিল্লুর রহমান জন্ম নেন।

তার নানা বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈতাতলা। জম্মের সাত মাসের মাথায় মা বাচ্চু বিবি মারা যান। আর নয় বছর বয়সে হারান বাবা স্বনামধন্য আইনজীবী অবিভক্ত ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য মেহের আলীকে। অনাথ ও বেদনবিধুর শৈশবে জিল্লুর রহমান বেড়ে ওঠেনদাদা হাজি মোজ্বাফর মুন্সী ও নানা-নানির আশ্রয়ে । জিল্লুর রহমান ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

১৯৪৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে আই এ পাশ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন।

সেখানেই ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রী কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রী ফিরিয়ে দেয়।

তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। মোঃ জিল্লুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদন্ড প্রদান ও তাঁর সকল সম্পত্তি বাজেয়াফত করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অংশ নেন। ১৯৭৩ তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রথম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর প্রায় চার বছর মোঃ জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় একাধিকবার তাকে দীর্ঘমেয়াদে কারাবন্দীও থাকতে হয়।

১৯৮৪ সালে জিল্লুর রহমান পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য থাকাকালে মোঃ জিল্লুর রহমান আবারও কারাবরণ করেন। ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালে দলীয় কাউন্সিলে জিল্লুর রহমান পর পর দুইবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদে তিনি আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মহান জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজপথের সঙ্গী স্ত্রী আইভি রহমান, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে জিল্লুর রহমান যখন সুখের জীবন পার করছিলেন তখন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আবার বড় আঘাত আসে তাঁর জীবনে। শেখ হাসিনার জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান মারা যান। স্ত্রীকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন জিল্লুর রহমান। তবে রাজনীতিতে তিনি নিজেকে সচল রাখেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরী আইন জারির পর ওই বছরের ১৬ জুলাই রাতে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেন। দীর্ঘ ১১ মাস শেখ হাসিনার জেলজীবন এবং চিকিৎসার জন্য আরও প্রায় ৬ মাস দেশের বাইরে অবস্থানকালে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ জিল্লুর রহমান দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল অবদান রাখেন এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অবিস্মরণীয় বিজয় লাভ করে। এই নির্বাচনে তিনি ৬ষ্ঠ বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

গত ৯ মার্চ ছিল জিল্লুর রহমানের ৮৫তম জন্মদিন। অবশ্য এ দিনটিতেই তাঁকে চিকিৎসকদের পরামর্শে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কে জানতো প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে এটাই তার শেষ যাত্রা !  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.